১৯৯৬ সালে মুক্তি পাওয়া ফার্গো (Fargo) চলচ্চিত্রটি। কোয়েন ভ্রাতৃদ্বয় নির্মিত শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি। ব্ল্যাক কমেডি জঁনরার চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে এটাকে অন্যতম সেরা ক্লাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে অস্কারসহ সিনেমাটি দেশে-বিদেশে প্রচুর পুরস্কারও পেয়েছে। কিন্তু এত খ্যাতি, এত সম্মাননার পাশাপাশি সিনেমাটির একটি নেতিবাচক রেকর্ডও আছে। এটি দর্শকদের সাথে বেশ বড় ধরনের প্রতারণা করেছিল।
১৯৯৬ সালে সিনেমাটি যখন মুক্তি পায়, তখন সবাই ভেবেছিল এটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। কারণ সিনেমার শুরুতেই দর্শকদের সামনে স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল নিচের লেখাগুলো:
এটি একটি সত্য কাহিনী। সিনেমাতে প্রদর্শিত ঘটনাগুলো ১৯৮৭ সালে মিনাসোটায় ঘটেছিল। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের অনুরোধে তাদের নামগুলো পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। আর মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বাকি ঘটনা হুবহু যেভাবে ঘটেছিল, সেভাবেই দেখানো হয়েছে। (This is a true story. The events depicted in this film took place in Minnesota in 1987. At the request of the survivors, the names have been changed. Out of respect for the dead, the rest has been told exactly as it occurred.)
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই দাবি মোটেও সত্য ছিল না। ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত’ দাবি করা সিনেমাগুলো যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হু্বহু সত্য হয় না, সেটা এর আগে একটি লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কিন্তু ঐ আলোচনায় আমরা এটাও দেখেছি, ‘বেজড অন অ্যা ট্রু স্টোরি’ দাবি করা চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনী সাধারণত অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি হয়। অন্যদিকে যেসব সিমেনের কাহিনী বাস্তবের চেয়ে অনেক ভিন্ন হয়, সেসব ক্ষেত্রে সাধারণত ‘বেজড অন ট্রু ইভেন্টস’ বা ‘ইনস্পায়ার্ড বাই এ ট্রু স্টোরি’ ব্যবহার করা হয়।
ফার্গো সিনেমার শুরুতে নির্মাতারা ‘ইনস্পায়ার্ড বাই’ বা ‘বেজড অন’ ব্যবহার না করে সরাসরি দাবি করেছেন, ‘দিস ইজ এ ট্রু স্টোরি’। স্থান, কাল,পাত্র উল্লেখ করে এখানে তারা যেভাবে সত্যতার দাবি তুলেছেন, তাতে দর্শকদের কাছে মনে হতে পারে, ঘটনাটা প্রায় হুবহু এভাবেই ঘটেছিল। কিন্তু আসলে কি তাই? আসলেই কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনাসোটায় ১৯৮৭ সালে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল?
১৯৯৬ সালে যখন ফার্গো সিনেমাটি মুক্তি পায়, তখন ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না। ফলে এই দাবির সত্যতা তলিয়ে দেখার মতো উৎসাহী দর্শকও তখন খুব বেশি ছিল না। নির্মাতাদের দাবিকেই দর্শকরা সরলমনে বিশ্বাস করেছিল। তাছাড়া পরিচালক কোয়েন ভ্রাতৃদ্বয়ও প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত বারবার দাবি করছিলেন, সিনেমাটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ১৯৯৬ সালের মার্চে এক সাক্ষাৎকারে জোয়েল কোয়েন দাবি করেন, তারা চেষ্টা করেছেন সত্য ঘটনা অবলম্বনে কিছু একটা তৈরি করতে এবং তাদের স্ক্রিপ্টটি সত্য ঘটনার খুবই কাছাকাছি।
কিন্তু পরবর্তীতে যখন ফার্গোর চিত্রনাট্য প্রকাশিত হয়, তখন তার ভূমিকায় কোয়েন ভ্রাতৃদ্বয় জানান, তাদের সিনেমাটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হওয়ার ‘ভান করেছিল’। ফার্গো সিনেমাটি যদি কেউ একেবারে শেষপর্যন্ত দেখে থাকে, তার জন্য অবশ্য এটা নতুন কোনো তথ্য হওয়ার কথা ছিল না। কারণ শুরুতে সত্যতার দাবি করা হলেও সিনেমার একেবারে শেষে, সকল অভিনয়শিল্পী এবং কলাকুশলীর নাম দেখানোর পরে ঠিকই ছোট ফন্টে নিচের কথাগুলো লেখা ছিল:
এই চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত প্রতিটি ব্যক্তি এবং ঘটনা কাল্পনিক। জীবিত অথবা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনো মিল পাওয়া গেলে তা অনভিপ্রেত এবং কষ্টকল্পিত। (The persons and events portrayed in this production are fictious. No similarity to actual persons, living or dead, is intended or should be inferred.)
তবে কোয়েন ভ্রাতৃদ্বয়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তি আসার পূর্ব পর্যন্ত অনেকেই ফার্গোর পেছনের মূল ঘটনা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। অনেকের ধারণা ছিল, ফার্গোর কাহিনীর পেছনে যে ঘটনাটি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল, সেটি ছিল টি. ইউজিন থম্পসন নামে মিনাসোটার সেইন্ট পলের এক আইনজীবী দ্বারা ১৯৬৩ সালে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের কাহিনী।
সিনেমার কাহিনীর মতোই থম্পসনও তার স্ত্রীকে হত্যা করার জন্য এক অপরাধীকে ভাড়া করেছিলেন। এবং ঘটনাটি ঘটেছিল কোয়েন ভ্রাতৃদ্বয় ছোটকালে যে শহরে বড় হয়েছিলেন, তার পাশের একটা শহরেই। কিন্তু ২০১৫ সালে থম্পসনের মৃত্যুর পর জোয়েল কোয়েন দাবি করেন, তিনি আগে কখনো থম্পসনের নামও শোনেননি। এবং সেই সাথে তিনি এটাও দাবি করেন, তাদের সিনেমাটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তার ভাষায়, সিনেমাটির ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত গল্প’ দাবির মধ্যে কেবলমাত্র একটাই সত্যতা ছিল। সেটি হচ্ছে, এটি ছিল একটি গল্প।
২০১৬ সালে ইথান কোয়েন পুনরায় তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, “আমরা শুধুমাত্র এমন একটা সিনেমা তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যেটি ‘সত্য ঘটনা’ জঁনরার মধ্যে পড়বে।” তার ভাষায়, সত্য ঘটনা অবলম্বনে সিনেমা বানানোর জন্য সত্য ঘটনার প্রয়োজন হয় না।
খুব কম সিনেমার কাহিনীই অবশ্য পুরোপুরি কল্পনানির্ভর হয়। অধিকাংশ সিনেমারই কোনো না কোনো দৃশ্য বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত হয়। কোয়েন ভ্রাতৃদ্বয়ও তাই সবসময় তাদের এই ‘সম্পূর্ণ কাল্পনিক’ দাবিতে অনড় ছিলেন না। ২০১৬ সালে হাফিংটন পোস্ট পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে জোয়েল কোয়েন দাবি করেন, ফার্গোর সিনেমাটিতে দুটি ঘটনা আছে, যেগুলো সত্য ঘটনা অবলম্বনে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
এরমধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ষাট বা সত্তরের দশকের একটি ঘটনা, যেখানে ফ্রান্সের জেনারেল মোটরস কোম্পানির এক কর্মচারী গাড়ির সিরিয়াল নাম্বার পাল্টে কোম্পানীর সাথে প্রতারণা করছিল, যেটা আমরা ফার্গো সিনেমাতে প্রধান চরিত্র জেরিকে করতে দেখি। কিন্তু সিনেমার মতো মূল ঘটনায় কোনো অপহরণ ছিল না, বা কোনো হত্যাকাণ্ড ছিল না। শুধু গাড়ির প্রতারণার দৃশ্যটাই সিনেমার জন্য নেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি বেশ আলোচিত। উডচিপর মার্ডার নামে পরিচিত ঐ ঘটনায় হেলি ক্র্যাফটস নামে এক নারী তার স্বামী রিচার্ড ক্র্যাফটসের উপর তদন্ত করার জন্য প্রাইভেট গোয়েন্দা নিয়োগ করেছিলেন। কারণ তার ধারণা ছিল, তার স্বামী তার সাথে প্রতারণা করে অন্য কোনো নারীর সাথে পরকীয়া করছিলেন। এর কিছুদিন পরেই যখন হেলি ক্র্যাফটস নিখোঁজ হয়ে যান, তখন ঐ গোয়েন্দা পুলিশের সহায়তায় তদন্ত শুরু করে।
পরবর্তীতে জানা যায়, হেলির স্বামী রিচার্ড তাকে ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করে তাকে হত্যা করেছিলেন। এরপর তার লাশ গুম করার জন্য প্রথমে তাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। সবশেষে তিনি করাত দিয়ে হেলির লাশ টুকরো টুকরো করে কেটে, টুকরোগুলোকে একটি কাঠ চেরার যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে সেগুলো গুঁড়ো করে ফেলেছিলেন।
এই ঘটনার সাথেও অবশ্য ফার্গোর খুব বেশি মিল নেই। ফার্গোতে দেখানো হয়, এক গাড়ির দোকানের সেলস ম্যানেজার দুই ছিঁচকে অপরাধীকে ভাড়া করে তার স্ত্রীকে অপহরণ করার জন্য, যেন ধনী শ্বশুরের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে সেই টাকা ভাগাভাগি করে নিজের আর্থিক সংকট মেটাতে পারে। মূল ঘটনাটির সাথে ফার্গোর শুধু একটা জায়গাতেই মিল ছিল। সেটি হলো, ফার্গোতেও সিনেমার শেষে একটি লাশকে কাঠ চেরার যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে গুঁড়ো করার দৃশ্য দেখানো হয়।
হেলি ক্র্যাফটসের এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮৬ সালে, মিনাসোটায়, অনেকটা সিনেমার শুরুতে করা দাবির মতোই। কিন্তু জোয়েল কোয়েনের নিজের ভাষাতেই, উডচিপারের দৃশ্যটির বাইরে সিনেমার বাকি কাহিনী সম্পূর্ণ বানোয়াট। বাস্তবের কোনো ঘটনার সাথে এর আর কোনো মিল নেই।
ফার্গো সিনেমাটির মুক্তির ১৮ বছর পর একই কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এফএক্স টেলিভিশনের জন্য একই নামের একটি টিভি ধারাবাহিক নির্মিত হয়। এখন পর্যন্ত প্রচারিত এর তিনটি সিজনের প্রতিটি পর্বের শুরুতেই মূল ফার্গোর মতো একই স্টাইলে দাবি করা হয়, ধারাবাহিকটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। কিন্তু এর নির্মাতা নোয়া হলি নিজেই স্বীকার করেছেন, এর প্রতিটি সিজনের কাহিনীই সম্পূর্ণ বানোয়াট। শুধু মূল ফার্গোর স্টাইল ধরে রাখার জন্যই তারা ধারাবাহিকটিতে সত্য ঘটনার দাবি করেছেন।
এখন ১৯৯৬ সালের ফার্গোকে কি ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ নির্মিত চলচ্চিত্র বলা যায়? উত্তর হবে, হ্যাঁ এবং না। কারণ ঠিক কতটুকু সত্য হলে সেটাকে সত্য ঘটনা অবলম্বনে দাবি করা যাবে, তার কোনো পরিষ্কার আইনি ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু তারপরেও ফার্গোতে যেভাবে শুধু ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ না, একেবারে ‘দিস ইজ এ ট্রু স্টোরি’ দাবি করা হয়েছে, তাকে পরিষ্কারভাবেই দর্শকদের সাথে একধরনের প্রতারণা হিসেবে অভিযুক্ত করা যায়।
কিন্তু ফার্গো চলচ্চিত্রটি দর্শকদের কাছে যে পরিমাণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যুগ যুগ ধরে যে পরিমাণ সিনেমাকে প্রভাবিত করেছে, ব্ল্যাক-কমেডির ক্ষেত্রে যে নতুন মান নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার সাথে তুলনা করলে এই প্রতারণাটুকুকে খুব বড় কোনো অন্যায় বলে মনে হয় না।