তুমি কে?
পৃথিবী কোথা থেকে এল?
এই দুটো প্রশ্ন বদলে দিয়েছিল এক কিশোরীর জানা জগৎ, চেনা পরিবেশ। এর মাধ্যমেই সে অচেনাকে চিনেছিল, অজানাকে জেনেছিল আর চেনাজানা জগৎটাকে নতুনভাবে পেয়েছিল। এলিস অ্যান্ড দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ডের এলিসের কথা মনে আছে? হঠাৎ করেই সে এক অন্য জগতে চলে গিয়েছিল। সে জগতে যাবার পরে, তার জীবন কিন্তু বদলে গিয়েছিল। সেই এলিস আর আমাদের এই গল্পের সোফির জীবনে কোনো মিল নেই, আবার আছেও।
সোফি অ্যামুন্ডসেন। কিশোরী এই মেয়ের জীবন স্কুল আর বন্ধু জোয়ানাকে নিয়েই চলছে। সেদিন ওরা রোবট নিয়ে কথা বলছিল। একসময় গিয়ে দু’বান্ধবীর পথ দুদিকে গেল। বাসায় ফিরে এসে সোফি তাদের মেইলবক্স চেক করল। সবসময় সেখানে বাবা আর মায়ের নামে চিঠি থাকে। কিন্তু সেদিন ঘটল এক অন্য ঘটনা। একটা চিঠি এলো। এক লাইনে লেখা অদ্ভুত সেই চিঠি। ঠিকানা সোফি অ্যামুন্ডসন, ৩ ক্লোজার ক্লোজ। সোফির নামে চিঠি? অদ্ভুত না? কে লিখবে তাকে চিঠি? আবার সেই চিঠিতে মাত্র একটা লাইন লেখা। “কে তুমি?” সোফির কোনো ধারণা নেই। আমাদেরও নেই। কে আমি, বা আমরা? তাহলে এর উত্তর কীভাবে দেব আমরা? উত্তর সোফি অনেক ভেবে বের করল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জবাব দিল, “আমি হচ্ছি তুমি, তুমি হচ্ছো আমি”।
ঠিক এই চিঠিই বদলে দিল সোফির জীবন। মৃত্যু, পরপারের জগৎ, হারিয়ে ফেলা মানুষ- সবকিছু নিয়ে ভাবতে শুরু করল। এরপর একে একে আসতে লাগল আরো চিঠি। অদ্ভুত কিছু শব্দ, অর্থহীন কিছু কথার মিশেল। ছোট্ট সোফি সবকিছু নিয়ে ভাবার জন্য নিজের গোপন আস্তানায় গেল।
একদিন হিন্ডা নামে এক মেয়ের ১,৫০০তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা এলো সেই ঠিকানায়। সেখানে বলা হয়েছে, প্রেরক দুঃখিত, কারণ সোফির নামে সে চিঠি দিয়েছে। সোফির মতো আমরাও অন্ধকারে। কে এই দেড় হাজারবর্ষীয়া? তাকে কেন এরকম এক অদ্ভুত চিঠি লিখল তার বাবা? আতিপাতি করে খুঁজেও হিন্ডা মোলার ন্যাগকে খুঁজে পেল না সোফি। এখন কী হবে? কীভাবে তার কাছে পৌঁছে দেবে?
এরপরে সে এক অদ্ভুত উপহার পেল। তার নামে সেই বিশেষ কেউ রেখে গেছে দর্শন বিষয়ের কোর্স। একদিকে তাকে এই কোর্স সম্পন্ন করতে হবে, অন্যদিকে খুঁজতে হবে হিন্ডাকে। সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন গুবলেট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে একসময় জোয়ানাকে সে জানায় সবকিছু।
পরবর্তীতে তার সাথে পরিচয় হয় অ্যালবার্টো নক্স নামের এক রহস্যময় ব্যক্তির। হাওয়া থেকে এসে, সে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কিশোরী সোফির সাথে একে একে পরিচয় হয় প্লেটো, সক্রেটিস, গ্যালিলিও, জানা অজানা কত মানুষের। কিন্তু তারা কেন এসেছে? কীভাবে এসেছে? আর সোফিকে কী বলে গেল? নক্স আর তার অদ্ভুত কুকুর কেন সোফিকে বেছে নিল? হিন্ডা এবং তার বাবার যোগাযোগের মাধ্যম কেবল সোফি। কিন্তু কেন? জোয়ানাকে বলার পর, সে-ও যুক্ত হলো হিন্ডাকে খুঁজে বের করতে। কিন্তু মানুষকে খুঁজে বের করা কি দর্শনতত্ত্বের মধ্যে পড়ে? যদি না হয়, তাহলে কেউ কেন সোফিকে দর্শনের নাড়িনক্ষত্র শেখাতে উঠেপড়ে লেগেছে?
শেষমেশ কী হবে? হিন্ডা কি ধরা দেবে সোফি আর জোয়ানার কাছে? নাকি হারিয়ে যাবে? হঠাৎ করে বদলে যাওয়া এই জগৎ, সোফির জন্য নতুন এক জগৎ। ঠিক যেমন ঘটেছিল, এলিসের জীবনে।
বইটা নিয়ে শুরু করার আগে আগ্রহী পাঠকের জন্য ছোট একটা কথা, যদি একে টার্ন টুইস্ট মেশানো থ্রিলার ভাবতে চান, ভাবতে পারেন, যদি খটমটে প্রবন্ধ ভাবতে চান, সেটাও পারেন। যেকোনো ক্যাটাগরিতে ফেলতে পারেন। তবে হ্যাঁ, এ গল্পে ভিলেন নেই, খুন নেই, তথাকথিত রোমান্টিকতা নেই। যা আছে, তা আনন্দ। মনের খোরাক, মস্তিষ্কের খোরাক।
আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন ঘোরে, যার ব্যাখ্যা আমরা সহজে পাই না। এই বইতে লেখক অনেক সুন্দর করে সেসব কিছু ব্যাখ্যা করেছেন। কখনও নিজে, কখনও নক্স হয়ে কিংবা সেই সন্ন্যাসীরূপে। কখনো বা তিনিই হয়ে উঠেছেন গ্যালিলিও কিংবা প্লেটো। বইটা পড়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে। আচ্ছা বলুন তো, দর্শন তত্ত্বের সাথে কি বিজ্ঞানের কোনো মিল থাকতে পারে?
দর্শনতত্ত্বের প্রায় জন্ম থেকে বই লেখার আগপর্যন্ত পুরো ইতিহাস এই ৪০০ পৃষ্ঠার মধ্যে লেখক আবদ্ধ করেছেন। দর্শন শাস্ত্র নিয়ে আমাদের কিন্তু অনেকের অনেক ভয় থাকে, প্রচুর লোকে নাক সিঁটকান এ নাম শুনলে। কিন্তু এ শাস্ত্রের একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে। লেখক এত সুন্দর করে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সেটা অবাক করার মতো। মোটামুটি আকারের এই বইয়ের মধ্যে এত অসাধারণ তথ্য খুব কম মেলে। জীবনে চলার পথে আমরা অনেক সময় ভেঙে পড়ি, কূল পাই না, দিশা হারিয়ে ফেলি। বইটিতে লেখক বারবার বোঝাতে চেয়েছেন, হাল ছাড়া উচিত নয়। সে কাউকে খুঁজে বের করা হোক, মাঝ নদীতে নৌকা চালানো হোক, অথবা বিস্কুট বানানোর মতো ছোট কাজই হোক না কেন।
যে পথে আমরা নামব, সে পথের শেষে কী আছে, তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে নক্স সোফির জীবন বদলে দিয়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি বদলে দেবে আমাদের জীবন। বইটা একেক বয়সের মানুষের কাছে একেক রকম। আপনি যদি বিনোদনের জন্য পড়েন, সেটা পাবেন। আবার জানার জন্য, শেখার জন্য পড়তে চাইলে, সেটাও পারবেন।
মূলত কিশোর-কিশোরীদের দর্শনতত্ত্ব সম্পর্কে জানাতে বইটি লিখেছিলেন ইয়স্তেন গার্ডার। কিন্তু এ বই যে ছেলেবুড়ো সবার কাজে লাগবে, তা কি তিনি জানতেন? জি এইচ হাবীব অত্যন্ত নিপুণতার সাথে অনুবাদ করেছেন বইটি। নরওয়েজিয়ান বইয়ের সেই বাংলা অনুবাদ পড়ে মনে হয় না এটা অন্য কোনো ভাষার বই।
কিছু বই আছে, মনে দাগ কেটে যায়। এই বই সেরকম, এই বইয়ের ত্রুটি ধরা আমাদের মতো ছোটখাট মানুষের পক্ষে সম্ভব না। বইটা পড়ার সময় মাথায় রাখবেন, এটা কিন্তু পরীক্ষা দিতে যাবার জন্য কোনো প্রস্তুতিমূলক বই না, নিজের মাথার খাবার হিসেবে পড়বেন।
তবে পড়তে গিয়ে কিছুটা একঘেয়েমি লাগতে পারে অনেকক্ষেত্রে। দর্শনের কঠিন কঠিন কথা আছে ঠাসা আছে এতে। তবে ঠাণ্ডা মাথায়, সময় নিয়ে পড়তে হবে। প্রথমদিকে অনেককিছু বুঝতে অসুবিধা হয় অনেকের, কিন্তু আস্তে আস্তে একবার বোঝা শুরু করলে কখন যে শেষ হয়ে যাবে, সেটা বোঝাই কঠিন হয়ে যাবে। তবে শেষদিকে এত বড় একটা চমক অপেক্ষা করছে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। সেই চমক বইয়ের সৌন্দর্য আরো অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
হবে নাকি অ্যারিস্টটটল, প্লেটো অথবা সোফির সাথে একটা রোলার কোস্টার রাইড?
বই: সোফির জগৎ
লেখক: ইয়স্তেন গার্ডার
অনুবাদক: জি এইচ হাবীব
ধরন: দার্শনিক উপন্যাস
প্রকাশক: সংহতি