বারে ঢুকতেই বার্টেন্ডার, লোকটিকে ‘বস’ বলে সম্বোধন করল। কিছু ভেবে নেওয়ার আগেই দর্শক বুঝতে পারে, সাধারণ কোনো খরিদ্দার স্যুট পড়া এই ভদ্রলোক নয়। রেস্টুরেন্টে ঢোকা এবং বিয়ার আর পিকলড এগ অর্ডার করার ঢঙই তার প্রভাব সম্পর্কে জানান দেয়। তার অর্ডার করা বিয়ারের ওই বার ট্যাপে স্লো-মোশনে একটা সেকেন্ডের জন্য ‘গ্রিচি’ নামটা দেখা যায়। তড়িৎ চলে যাওয়ায় হয়তো দৃষ্টিগোচর হবে না অনেকের। কিন্তু সচেতন দর্শক এবং তারচেয়েও বড় কথা, সিনেমার পরিচালক ‘গাই রিচি’র কাজের সাথে পূর্ব পরিচিত, তার কাজের ধারা সম্বন্ধে জানাশোনা রাখা দর্শক এক মুহূর্তের জন্য পর্দায় আসা ওই নামের ভেতর লুক্কায়িত সূক্ষ্ম রসবোধটুকু ধরতে পারবেন।
গ্রিচি= গাই+রিচি। ‘কিং আর্থার- লেজেন্ড অফ দ্য সোর্ড’ (২০১৭), ‘আলাদিন’ (২০১৯)- এর মতো গাই রিচির শেষ ক’টি কাজে যেন, তাকে পাওয়াই যায়নি। সেদিক থেকে ‘দ্য জেন্টলম্যান’-এর প্রারম্ভিক দৃশ্যেই ছোট্ট এই গ্যাগটি যেন জানান দিচ্ছে, পরিচালক তার আগের রূপে এবার ফিরছেন। শুধু তাই নয়, ‘গ্রিচি’ বলে ছোট্ট গ্যাগটি এও যেন নিশ্চিত করলো, যে স্বকীয় ধারার জন্য গাই রিচি, গাই রিচি হয়ে উঠেছেন সে-ধারাতেই এবার তিনি দৌড়ুতে চলেছেন।
ছোট্ট ওই গ্যাগের পর ‘বস’ সম্বোধিত চরিত্রটি ভয়েসওভারে বলে উঠে,
“তুমি যদি জঙ্গলের রাজা হতে চাও, রাজা হওয়ার ভান ধরাই যথেষ্ট নয়। রাজা তোমাকে হতেই হবে। এবং ওতে কোনো সন্দেহ থাকা চলবে না। কারণ সন্দেহই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে এবং নিজের মৃত্যু ডেকে আনে।”
এই সংলাপই সিনেমায় তার চরিত্রটি সম্বন্ধে আরো পরিষ্কার ধারণা দেয় দর্শককে। তবে চরিত্রটি নিয়ে আরো বিবরণ জানার আগেই হঠাৎ কানের কাছে বিকট শব্দ এবং বিয়ারের জগে ছিটকে পড়া কিছু রক্ত! শুরু হতেই শেষ? না, এ যে ‘গাই রিচি’। চাইলেই জিলিপির প্যাঁচের মতো বাঁকাতে পারে সে তার গল্পকে, পাকাতে পারে ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো।
গাই রিচি’র সিনেমার গল্প সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার কাজটি কখনোই খুব একটা সহজ ছিল না। অন্ততপক্ষে তার গ্যাংস্টারধর্মী সিনেমাগুলোর, যেগুলোই সত্যিকার অর্থে তার বৃত্তের সিনেমা। তাই স্বভাবতই দ্য জেন্টলম্যানের গল্প যথেষ্ট ছড়ানো এবং বাঁকানো। সেটুকু ছেড়ে এই সিনেমার পৃষ্ঠতল নিয়ে ধারণা দিতে গেলে তা দাঁড়ায় অনেকটা এমন-
যদিওবা এই গল্প খলনায়কদের তারপরো সিনেমার নামের সেই বিদ্রূপাত্মক টোন’টা ধরে বলা যাক, গল্পের প্রধান নায়ক ‘মিকি পিয়ার্সন’ একজন মাদক সম্রাট। আমেরিকান হলেও পাপের সাম্রাজ্য গড়েছে লন্ডনে এসে। অনেকদিন ধরে জঙ্গলে একার আধিপত্য বিস্তারের পর, এখন চিন্তা করল, দায়িত্ব থেকে অবসর নেবে। তার গোটা মাদক ব্যবসা বিক্রি করে স্ত্রীর সাথে সবটুকু সময় কাটাতে চায়। আর এই ব্যবসা বিক্রির সিদ্ধান্তের শেকড় ধরেই ডালপালা গজিয়ে বিস্তৃত হতে থাকে গল্প এবং যোগ হতে থাকে অনেক চরিত্র। মাফিয়া সম্রাট মিকি তার গোটা ব্যবসা এক স্বদেশী কোটিপতির কাছেই বিক্রি করতে চায়। কিন্তু চীনা এক গ্যাংস্টার গোঁ ধরে বসে আছে, এই ব্যবসার খরিদ্দার সে নিজে হতে চায়।
এদিকে ট্যাবলয়েড সম্পাদক ‘বিগ ডেইভ’ মিকির পেছনে একজন গোয়েন্দা লেলিয়েছে কিছু গোপন তথ্য বার করে আনতে। ‘ফ্লেচার’ নামধারী সেই গোয়েন্দার নীতির স্কেল আবার টাকায় ওঠানামা করে। ওই স্বভাবের কারণেই সব তথ্য একাট্টা করে ফ্লেচার যায় মিকির ডানহাত রে’র কাছে। মিকি ও মাদক সাম্রাজ্য নিয়ে তার একাট্টাকৃত তথ্যের ভিত্তিতে একটা সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছে ফ্লেচার। সেই চিত্রনাট্য পড়ে শোনাতেই রে’র দোরগোড়ায় ভেড়ে ফ্লেচার। উদ্দেশ্য, দ্বিগুণ টাকা। ফ্লেচারের চিত্রনাট্যের সুতো ধরেই মূল গল্পে আরো যুক্ত হয় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত খুন, রাশিয়ান মাফিয়া এবং একজন বক্সার কোচ ও তার নবিশ দল।
আইরিশ এই কোচ মুখে বলে, সে গ্যাংস্টার নয়; কিন্তু গ্যাংস্টারের ভাবটা চলনে রয়েছে তার ষোল আনা। খোঁচা-খোঁচা রুক্ষ দাড়ির ভদ্রবেশী মাফিয়া সকলের কাটখোট্টা কথোপকথন এবং তাতে লুক্কায়িত গূঢ় রসবোধ, ক্ষণে ক্ষণে নতুন মোড় আর প্রতি মোড়ে-মোড়ে ওঁত পেতে থাকা উত্তেজনাপূর্ণ চমক নিয়ে ঘোড়ার বেগে ছুটতে থাকে দ্য জেন্টলম্যান।
দ্য জেন্টলম্যান তার জনরায় ভিন্ন কিংবা নতুন কিছু নয়। তেমন কিছু হতেও চায়নি। বরং চেনা সবকিছুকেই কিছুটা এদিক-ওদিক পাল্টে আর কড়া স্টাইলিশ ঢঙে বয়ান করেছে, দ্য জেন্টলম্যান। গাই রিচির ক্যারিয়ারের সর্বোত্তম অর্জন ‘লক স্টক অ্যান্ড টু স্মোকিং ব্যারেলস’ (১৯৯৮), ‘স্ন্যাচ’ (২০০০)- এর দলেই ভিড়েছে দ্য জেন্টলম্যান। ও দুটোর ধমনীতেই বেড়ে উঠেছে দ্য জেন্টলম্যান। সেই ভয়েসওভার ন্যারেশান, বাঁকানো এবং পরস্পরের সাথে সংযুক্ত অনেক গল্প ও চরিত্র, ফ্রিজ ফ্রেইমস, স্লো-মোশন শট, কুইক কাটস, ভরপুর অ্যাকশন যার অধিকাংশই হ্যান্ড-টু-হ্যান্ড কম্ব্যাট সেই সবকিছুরই সরব উপস্থিতি রয়েছে দ্য জেন্টলম্যানে। নব্বইয়ের রেট্রো ভাবটাও আছে প্রকট হয়ে।
দ্য জেন্টলম্যান তার পরিচিত গল্পকে স্বীয় ঢঙে নতুন করে বলতে গিয়ে সবচেয়ে বড় টেকনিকটা ব্যবহার করেছে, ‘স্ক্রিপ্ট উইদিন স্ক্রিপ্ট’ আকারে এই সিনেমার ন্যারেটিভ সাজিয়ে। তদন্তকারী প্রতিবেদক ফ্লেচার, মিকির গোটা আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে একটি চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। সেই চিত্রনাট্যের ঘটনাবলি ফ্লেচারের ন্যারেশানে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হলেও, দেখানোর পদ্ধতিটায় রিয়েল টাইমের একটা আবহ গাই রিচি তৈরি করেছেন। তাই মনে হয় যেন, বাস্তবে স্থান নিচ্ছে।
আবার বাস্তবের সেই চলমানতা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফ্লেচার আর রে’র আলাপনে আসে এবং সিনেমার দুনিয়া থেকে ফের গল্পে ছিটকে পড়ে। গল্প বয়ানের ধারাকে এভাবে আগুপিছু করে সাজিয়ে রিচি তৃতীয় অংকের বড় টুইস্টের ভিত্তি গড়ার পাশাপাশি জীর্ণ ভাবটাকে তুড়িতে উড়িয়ে গূঢ় সব রসবোধের জন্ম দিয়েছেন এবং গল্প ও চরিত্রের সাথে দর্শককেও সর্বদা শশব্যস্ত রেখেছেন।
রিচি, রহস্য ও নাটকীয়তার পাড় ধরে বুদ্ধিদীপ্ত বুননে বেঁধেছেন তার এই চিত্রনাট্যকে। সংলাপে গ্রিচিয়ান ভাবটা ছিল পরিপূর্ণ ভাবে। বলাই বাহুল্য, সংলাপ লিখতে গিয়ে রিচি নিজেও যথেষ্ট মজা পেয়েছেন। টেলিগ্রামাটিক ধাঁচের সংলাপ। শুধু তা-ই নয়, শেক্সপিয়রিয়ান ধাঁচের ইংরেজিও ধার করেছেন গাই রিচি। সাথে ভরপুর ককনি স্ল্যাং। চিত্রনাট্য মাঝে মাঝে একটু বেশিই চতুর হয়ে উঠেছে, তবে তা নিজের প্রয়োজনেই। ভনিতা ছাড়া বললে, ক্লিশেগুলোকে ঢাকতে। ‘হেনরি গোল্ডিং’-এর ‘ড্রাই আই’ চরিত্র এবং আরেকজন এশিয়ান অপরাধ সিন্ডিকেট প্রধানের চরিত্র, এই দুটি চরিত্রের চরিত্রায়ন গৎবাঁধা উপায়ে করা হয়েছে।
খানিকটা জাতিবৈষম্যের আঁচ এখানে পাওয়া যায়। কখনো স্পষ্ট, কখনোবা অস্পষ্ট আকারে লিঙ্গবৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের খোঁজও পাওয়া যায়। এই দিকগুলো কোনো কোনো দর্শকের মনে অস্বস্তি জাগাতে পারে, তবে গাই রিচির স্বভাব এমনই। ব্যক্তি গাই রিচির স্বভাবের প্রতিফলনই এখানে ঘটেছে।
এমন চতুর আর বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রনাট্যের শ্রী’তে ক্লিশেগুলো দাগ যুক্ত করলেও, অভিনেতা শিল্পীদের অভিনয় কটু হয়ে চোখে লাগতে দেয়নি সেটুকুকে। চরিত্রগুলো রূপায়ন করতে গিয়ে তারা নিজেরাও যে বেশ উপভোগ করেছেন, তা তাদের সংলাপ প্রদানের ভঙ্গিমায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘মিশেল ডকারি’র বলা, “দেয়ার’স ফাকারি অ্যাফুট” সংলাপটিই গোটা সিনেমার ছন্দ তৈরি করে দিয়েছে। সিনেমার প্রধান চরিত্র ক্যারিশমাটিক ‘ম্যাথিউ ম্যাককনাহে্’ হলেও গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করেছেন ‘হিউ গ্রান্ট’ এবং ‘চার্লি হানাম’। দুটি চরিত্রের মাঝে চমৎকার ইন্টারপ্লে ছিল।
এবং দুই অভিনেতাই সমান তালে চরিত্রকে নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। অভব্য, কিন্তু কৌতুকপূর্ণ ফ্লেচার চরিত্রে হিউ গ্রান্ট অনবদ্য। ওদিকে, রেয়মন্ড চরিত্রে হানামের অভিনয় শ্লাঘনীয়। শান্ত, ধীর কিন্তু সময়মতো ‘টু দ্য অ্যাকশন। ট্র্যাক-স্যুট পরিহিত বক্সিং কোচ ‘কলিন ফ্যারেল’-এর ভাবগাম্ভীর্য আলাদা জেল্লা যোগ করেছে সিনেমায়। রঙিন সব চরিত্রে ভরপুর দ্য জেন্টলম্যান, যেমনটি রিচির সিনেমায় সবসময় হয়ে এসেছে।
দ্য জেন্টলম্যান সময়ে সময়ে গাই রিচির ফিল্মমেকিং ক্যারিয়ারের সেই শুরুর সময়টার কথা মনে করায় এবং সেই যুবক রিচির সাথে বয়স পড়ে আসা এই রিচিকে স্বচ্ছ কাঁচের দুপাশে দাঁড় করায়। সিনেমায় মিকিকে উদ্দেশ করে ফ্লেচার বলে উঠে,
“মিকির বয়স হয়েছে। তাই এখন নরম আর ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে গিয়েছে।”
এই সংলাপ যেন গাই রিচি নিজেকে উদ্দেশ করেই লিখেছেন। দ্বিতীয় অংকে তেমন কিছুটা মনে হলেও, শেষ অংকে এসে রিচি নিজেই যেন আবার বলছেন, নরম কিছুটা হলেও ধারটা একেবারে হারায়নি। আগের বৃত্তে ঘুরঘুর করলেও গতি তার হারায়নি। কুইক কাট আর জাম্প-কাট সমৃদ্ধ সম্পাদনা রীতিতে উন্মত্ত সেই গতির প্রমাণ মেলে। কালার গ্রেডিংয়ে বরাবরের মতোই গাঢ় বাদামি আর সবুজের প্রলেপ তৈরি করে স্বকীয় এক কালার টোন প্রতিষ্ঠা করেছেন, রিচি। বাছাই করেছেন কানে অনুনাদ তোলার মতো আবহসঙ্গীত।
দ্য জেন্টলম্যান তার তুখোড় গতিতে দর্শককে বেঁধে নিয়ে যেতে যেতে, ‘লক স্টক অ্যান্ড টু স্মোকিং ব্যারেলস’ কিংবা ‘স্ন্যাচ’ দিয়ে গাই রিচিকে চেনা দর্শকের মাঝে স্মৃতিকাতরতাও জাগায়। সেই শক্তি আর স্মৃতিকাতরতায় ডুবে থাকার অভিজ্ঞতা মন্দ তো মোটেই নয়, বরং সমাপ্তিতে রেখে যাওয়া সিক্যুয়ালের আভাস এতক্ষণের উত্তেজনাকে আরো চাগিয়ে তোলে।