
সারা পৃথিবী যখন চার দেয়ালের মাঝে বন্দী, মাসের পর মাস কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষেরা যখন একঘেয়ে; তখন মনে পড়ে ম্যাক্স এগার্সের চিত্রনাট্যে রবার্ট এগার্সের পরিচালিত দ্য লাইটহাউজ সিনেমার কথা। যেখানে লাইটহাউজের কিপার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত দুজনের মধ্যে একজন বয়স্ক অভিজ্ঞ লাইটহাউজ কিপার থমাস ওয়েক এবং আরেকজন এক মধ্যবয়স্ক প্রাক্তন করাতী ইফ্রেইম উইন্সলো (যার আরেক নাম থমাস হাওয়ার্ড)। চার সপ্তাহ কাজের উদ্দেশ্যে লাইটহাউজে কাটানোর কথা থাকলেও হঠাৎ প্রচন্ড ঝড়ের কারণে বাড়ি ফেরত যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে দুজনের। এদিকে যথেষ্ট খাবারের মজুদও নেই। মানসিক স্বাভাবিকতা ধরে রাখা হয়ে পড়ে কষ্টসাধ্য।

এই সিনেমার সব রহস্যের সূত্র হলো এর শিরোনামের ‘লাইটহাউজ’ শব্দটি, বিশেষভাবে এর লাইট বা আলো। ২০১৯ সালে থিয়েটারে মুক্তির আগেই প্রচারণার ঝড় ওঠে রবার্ট এগার্সের ‘দ্য লাইটহাউজ’ নিয়ে। নিয়ো-নোয়াহ প্যালেটে A24 স্টুডিওর নতুন সিনেমাটি দেখতে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছেন অনেকেই। ফিল্মের মূল আকর্ষণ ছিলো অভিনেতারা; অভিনয় করেছেন উইলিয়াম ড্যাফো এবং রবার্ট প্যাটিনসন। শুধুমাত্র এই দুই জনপ্রিয় অভিনেতাকে কেন্দ্র করেই দ্য লাইটহাউজ তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে ফিল্মটি বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করতে না পারলেও সমালোচকদের মাঝে এর জয়-জয়কার অবস্থা।
এই বিষয়টি নিয়ে রবার্ট এগার্সের মন্তব্য,
“দ্য লাইটহাউজে রহস্যের উত্তর পাওয়ার চেয়ে দর্শকের মনে আরো বেশি প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। আমি জানি অনেকেই এতে সন্তুষ্টি পাবে না, কিন্তু আমি এভাবেই সিনেমাটি তৈরি করতে চেয়েছি।”
দ্য লাইটহাউজ সিনেমা-ভক্তদের মন জয় করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডিরেক্টর রবার্ট এগার্সের গভীর রিসার্চ, রেফারেন্সের ব্যবহার এবং সিম্বোলিজম। এমনই এক রেফারেন্স ধরা যায় সিনেমাটিতে গ্রীক মিথোলজির প্রটিয়াস আর প্রমিথিউসের কাহিনীর সামঞ্জস্যতাকে। গ্রীক মিথে প্রটিয়াস আর প্রমিথিয়াসকে কখনো একসাথে দেখা না গেলেও, দ্য লাইটহাউজে যেনো এগার্স এই দুই চরিত্রকে একই কাহিনীসূত্রে তুলে এনেছেন। এবং সেটিই আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয়।
প্রটিয়াস
গ্রীক মিথে প্রটিয়াস হলো এক পুরোনো সমুদ্রদেবতা; সম্পর্কে পসেইডনের পুত্র এবং ট্রাইটনের ভাই। কেউ কেউ তাকে পসেইডনে শিষ্য বলেও অবিহিত করেন। জ্ঞানের আধার প্রটিয়াস, যার আরেক নাম দ্য ওল্ড ম্যান অফ দ্য সী – সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক জীবন্ত অরাকল! অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবই বলে দিতে পারেন প্রটিয়াস, কিন্তু তাকে সমুদ্র থেকে পাকড়াও করা দুঃসাধ্য। নিজের প্রসিদ্ধ বিজ্ঞতাকে সবার থেকে আড়াল করে নিরাপদে রাখাই ছিলো প্রটিয়াসের প্রধান দায়িত্ব।
এই প্রটিয়াসের মিল পাওয়া যায় ফিল্মের উইলিয়াম ড্যাফো’র চরিত্র থমাস ওয়েকের সাথে। সমুদ্র বিষয়ে বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ থমাসের অহংকার এত বেশি যে, সে সর্বদা ইফ্রেইমের (রবার্ট প্যাটিনসন) সাথে দুর্ব্যবহার করে।

সিনেমার একপর্যায়ে ইফ্রেইমের উপর নিরাশ হয়ে ওয়েক এই প্রটিয়াস রেফারেন্সের স্বীকৃতি দিয়ে গর্জন করে বলেন,
“Hark Triton, hark! Bellow, bid our father the Sea King rise from the depths full foul in his fury!”
আবার, লাইটহাউজের কাজ সমানভাবে ভাগ করে নেওয়ার কথা থাকলেও, ওয়েক নিজের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তিনি জানিয়ে দেন, শুধুমাত্র তিনিই লাইটহাউজের খেয়াল রাখবেন এবং ইফ্রেইমকে রান্না ও ঘর পরিষ্কারের কাজের দায়িত্ব দেন। এই লাইটহাউজই যেন প্রটিয়াসের সেই অসীম জ্ঞানের প্রতিকৃতি, যাকে নির্বিঘ্নে রাখতে সদা সতর্ক থমাস ওয়েক। এমনকি ইফ্রেইম কখনো লাইটের কাছে যাওয়ারও অনুমতি পাননি। লাইটহাউজের আলোকে জ্ঞানের আলোর সিম্বোলিজম হিসেবে দেখিয়েছেন সিনেমার নির্মাতা।
প্রমিথিউস
গ্রীক মিথ অনুযায়ী, মানবসভ্যতা গড়ে উঠার সময় জিউসের নির্দেশে টাইটান এপিমিথিয়াস তৈরি করে পশু-পাখি, আর তার ভাই টাইটান প্রমিথিউস তৈরি করে মানুষ। কৌতূহলবশত জিউসকে অবজ্ঞা করায় শাস্তিস্বরূপ গ্রীক দেবতা জিউস প্রমিথিউসের সৃষ্ট মানবসভ্যতা থেকে আগুন কেড়ে নেন। নিজের সৃষ্টির এই দুরবস্থা মেনে না নিতে পেরে প্রমিথিউস মাউন্ট অলিম্পাস থেকে আগুন চুরি করে তা মানবসভ্যতাকে ফিরিয়ে দেন। তার এই অবদানের জন্য প্রমিথিউসকে বলা হয় দ্য লাইট ব্রিংগার।
এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে জিউস প্রমিথিউসকে চিরকাল শাস্তিস্বরূপ মাউন্ট অলিম্পাসে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন আর প্রতিদিন একটি শকুন (কোথাও কোথাও ঈগলও বলা হয়) এসে প্রমিথিউসের যকৃৎ ঠুকরে ঠুকরে তাকে মেরে ফেলে। পরদিন আবার প্রমিথিউসের যকৃৎ সৃষ্টি হয় এবং আবারও শকুনটি তা ঠুকরে খায়। এভাবে চলতে থাকে অনন্তকাল। অনেক লোককাহিনীতে বলা হয়, এই পাখিকে মেরে ফেলা ছিল হারকিউলিসের টুয়েলভ লেইবরের একটি।
দ্য লাইটহাউজে প্রমিথিউসের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় ইফ্রেইমের (আরেক নাম থমাস হাওয়ার্ড) মাঝে। প্রমিথিউসের মতোই বিদ্রোহী এবং প্রবল আগ্রহী ইফ্রেইম।

উৎসুক ইফ্রেইমকে দেখতে চান লাইটহাউজে কী আছে যা তার থেকে গোপন করছে ওয়েক। তার ধারণা, এই আলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো অলৌকিক জ্ঞান যা আহরণ করতে চান তিনি।
ইফ্রেইমের কৌতূহল দেখে বিচক্ষণ ওয়েক তাকে সতর্ক করে বলেন,
“And if you stare into that lamplight beware of what you might see.”
প্রমিথিয়াস যেমন পরিণাম ভালো হবে না জেনেও মানবসভ্যতার জন্য আগুন নিয়ে এসেছিলেন, ঠিক তেমনই নিজের অভিলাষ পূর্ণ করার জন্য শেষমেশ ওয়েককে অমান্য করেন ইফ্রেইম।
শুধুমাত্র স্বভাব- চরিত্রে না, প্রমিথিয়াস আর ইফ্রেইমের ভাগ্যও যেন একই কাব্যে গাঁথা।
এত জটিলতার মাঝেও হাসির খোরাক জোগানোর কারণে অনেকে দ্য লাইটহাউজকে ডার্ক কমেডি বিবেচনা করেন, আবার কিছুটা বাস্তব ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ায় সিনেমাটিকে হিস্ট্রিক্যাল ড্রামাও ভাবেন অনেকে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, সিনেমাটি মানুষের একাকিত্বকে ঘিরে তৈরি একটি সাইকোলজিক্যাল ড্রামা; অন্যদিকে ভ্যারাইটি ম্যাগাজিনে সিনেমাটিকে বলা হয় একটি ভিন্নধর্মী আর্ট থ্রিলার। যে ধরনের সিনেমা হিসেবেই পরিচয় পাক না কেন, সিনেমাটি এর নিজস্বতা নিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে সবখানেই।
জরিন ব্লাশকার ক্যামেরায় ড্যাফো আর প্যাটিনসনের চমৎকার অভিনয়, ম্যাক্স ও রবার্ট এগার্সের অসাধারণ গল্পে নির্মিত এই সিনেমাকে দর্শক কী হিসেবে বিবেচনা করবেন সেটা সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এবং এই কারণেই দ্য লাইটহাউজ অন্য সব সিনেমা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন।