
‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ‘মাতাল হাওয়া‘র গল্প। তবে আন্দোলনকেন্দ্রিক কাহিনী খুবই কম, বেশিরভাগই কাল্পনিক। সে সময়কার মুজিব আর মাওলানা ভাসানীবিরোধী কিছু সময়, যখন দেশের গণআন্দোলন ঠিক কোনদিকে মোড় নিচ্ছে কেউই আন্দাজ করতে পারছিল না। দেশের পরিস্থিতি তখন প্রচণ্ড উত্তাল। সেই উত্তাল সময় থেকে বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘মাতাল হাওয়া‘।
বইটিকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ঊনসত্তরের কাহিনী, আর হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনীমূলক কাহিনী।
গল্পের মূল চরিত্রগুলো পশ্চিম পাকিস্তানপ্রেমী। সে সময়কার বেপরোয়া ছাত্রনেতাদের নারী অত্যাচার এবং দেশ থেকে একাধারে হিন্দুদের বিতাড়িত করা ইত্যাদি ঘটনার কিছু কিছু কাল্পনিক উদাহরণ দেখা গেছে। হয়তো বা এ চরিত্রগুলো আসলেই লেখকের পরিচিত কেউ ছিল।

ঊনসত্তরের দেশব্যাপী আন্দোলন তখনো শুরু হয়নি। চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ছাত্রী হলগুলো থেকে যে যার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। গ্রামে তখনো আন্দোলনের রেশ পৌঁছায়নি, বেশিরভাগ ছাত্রীই তাই গ্রামমুখী হচ্ছিল।
নাদিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী তখন। ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। বাবা হাবীব সাহেব প্রায়ই মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় থাকেন, এখনো কেন নাদিয়া হল ছেড়ে বাড়ি আসছে না? পরে লোক পাঠিয়ে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসেন হাবীব সাহেব।
হাবীব সাহেব হলেন হলেন সে সময়ের বিশিষ্ট আইনজীবী। একই সাথে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানপ্রেমী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সকল সিদ্ধান্তের ঘোরবিরোধী, এমনকি দেশনেতা কর্তৃক উত্থিত ছয় দফা দাবিরও বিরুদ্ধে তিনি। আবার তিনিই রাজনীতির ভেতর ‘পলিটিক্স’ মেশাতে পছন্দ করেন। অন্য ধরনের আকর্ষণবোধ করেন এই উন্মত্ত খেলায়। আশেপাশের বা বিভাগীয় হর্তাকর্তা মানুষের সাথে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক। এদের সাহায্যে তিনি অতি পরাক্রমশালী। সে সময়কার গভর্নর মোনায়েম খান তার আত্মীয়। যার সাহায্যের হাত পেলে কোনো সৎ পুলিশ অফিসারের চাকরি নিয়ে টানা-হেঁচরা করতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন না। কিংবা নিজের এসব কুকীর্তির সংবাদ কোনো হোট্টামোট্টা আঞ্চলিক পত্রিকায় ছাপা হলে প্রকাশনীর মালিককে এক বিন্দুও ছেড়ে দেন না।
এদিকে যখন দেশজুড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছে, তখন নাদিয়া পছন্দ করে বসে তারই ডিপার্টমেন্টের এক তরুণ হিন্দু শিক্ষককে। হাবীব সাহেব আবার নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে চান অন্য একটি ছেলের কাছে। হাবীব সাহেবেরই মতো ময়মনসিংহ অঞ্চলের আরেক বিত্তশালী জমিদার বংশের ছেলে সে।
হুমায়ূন আহমেদ আর নাদিয়া একই সাবসিডিয়ারি কোর্সের ক্লাসমেট। নাদিয়া হুমায়ূনকে বিভিন্ন সময়ে চিঠি লিখতো, সব খবরাখবর জানাতো। তাই ‘মাতাল হাওয়া’য় হুমায়ূন আহমেদের আত্মকাহিনী আর নাদিয়া-হাসানের গল্পটি সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলে।

এ বইয়ের একটা ব্যাপার খুবই ভালো লেগেছে, হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় দুটি চরিত্র রূপা আর মিসির আলীর জন্মসূত্র খুঁজে পেয়েছি।
“এই সময় আমার এক বন্ধু জনৈকা তরূণীর প্রেমে পড়লো। তরূণীর নাম রূপা। বন্ধুর প্রেমপত্র লিখে দেওয়ার পবিত্র দায়িত্ব পড়লো আমার হাতে। রূপার চিঠি সে আমাকে এনে দেয়। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ি। উত্তর লিখতে বসি। চিঠি চালাচালি চলতে থাকে। রূপা আমাকে চেনে না। আমিও তাকে চিনি না। গভীর আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে তাকে চিঠি লিখে যাই। মাতাল সময়ে লেখা প্রেমপত্রগুলিই হয়তো বা আমার প্রথম সাহিত্যকর্ম।
আমার বন্ধুর সঙ্গে রূপা মেয়েটির বিয়ে হয়নি। আমার বন্ধু তার এক পরিচিত আত্মীয়াকে বিয়ে করে শ্বশুরের পয়সায় ইংল্যান্ড চলে গেল।
রূপাকে আমি দেখিনি। তার ছবি দেখেছি। কী মিষ্টি, কী শান্ত চেহারা! পটে আঁকা ছবি। রূপা যেন হারিয়ে না যায় সেজন্যই হিমুর বান্ধবী হিসেবে আমি তাকে নিয়ে আসি। হিমুকে নিয়ে লেখা প্রতিটি উপন্যাসে রূপা আছে।”
অনুসন্ধানী মিসির ব্যাপারে বলছেন এভাবে,
“কল্পনার বকুলগন্ধা তরূণী পাশে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছি এমন সময় এক কাণ্ড- কানে এলো ডিম ভাজার শব্দ। প্রতিটি রুম তালাবন্ধ। বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। এর মধ্যে একটা ঘরের ভেতর ডিম ভাজা হচ্ছে, এর অর্থ কী? কানে কি ভুল শুনছি? যে রুম থেকে ডিম ভাজার শব্দ আসছে আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চামচের টুং টাং শব্দ। আমি দরজায় টোকা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সব শব্দের অবসান। কিছু রহস্য অবশ্যই আছে। রহস্যটা কী? আমি নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। রহস্যের কিনারা করতে হবে। (পাঠক, মিসির আলীর জন্মলগ্ন।) রহস্যের সমাধান করলাম।”
হুমায়ুন আহমেদ বর্তমান ছিলেন ঊনসত্তরের উত্তাল সেই সময়টাতে। প্রত্যক্ষ করেছেন নানা করুণ বাস্তবতা। সেসব সাথে নিয়ে এবং তার সাথে কল্পনার মায়াজাল বিছিয়ে তৈরি করেছেন এই উপন্যাস- মাতাল হাওয়া। পরিবেশে আবেশে পাঠক যেন এক মুহূর্তে চলে যাবে সেই সময়টাতে।
বইয়ের নাম: মাতাল হাওয়া || লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ || প্রথম প্রকাশ: ২০১০
অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি