ষাটের কাছাকাছি বয়সের একজন হাসিখুশি ও সুদর্শন ব্যক্তি। আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলে তাকে নিপাট ভদ্রলোক বলেই যে কেউ ধরে নেবে। আর কথাবার্তায় ও আচরণে সাক্ষাত সুপুরুষ তিনি। মিষ্টি হাসি, দুষ্টমিভরা চোখ টিপুনি, বুদ্ধিদীপ্ত ও হাস্যরসপূর্ণ আলাপে যে কাউকে খুব সহজে বশীভূত করে দিতে পারেন তিনি। পরনে গাঢ় নীল রঙের স্যুট, মাথায় হ্যাট, হাতে ব্যাগ ধরা ও কানে হিয়ারিং এইড গুঁজে থাকা লোকটি আশেপাশের লোকজনকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে না দিয়েই কয়েক মিনিটের ভেতর সাংঘাতিক এক অপরাধ করে ফেলেন।
‘ব্যাংক ডাকাতি’ কথাটা শুনলে আপনার কল্পনায় কেমন দৃশ্য ভেসে উঠে, বলুন তো? কোনো এক ব্যস্ত কর্মদিবসে একদল মুখোশ পরিহিত ডাকাত বন্দুক হাতে হুট করে কোনো ব্যাংকে ঢুকে পড়ে। ব্যাংকের কর্মীরা থেকে শুরু করে গ্রাহকেরা সবাই ভয়ে চিৎকার করতে করতে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। তারপর ডাকাত দলের নির্দেশ মতো সবাই হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ে। ডাকাত দলের প্রধান ব্যাংকের ম্যানেজারের সামনে বন্দুক তাক করলে তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিজের প্রাণ বাঁচাতে ড্রয়ার খুলে সব অর্থ ডাকাতদের হাতে তুলে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেদের ঝুলি পূর্ণ করে ডাকাতেরা ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে দৌড়ে বেরিয়ে গেলে ইমার্জেন্সি অ্যার্লাম বেজে ওঠে আর সেই সাথে পুলিশের সাইরেন।
এমন দৃশ্যই কম-বেশি সব সিনেমাতে ব্যাংক অথবা দোকানপাট ডাকাতির ক্ষেত্রে দেখানো হয়। অথচ এই একই রকমের ডাকাতি আমাদের ভদ্রলোক করে থাকেন ধীরেসুস্থে, নীরবে। ব্যাংকের ম্যানেজার বা ক্যাশিয়ার ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বিন্দুমাত্র ধারণাও পায় না যতক্ষণ না তিনি নিজের সাদা সেডানে না চেপে বসেন। কেউ জানবে যে, ভদ্রলোক হ্যান্ডব্যাগে পিস্তল বয়ে বেড়ান।
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এমনই এক চিত্রের সন্ধান পাবেন ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য গান’ সিনেমাটিতে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মোটেও কোনো লেখক অথবা চিত্রনাট্যকারের লেখনীর তুলিতে আঁকা নয় এ চরিত্রটি। একদম বাস্তবিক এক জীবনের গল্পই তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে। গত বছরের যে কয়টি দারুণ বায়োগ্রাফিক্যাল ড্রামা জনরার মুভি মুক্তি পেয়েছে, তার মধ্যে ‘ দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য গান’ নিঃসন্দেহে অন্যতম সেরা। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমাতে ফরেস্ট টাকার নামে একজন অপরাধীর গল্প ফুটে উঠেছে। তবে তিনি কিন্তু যেন তেন অপরাধী ছিলেন না, বিশ্বের ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত এক অপরাধী হয়ে থাকবেন। কিন্তু কেন? আসুন, সেই গল্পে যাওয়া যাক।
ফরেস্ট টাকারের জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালের ২৩ জুনে। ফ্লোরিডার মায়ামিতে জন্ম নেওয়া ফরেস্টের রক্তেই যেন মিশে ছিল চঞ্চলতা ও দস্যিপনা। মাত্র পনেরো বছর বয়সে গাড়ি চুরির দায়ে তাকে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পালিয়ে যান তিনি। সেই থেকে তার জীবনের অপরাধ-ধরা খাওয়া-পালিয়ে যাওয়া চক্রের শুরু।
এর সমাপ্তি ঘটে প্রায় ৬৪ বছর পর, ২০০০ সালে। সেবার পুলিশ তাকে ধরে হাজতে আটক করলে আর পালাতে পারেননি তিনি। সেখানেই ২০০৪ সালের ২৯ মে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মাঝখানের ৬৪ বছরে কি আর কম অপরাধ করেছেন তিনি? শুধু অপরাধ বললে ভুল হবে। তার অপরাধমূলক কর্মকান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য অঙ্গরাজ্যের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের রাতের ঘুম হারাম করেছে। তাকে হাতেনাতে ধরে জেলে পুরে রাখার কৌশল বের করতে হাঁপিয়ে উঠেছিল প্রশাসন। কিন্তু একজন ‘এস্কেপ আর্টিস্ট’কে খাঁচায় রাখা কি এতই সহজ? তিনি যে শুধু চুরিবিদ্যাতেই পারদর্শী তা নয়, জেল থেকে পালানোর হাজার রকম বিদ্যা ছিল তার নখদর্পণে।
মানুষটা শুধু যে পুলিশকে ফাঁকি ও ধোঁকা দিয়ে ক্ষান্ত ছিলেন তা-ও না। তিনজন নারীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এ মানুষটি নিজের সহধর্মিণীদের সাথেও প্রতারণা করেছেন। নিজের কুকর্ম লুকাতে গিয়ে ও নিজের স্বার্থপরতা বজায় রাখতে পরিবারের মায়াকে বরাবরই অবহেলা করে এসেছেন। তার স্ত্রীরা স্বামীর আসল পরিচয় তখনই পেয়েছিল, যখন পুলিশ তাদের দরজায় কড়া নেড়েছিল। এমনকি দু’সন্তানের বাপ হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদের প্রতি পিতার দায়িত্ব পালন করেননি। ফরেস্ট টাকারের চরিত্রটাই কেমন রহস্যময়। জীবনকে ছেলেখেলা ধরে নেওয়া মানুষটি এসব নিছক মজার ছলে করতেন, নাকি ‘সিরিয়াল কিলার’দের যেমন খুনের নেশা চড়ে বসে মগজে, তেমন তারও মাথায় এক চোর-পুলিশ খেলা জেঁকে বসেছিল, তা অজানাই রয়ে গেছে।
আর ফরেস্ট টাকারের এ রোমাঞ্চকর জীবন নিয়ে ২০০৩ সালে আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ এ একটি আর্টিকেল ছাপা হয়। ডেভিড গ্রানারের লেখা সেই আর্টিকেলটির নামও ছিল, ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য গান’। পরবর্তীতে ‘পিট’স ড্রাগন‘ ও ‘আ ঘোস্ট স্টোরি‘ সিনেমা দুটির জন্য পরিচিত পরিচালক ডেভিড লোয়ারি আর্টিকেলটিকে চিত্রনাট্যে রূপ দেন। তিনি সিনেমাতে নির্মাতার ভূমিকা পালন করেছেন। সিনেমাতে ফরেস্ট টাকারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন চারবার অস্কারজয়ী অভিনেতা রবার্ট রেডফোর্ড। এছাড়া অন্যতম দুটি চরিত্রে ছিলেন ছয়বার মনোনয়নপ্রাপ্ত ও একবার অস্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় অভিনেত্রী সিসি স্প্যাসেক ও ৮৯ তম অস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতা অভিনেতা ক্যাসি অ্যাফ্লেক। তারকাখচিত এ সিনেমাটি তাই আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল সিনেমাপ্রেমীদের মনে। এছাড়া এটা রেডফোর্ডের মতো এমন বড়মাপের অভিনেতার অভিনয় জীবনের শেষ কাজ বলে কথা।
এবার সিনেমার দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক। সিনেমার শুরুতে ১৯৮১ সালে টেক্সাসের একটি শহরে আমেরিকান ব্যাংক ডাকাতির দৃশ্য দেখানো হয়। সেখান থেকে ডাকাতি করে মনের সুখে নিজ গন্তব্যের দিকে গাড়ি নিয়ে ছুটে চলছিলেন ফরেস্ট টাকার। পথিমধ্যে তার দেখা হয়ে যায় একজন বিধবা র্যাঞ্চ মালিকের সাথে। মহিলাটি বয়সে তার কাছাকাছি হওয়াতেও তার মতোই হাসিখুশি ও বন্ধুত্বপূর্ণ হবার কারণে তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন ফরেস্ট। তাছাড়া মহিলা একইসাথে রূপবতী ও বুদ্ধিমতীও বটে। কিন্তু কেন জানি এ রমণীর কাছে মিথ্যার আশ্রয় নিতে চাইলেন না তিনি। তাই চলার পথেই নাটকীয়তার ছলে তার সামনে নিজের বাস্তবতা মেলে ধরতে চাইলেন।
একাকী দুজন বৃদ্ধ মানুষ যখন পরস্পরের সান্নিধ্যে এসে অল্পখানি সুখের সংস্পর্শ পেতে শুরু করেছিলেন, তখন আসলে অনেক কঠিন ও ভয়াবহ সত্যও হার মেনে যায়। তাই তো জুয়েল নামের সেই নারী অত শত না ভেবে ফরেস্টের কথাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন। তাদের এই মিষ্টি- মধুর সম্পর্ক চলছিল বলে যে ফরেস্টের কুকর্মের অব্যহতি ছিল তা কিন্তু না। বরং তিনি আরও বিশাল ডাকাতি করতে তৎপর হয়ে উঠলেন। অন্যদিকে, ডালাসের পুলিশ অফিসার জন হান্ট ফরেস্টকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। একজন অজ্ঞাত ডাকাত একের পর এক ব্যাংক ডাকাতি করে যাচ্ছে, অথচ তার পরিচয় দূরে থাক, সিসিটিভি ফুটেজে কোনো স্পষ্ট ছবি নেই, তাকে কীভাবে হাতের নাগালে পাবেন অফিসার হান্ট? ফরেস্ট যেমন পুলিশের সাথে দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছিলেন, ঠিক তেমনি হান্টও ফরেস্টের পেছনে নাছোড়বান্দার মতো লেগেছিলেন। শেষমেশ হান্ট কি ফরেস্টকে গ্রেফতার করতে পারছিলেন? আর করলেই বা কীভাবে? আর এরপর তিনি জেল থেকে আবার পালিয়েছিলেন কবে ও কীভাবে? এসব বিস্তারিত জানতে হলে আপনাকে ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য গান’ সিনেমাটি দেখে নিতে হবে।
এবার সিনেমার অভিনয়শিল্পীদের ব্যাপারে কথা বলা যাক। রেডফোর্ডের অভিনয় দক্ষতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই আসলে। তিনি বরাবরের মতো তার চরিত্রের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। আপনি পুরোটা সময় জুড়ে পর্দায় ফরেস্ট টাকারকেই দেখতে পাবেন, রেডফোর্ডকে নয়। তার কথা বলায় মুখভঙ্গি, চালচলন ও কাজকর্ম আপনাকে কখনো শিহরিত করবে, তো কখনো হাসাবে। সিসির চরিত্রটি ভালোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল সিনেমাতে। এমনকি বাস্তবের ফরেস্টের জীবনেও জুয়েলের অবদান বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। হান্ট চরিত্রে ক্যাসি ছিলেন অনবদ্য। দিন দিন যেন তার অভিনয় প্রতিভা বিকশিত হচ্ছে।
মাত্র এক ঘন্টা তেত্রিশ মিনিটের এ সিনেমাতে ফরেস্ট টাকারের জীবনকে হয়তো বিশদভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। তবে যতটুকু দেখানো হয়েছে এতে করে দর্শক তার সম্পর্কে ভালোই ধারণা পেতে সক্ষম হবেন। ফরেস্টের বৈচিত্রময় জীবন, তার পেশা-নেশা, তার ব্যক্তিত্বের একটি খন্ড চিত্র পাওয়া গেছে সিনেমাতে।
সিনেমার ঘটনাপ্রবাহ যেমন চাঞ্চল্যকর, ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠা গানগুলো ও মিউজিক ঠিক তেমনই ঘটনাপ্রবাহের সাথে যেন খাপে খাপে মেলানো হয়েছে। দারুণ সব লিরিক্সের গান ও হিউমারযুক্ত সব সংলাপ শুনতে শুনতে যেকোনো সিনেমাপ্রেমী সুন্দর একটি বিনোদনধর্মী সিনেমার স্বাদ নিতে পারবেন। রটেন টমেটোসে ২২১টি ভোটের ভিত্তিতে ৯১% ও মেটাক্রিটিকে ৪৭টি ভোটের ভিত্তিতে ৮০% রেটিং লাভ করেছে সিনেমাটি। এছাড়া ৭৫তম গোল্ডেন গ্লোবে সেরা অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন রেডফোর্ড। সিনে সমালোচক ও সাধারণ দর্শক উভয় শ্রেণীর কাছেই ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে সিনেমাটি।