১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়। সেন্ট্রাল জেলে অবস্থানকালে সহধর্মিণী রেণুর অনুরোধেই লেখার শুরুটা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোর আর যৌবনের রাজনৈতিক জীবনের উপাখ্যান খুব সহজ আর সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করেছেন তিনি।
শুরুতেই চমৎকার স্মরণশক্তির পরিচয় দিয়েছেন বংশের ইতিহাস এবং নিজের বিস্তৃত জীবনে প্রিয় রেণুর আগমনের কথা লিখে। এরপর ক্রমেই কখনো সংক্ষিপ্ত কখনো বিস্তর বয়ানে উঠে আসলো তার ঘটনাবহুল ছেলেবেলা, স্বদেশী আন্দোলন, সেবার পথে প্রথম পদার্পণ, খেলাধুলা, রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাক্ষাৎ আর সহপাঠীকে উদ্ধারে প্রথমবারের মতো সক্রিয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও জেল যাপন। বঙ্গবন্ধু যখন প্রথমবারের মতো জেলে গেলেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর।
এরপর থেকে ক্রমেই বাড়তে থাকে ঘটনার বিস্তৃতি। পাকিস্তান আন্দোলনের নবযাত্রা শুরু হয় আর এর সাথে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদ আর মিছিলের অনিঃশেষ যাত্রা। ক্রমেই নিষ্ঠা, কর্মস্পৃহা, পরিশ্রম আর জনবান্ধব হিসেবে শহীদ সাহেবের কাছের মানুষে পরিণত হওয়ার ঘটনার সাথে সাথে উঠে এসেছে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের রাজনৈতিক জীবন আর ছাত্রদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার চমৎকার সব ঘটনা।
সহজ ভাষার উঠে এসেছে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের দুর্ভিক্ষ আর দাঙ্গায় মানুষের অজস্র প্রাণহানি, নানাবিধ করুণ ভোগান্তি আর হতাহতের ঘটনা। উঠে এসেছে মাদারীপুর, ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জ জুড়ে তার পাকিস্তান আন্দোলনকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। এরপর সসম্মানে তুলে এনেছেন বাংলার মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, তথা শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, খাজা নাজিমুদ্দিন আর আনোয়ার হোসেনদের রাজনীতি।
লিখেছেন, চল্লিশের লাহোর প্রস্তাবের সাথে States এর ‘es’ এর ছোট্ট একটু পরিবর্তনের কথা, যা কি না বাংলার একীভূত হওয়ার স্বপ্ন বাতিল করে দিয়েছে। এরপর ছেচল্লিশের নির্বাচনে মুসলিম লীগের অভূতপূর্ব বিজয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধুসহ আপামর জনতার স্বপ্নের পাকিস্তানের সৃষ্টি, যে স্বপ্ন ভেঙে যেতে বছরখানেকের বেশি সময় লাগেনি বাংলার সচেতন সমাজের।
এর মাঝে বল্লভ ভাই, প্যাটেল আর শ্যামা-প্রসাদদের তথা কংগ্রেসের ষড়যন্ত্রে ন্যায়সঙ্গত এক বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলো সেটাও তুলে ধরেছেন ব্যথাতুর মনে। নতুন জন্ম নেওয়া শিশুটির ক্ষমতায় বসলো পুরনো ভক্ষক জমিদার, পা চাটা আমলা আর জনবিমুখ সুবিধাবাদীর দল। একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে বড্ড করুণ হৃদয়ে তুলে ধরছেন তার ডায়েরীর পাতায়। শুরু হলো অন্যায়, অবিচার আর শোষণের প্রতিবাদ। কিছুদিনের মাঝেই জেল-জীবনটাকে আসল জীবন বানিয়ে নেয়ার যাত্রা শুরু হলো ‘৪৯ এর বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মঘট থেকে।
বের হয়ে শুরু হলো নতুন সূচনা। মাওলানা ভাসানি, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক খান আর আমাদের মহান নেতার নেতৃত্বে জন্ম নিলো আওয়ামী মুসলিম লীগ৷ সেই সাথে সারা দেশে চললো কমিটি আর জনসংযোগের কাজ। একে একে উঠে আসে লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, চৌধুরী গোলাম মোহাম্মদ, মোহাম্মদ আলীদের ষড়যন্ত্র আর অগণতান্ত্রিক কূপমন্ডক শাসনের ইতিবৃত্ত। সবচেয়ে অসাধারণ ছিল জিন্নাহ ব্যতীত সকল প্রধানমন্ত্রী কিংবা গভর্নর জেনারেলের সাথে লেখকের বৈঠক বা মুখোমুখি সাহসী পরামর্শ কিংবা সমালোচনার বজ্র কঠিন হৃদয়ের প্রকাশ। অথচ তখনো তার বয়স ঘোরাফেরা করছে ত্রিশের আশেপাশে।
এছাড়া দ্বিতীয়বার জেলে গিয়ে দীর্ঘ ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিনা বিচারে আটকে থাকাকালীন তার আমৃত্যু অনশন সিদ্ধান্ত আর প্রায় মৃত্যুশয্যায় পৌঁছে যাওয়ার বর্ণনা। এমতাবস্থায় মুক্তির সময়েও বিরোধী নেতা মহিউদ্দীনের জন্য তার ব্যকুলতা সত্যিই অসামান্য।
এতে তিনি আরো তুলে ধরেছেন, শহীদ সাহেবকে নিয়ে রাজনীতি কিংবা কলকাতায় তার দাঙ্গা থামানোর সাহসী পদক্ষেপ কিংবা দুজনের পারস্পরিক মতানৈক্য কোনো কৃপণতা ছাড়াই তুলে এনেছেন বঙ্গবন্ধু। এছাড়া তার বিভিন্ন সময়ের ভারত, পাকিস্তান আর চীন সফরের ইতিবৃত্ত। পুরো বইটা পাঠ করতে গিয়ে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম বঙ্গবন্ধুর অসামান্য স্মৃতিশক্তির পরিচয়। দেশ থেকে শুরু করে ভারত, পাকিস্তান, চীন যেখানেই গিয়েছেন সেখানকার সাক্ষাত কিংবা সঙ্গী হওয়া নানা বয়সের নানা পেশার মানুষের সমৃদ্ধ পরিচয় তুলে ধরেছেন বইটিতে শুধুমাত্র মস্তিষ্কের জমানো স্মৃতি থেকে। মানুষকে মনে রাখার এই ক্ষমতা তার জনপ্রিয়তার এক অন্যতম কারণ।
বঙ্গবন্ধু পুরো বই জুড়ে তার বিরোধী-পক্ষ, যাদের নির্যাতনে তার জীবনাবসানের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, কিংবা আওয়ামী লীগে সুবিধাবাদী পক্ষ, যাদেরকে আমরা গালি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করি না, সেরকম মানুষদের তুলে ধরেছেন বিনয় ও যথাযোগ্য সম্মানের সাথে। কখনো সাহেব বলে, কিংবা তার পদমর্যাদা বলে, যেমন- মোহাম্মদ আলী সাহেব, আবদুস সালাম জমিদার! কী অসাধারণ শ্রদ্ধাবোধের রাজনীতি তখনও ছিলো। আর আজ?
অভিজ্ঞতা কিংবা লেখার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা করেছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’কে। যদিও আবুল মনসুর আহমেদ কিংবা অলি আহাদ সাহেবের বইগুলোও অনেকটা কাছাকাছি চিন্তা ও বিশ্লেষণের। তবুও বারবার তাদের চিন্তাগত প্যারাডাইম পরিবর্তনের মতো পরিবর্তন বঙ্গবন্ধুর না হওয়াতে তিনি এদিক থেকে স্বতন্ত্র হয়েছেন। সব মিলে অসম্ভব সুখপাঠ্য! বেঁচে থাকুক ইতিহাসের নির্মোহ যাত্রা, বেঁচে থাকুন অবিসংবাদিত বঙ্গবন্ধু।
বই: অসমাপ্ত আত্মজীবনী || লেখক: শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি কম