Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শেষ চিঠি: সন্তানহারা এক মায়ের আর্তনাদ

মা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ শব্দের নাম। “মা” বলে ডাকতে পারলেই মনের মধ্যে একটা শীতল হাওয়া বয়ে যায়। মনটা শান্ত হয়। মনের শক্তি বেড়ে যায়। মা-ই একমাত্র কোনোপ্রকার বাদানুবাদ ছাড়া সব সিদ্ধান্ত মেনে নেন। তিনিই সন্তানকে সবচেয়ে ভালো বোঝেন। মা নিজের সন্তানের জন্য নিজের প্রাণের মায়া পর্যন্ত করেন না। এমন উদাহরণ অনেক আছে পৃথিবীর বুকে। হুমায়ূন আহমেদের মা-ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই হুমায়ূন আহমেদকে হারিয়ে এই মা-ও ভীষণ মুষড়ে পড়েন। তারপর হাতে তুলে নেন কলম। অনেকটা স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে নিজের সন্তানের সাথে কথা বলেছেন এই লেখার মাধ্যমে।

এই লেখা বিষয়ে বইয়ের ভূমিকায় সুফিয়া হায়দার লিখেছেন,

আমাদের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পর আমাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সব সময় অস্থির থাকতেন। কী করলে একটু ভালো থাকবেন, আমরা ভেবে পেতাম না। হঠাৎ একদিন দেখি একটি ছোট রুলটানা খাতায় গুটি গুটি করে মা কী যেন লিখছেন। সবাই খুব অবাক হলাম। এ রকম মানসিক অবস্থায় মা কী লিখছেন? মাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “আমি তোদের দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলি।” মা লিখে লিখে তার আদরের ছেলের সাথে প্রতিদিন কথা বলতেন।

সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার তো কোনো সিলেবাস নেই যে তাকে কোনো একটা নিয়মে ফেলা যাবে। তাই এই বইয়ে মা একমনে লিখে চলেছেন নিজের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভবগুলো। আর সেটা করতে গিয়ে অনেক বিষয়ই একাধিকবার এসেছে। লেখার মধ্যে ধারাবাহিকতা নেই। সময়ের হিসাবও ঠিক নেই। অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়বস্তুর সাথে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা লিখেছেন। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়- একজন মা তার বুকের সবচেয়ে বড় ধন সন্তানকে হারিয়েও কারো প্রতি বিষোদগার করেননি। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়েছেন তার সন্তানের যত্ন নেয়ার জন্য। সন্তানকে অকৃত্রিম ভালোবাসা দেয়ার জন্য।

সন্তানদের সাথে আয়েশা ফয়েজ; Image Source: bd.toonsmag.com

এই বইয়ের প্রতিটি লাইনে প্রকাশ পেয়েছে একজন সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা। বই পড়তে পড়তে কখন যে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে পাঠক টেরই পাবেন না। আসলে আমাদের মায়েরা তো এমনই। বলা হয়, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ অনেক ভারি। মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যু যে কত বেশি কষ্টের তা এই বইয়ে প্রকাশ পেয়েছে। বইয়ের প্রথম লাইনটা এমন, “আমার এত আদরের বাচ্চাটি আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় গেলে?” সন্তানহারা মায়েরা যুগে যুগে ঠিক এভাবেই প্রশ্ন করে গেছেন, যদিও জানেন এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য তাদের সন্তানেরা আর ফিরে আসবে না। এরপর মা আবার লিখেছেন, “বাবা, তোমার কি একবারও মনে হয় নাই যে তোমার একটা দুঃখী মা আছে, একটা সুন্দর দেশ আছে, তোমার ভাই-বোনগুলো তোমার আশায় অপেক্ষা করছে। দেশের মানুষ তোমাকে কী-ই না ভালোবাসে।

সন্তানের সাথে মায়ের নাড়িছেঁড়া বন্ধন। তাই তো মা সন্তানকে ফিরে পেতে চান যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। এমনকি নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও চান যেন সন্তান নতুন জীবন পায়। বইয়ের ভাষায়,

বাবা, মৃত্যুর জন্য কতকাল থেকে আমি অপেক্ষা করে আছি। … আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যত খতম আছে সব পড়েছি। প্রথম দিন থেকে ছদকা দিয়েছি। ছাগল দিয়েছি, গরু দিয়েছি, মুরগি তো প্রায়ই দিতাম। সাতটা সুস্থ-সবল মুরগি দিয়েছি একসাথে। শুনেছি, একসাথে সাতটা সদকা দিলে আল্লাহ দয়া করেন। … তোমার যখন অপারেশন হচ্ছে, তখন আমি এক বৈঠকে ১০৪ রাকাত নামাজ আদায় করেছি।

সন্তানের অন্তিম সময়ে মা ঠিকই টের পেয়ে যান যে তার সন্তানের অমঙ্গল হতে চলেছে। বইয়ের ভাষায়,

একদিকে মা, অন্যদিকে ছেলে, মাঝখানে একটা পৃথিবী, এর থেকে বড় কষ্ট বুঝি আর কিছু নাই। … কিন্তু যেদিন তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে সেদিন দেখি আমি কিছুতেই শান্তি পাই না। … আমার জ্ঞান আছে, আমি বুঝতে পারছি, বাবা, এই হচ্ছে তোমার চিরবিদায়।

সন্তানের মৃত্যুর পর মায়ের মনে অনেক ধরনের চিন্তার উদ্রেক ঘটেছে। কখনও মনে হয়েছে, আমার আদরের সন্তান কি আমার উপর রাগ করেছিল? আবার কখনও ফুটে উঠেছে সন্তানের শেষ সময়ে তার পাশে না থাকার আক্ষেপ। মায়ের ভাষায়,

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, বাবা, তুমি কি আমার উপর রাগ করে গিয়েছ? তোমাকে একবারও স্বপ্নে দেখি না কেন? আমি যদি তোমার ওপর কোনো অন্যায় করে থাকি সেটা না জেনে করেছি। না বুঝে করেছি। তুমি আমার উপর রাগ করে থেকো না বাবা। … আমি বেঁচে থেকেও আমার অসুস্থ ছেলেটিকে গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম না। কী খায় দেখলাম না। কেমো নিয়ে অসুস্থ শরীরে কীভাবে চলাফেরা করে, কিছুই দেখলাম না।

সন্তান হারানোর পর মায়ের মনে কত শত সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়। মনে হয়, এটা করলে হয়তো তার সন্তান বেঁচে থাকতো। সেটা করলে হয়তো তার সন্তান সুস্থ হয়ে উঠত। ছোটবেলায় একবার হুমায়ূন আহমেদ শখ করে রোজা রেখেছিলেন। কিন্তু বেলা তিনটার দিয়ে তার খিদে পেয়ে গেল। তখন মায়ের কাছে এসে বললেন, আপনি আমাকে কেন রোজা রাখতে দিলেন? তার উত্তরে মা বলেছিলেন, তুমিই তো রোজা রাখতে চাইলে! উত্তর ছেলে বলেছিল, আমি চাইলেই আপনি রাখতে দিবেন কেন? ছেলের চিকিৎসা নিয়েও তাই মায়ের মনে প্রশ্ন উঠেছিল। মায়ের ভাষায়,

আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, চিকিৎসার জন্যে ঢাকা ছিল, সিঙ্গাপুর ছিল, অথচ তুমি গেলে আমেরিকায়। আমি কেন তোমাকে যেতে দিলাম? তুমি কি সেই ছোটবেলার মতো আমাকে বলতে চেয়েছিলে, আমি নাহয় যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি কেন আমাকে যেতে দিলেন?

একই ফ্রেমে সকল ভাই-বোন পরিবেষ্টিত হুমায়ূন আহমেদ; Image courtesy: আহসান হাবিব

সন্তান মারা যাবার পর মায়ের মনের পর্দায় বার বার ভেসে উঠছে সন্তানের জন্ম থেকে পুরো জীবনের ছবি। মা আয়েশা ফয়েজের ভাষায়,

তোমার জন্মের পর একটা খুশির বন্যায় ভেসে গেছি। আমাদের পূর্বপুরুষের আমলে যত মালী, তেলী, ধোপা, নাপিত থাকত পরিবারে কোনো সন্তান হলে তারা এসে নাচ-গান করে বকশিশ নিত। তোমার জন্মের সময়ও তা-ই হলো।

প্রয়াত সন্তানের সকল স্মৃতি মায়ের মনে উঁকি দিয়েছে একে একে,

তোমার বাবার সাথে তোমার বিচিত্র স্বভাবের কথা নিয়ে আলাপ করতাম। বলতাম, “তোমার ছেলেটা সারাদিন কোথায় কোথায় ঘোরে?” তোমার বাবা বলত, জানো প্রমথনাথ বিশীও এমন করে ঘুরে বেড়াত, বিখ্যাত একজন লেখক। তোমার ছেলে নিশ্চয় বিখ্যাত লেখক হবে।

সন্তানদের সাথে মা আয়েশা ফয়েজ; Image Courtesy: আহসান হাবিব

সন্তানের মৃত্যুর পরও মা চেয়েছিলেন সন্তানের কাছাকাছি থাকতে। তাই কল্পনা করেছিলেন তার আদরের সন্তান হুমায়ূনের কবরটা কেমন হতে পারে,

সম্রাট হুমায়ূনের কবর কেমন হবে সেটা কল্পনা করার ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু আমার হুমায়ূনের সমাধিটা কেমন হবে সেরকম একটা কল্পনা আমার ছিল। সমান মাটির মাঝে কবরটা একটুখানি উঁচু, আর পুরো জায়গাটা সবুজ ঘাস দিয়ে গালিচার মতো ঢাকা। আমি কাছে বসে কবরটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বসে থাকতাম আর বলতাম, আমার বাবাটা ঘুমিয়ে আছে। আমার আদরের মানিক শান্ত হয়ে শুয়ে আছে।

সন্তান মারা যাওয়ার পরও মা মনে মনে সেটা মেনে নিতে পারেননি। তার মনে হয়েছে, ছেলে তার আঁচলের ছায়াতলেই আছে। তার ভাষায়,

তোমার শেষ কবিতায় তুমি লিখেছিলে লিলুয়া হাওয়া নাচে-কবিতার শেষ লাইনটা লেখার জন্যে কাগজ নেই, তুমি ছটফট করছ। আমি আমার সাদা শাড়ির আঁচলটা বিছায়ে দিলাম, তুমি সেখানে লিখে রাখলে।

একই ফ্রেমে হুমায়ূন আহমেদ, আহসান হাবিব, এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল; Image source: Bangla Tribune

 

সন্তান ছাড়া মায়ের বেঁচে থাকা সত্যিই অনেক কষ্টের। এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় সেই বিষাদের ছায়াও আছে। বইটি শেষ করা হয়েছে এভাবে,

এখন আমি লিখতে বসেছি। লিখে যাচ্ছি, শুধু তোমাকে লিখে যাচ্ছি। আহা রে! যদি এটা সত্যি হতো আসলেই তোমাকে আমি লিখতে পারতাম, তাহলে এই পৃথিবীতে আমার তো এর চাইতে বড় কিছু চাওয়ার ছিলো না। আহা! কেন এটা সত্যি হয় না?

আর বইয়ের শেষ লাইনটা পড়লে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। একটা লাইন দিয়ে সন্তানহারা মায়ের দুঃখের বোঝা কত ভারী সেটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, “বেঁচে থাকা বড় কষ্ট বাবা। বড় কষ্ট।”

Language: Bangla

Topic: Book review of 'Shesh Chithi' by Ayesha Foyez

Related Articles