৫টি ভিন্ন ধারার ফিকশন এবং ৫টি ভিন্ন ধারার নন-ফিকশন মিলিয়ে বছরের সেরা ১০টি বইয়ের তালিকা প্রতি বছরই প্রকাশ করে বিখ্যাত পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। মূলত নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের বুক রিভিউ ডিপার্টমেন্টে শুরু হয়ে যায় বই বাছাইয়ের কাজ। টানা ২২ দিন তারা বই বাছাইয়ের কাজ করে নিরলসভাবে। আর ২৩ তম দিনে মূল তালিকা প্রকাশ করে তারা নিজেদের সাইটে। তাই, সারা বছরের সেরা ১০টি বইয়ের তালিকা দেখতে বইপ্রেমীরাও থাকে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার অপেক্ষায়। প্রতিবছরের মতো ২০২১ সালের সেরা ১০টি বইয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
ফিকশন
হাউ বিউটিফুল উই ওয়্যার – ইম্বোলো এম্বুয়ে
১৯৮০ সালের আফ্রিকান ফিকশনাল এক গ্রাম কোসাওয়াতে গল্পের শুরু। যেখানে আমেরিকান তেল কোম্পানির প্রতিনিধিরা স্থানীয়দের সাথে দেখা করতে আসে। স্থানীয়দের শিশুরা ড্রিলিং এবং পাইপলাইনের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয়ে (পতিত ক্ষেত খামার এবং বিষাক্ত পানি) ধীরে ধীরে মৃত্যু কোলে ঢলে পড়ছে। ক্ষমতা এবং দুর্নীতির এই কয়েক দশক ধরে চলা উপকথাই ইম্বোলো দেখিয়েছেন কোসাওয়া নামক এক ফিকশনাল গ্রামের স্থানীয়দের দৃষ্টিতে। পুঁজিবাদের যুগে ঔপনেবেশিকতার চাষাবাদ একনজর দেখাতে চেয়েছেন ইম্বোলো এম্বুয়ে।
২০১৬ সালে ‘বিহোল্ড দ্য ডিমার্স’ ছিল ইম্বোলো এম্বুয়ের প্রথম উপন্যাস, যা ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। ক্যামেরুনিয়ান-আমেরিকান এই লেখিকা মূলত উপন্যাস এবং ছোট গল্প লিখেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য পান।
ইন্টিমেসিস – কেটি কিটামুরা
একজন দোভাষী নিউ ইয়র্ক থেকে পালিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে কাজ করার জন্য হেগে এসেছেন। বহুভাষাবিদ এবং বহু পরিচয়ের একজন নারী, যে কিনা এমন একটা জায়গার সন্ধানে আছে যেটাকে শেষমেশ ঘর বলা যায়। তার প্রেমিক আদ্রিয়ান, যে কিনা স্ত্রীর থেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের বিবাহ বন্ধনে আটকে আছে। তার বান্ধবী জেনা, যে কিনা অসংখ্য অপরাধ সংঘটিতে হতে দেখেছে নিজের চোখে। আর সবশেষে এমন একজনের সঙ্গে দোভাষীর বন্ধুত্ব হয় যে কিনা ভিকটিমের বোন; আর দোভাষী সেই মোহের জগতে হারিয়ে যায়। সেই মোহ থেকে সে যখন টেনে বের করে আনতে চায় রাজনৈতিক ইস্যুগুলো, তখন প্রাক্তন এক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে আঙ্গুল উঠে যায়। অন্তরঙ্গতা, প্রেম, ভালোবাসা, ক্ষমতা সবকিছুই আদালতের কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে কেবলমাত্র প্রমাণ ছাড়া- এমনটাই যেন বলতে চেয়েছেন কেটি কিটামুরা।
কেটি কিটামুরা একজন আমেরিকান ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক এবং শিল্প সমালোচক। ইন্টিমেসিস তার প্রকাশিত চতুর্থ গ্রন্থ। আর ২০২১ সালের ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য বইটি ইতোমধ্যে বাছাই করা হয়েছে।
দ্য লাভ সং অফ ডব্লিউ. ই. বি. ডু বোইস – হনোরি ফেনন জেফার
গল্পটা আমেরিকার দক্ষিণে বসবাস করা আফ্রিকান-আমেরিকান এক পরিবারের। যারা নিজেদের শেকড়টাকে খুঁজে ফিরে আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ও দাসত্বের আগে থেকে, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এবং এমনকি বর্তমান পর্যন্ত। পারিবারিক শিক্ষা, ইতিহাস, বর্ণবাদ সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত আছে এই বইয়ে। মূলত বিশ শতকের শেষের দিকে বেড়ে ওঠা এক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে আইলি পার্ল গারফিল্ড এবং তার পূর্বপুরুষদের। নেটিভ আমেরিকানদের জীবনযাত্রা আর সংগ্রাম শ্লোকের মতো কিংবা কবিতার মতো লিখে সেখান থেকে তাদের অতীত ইতিহাস ও সংস্কৃতির সন্ধান করেছেন লেখিকা।
হনোরি ফেনন জেফার আদতে একজন শিক্ষক এবং কবি। দ্য লাভ সং অফ ডব্লিউ.ই.বি. ডু বোইস জেফারের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তবে ইতিমধ্যে ৫টি কবিতার বই প্রকাশ করে নিজেকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।
নো ওয়ান ইজ টকিং এবাউট দিস – পেট্রিসিয়া লকউড
একজন নারী যে কিনা তার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করার জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়, একদিন সে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার ভক্তদের সঙ্গে দেখার করার জন্য ভ্রমণে বের হয়। এই ভ্রমণে নতুন ভাষা আর সংস্কৃতির সংস্পর্শে তার চিন্তার দ্বার আরো প্রসারিত হয়ে যায়। কিন্তু যখন অস্বস্তির হুমকি, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানাবিধ নামহীন স্বৈরশাসকের উত্থান দেখে নিজ চোখে, তখন যেন তার জীবন সঙ্কুচিত হয়ে আসতে চায়। এক অদ্ভুত শূন্যতা আর বিষণ্ণতা গ্রাস করে তাকে। পৃথিবী তখনই থমকে যায় যখন দুজন বাচ্চা নারীকে জিজ্ঞেস করে – আচ্ছা, আমরা কি জাহান্নামে আছি? আর মৃত্যু অবধি কি আমাদের এরকম জাহান্নামেই থাকতে হবে?
অনলাইন এবং রক্ত-মাংসে গড়া মানুষের মধ্যে কতটা তফাত – এই ব্যাপারটাই ফুটিয়ে তুলেছেন পেট্রিসিয়া লকউড তার বইতে। কবি আর প্রাবন্ধিক হিসেবে খ্যাত হলেও এখন পেট্রিসিয়া উপন্যাসিক হিসেবেও পরিচিত। কেননা, তার এই গ্রন্থ সম্মানিত বুকার প্রাইজের নমিনী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিল।
হোয়েন উই সিজ টু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড – বেঞ্জামিন লেবেতুত। অনুবাদক – আদ্রিয়ান নাথান ওয়েস্ট
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট থেকে পাওয়া একটি চিঠি খুলে মেলে ধরেন। ভেতরে তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণের প্রথম সমাধান খুঁজে পান। কিন্তু তিনি তখনও জানেন না যে, এর মধ্যে এমন এক দৈত্য আছে যা তার জীবন এবং কর্মকে থামিয়ে দিবে। এরপর আসে মহান গণিতবিদ অ্যালেক্সান্ডার গ্রোথেনডিক। যিনি বিমূর্ততায় এতটাই বুঁদ ছিলেন যে, দুনিয়াবি সকল সম্পর্ক তিনি ছিন্ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আর এর পেছনে মূল কারণ ছিল – যদি এই সম্পর্কের কারণে তার আবিষ্কার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরউইন শ্রোডিঙ্গার এবং ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দুটি সমতুল্য অথচ পরস্পরবিরোধী সংস্করণ তৈরি করার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তাদের এই দ্বন্দ্ব যে বাস্তবতাকে ধূলিস্মাৎ করে নতুন এক বিশ্বে পদার্পন করবে তা কি তারা জানে?
সত্য আর কল্পকাহিনী, আবিষ্কার আর ধ্বংস, সাধারণ আর অসাধারণ এবং প্রতিভা আর উন্মাদনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে যেই মুহূর্তগুলো সেগুলোকে খুব সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত করেছেন বেঞ্জামিন লেবেতুত। চিলিয়ান এই লেখক ২০১৩ সালে সম্মানিত সান্তিয়াগো মিউনিসিপ্যাল লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। আদ্রিয়ান নাথান ওয়েস্ট একজন আমেরিকা-স্প্যানিশ অনুবাদক, যিনি এখন অবধি ২০টিরও অধিক বই অনুবাদ করেছেন।
নন-ফিকশন
দ্য কোপেনহেগেন ট্রিলজি: চাইল্ডহুড, ইয়ুথ, ডিপেনডেন্সি – টোবে ডিটলেবসন
১৯৬০ এবং ৭০’ দশকে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিল ডিটলেবসনের এই আত্মস্মৃতিকথামূলক বইটি। তখন মাত্র একটি সংস্করণই প্রকাশ পেয়েছিল। যেখানে তার বেড়ে ওঠার কঠিন গল্প, তার ক্যারিয়ার এবং নির্দয় আসক্তি – শিল্প এবং জীবনকে এক করার ব্যর্থ প্রচেষ্টার বিশদ বিবরণ ছিল। ১৪ বছর বয়সে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। নিজের বয়স ২০ গড়ানোর পূর্বেই নিজেকে একজন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। দুটি ব্যর্থ বিয়ের পর তিনি একজন সাইকোপ্যাথিক ডাক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আর বয়স ৩০ হবার আগেই তিনি অপিয়ডে পুরোপুরি আসক্ত হয়ে যান। তার জীবনের সকল নাটকীয় মোড়ের জন্য, হাস্যরস, অকপটে সত্য স্বীকার করা আর কেবল চরম বাস্তবতাই না বরং আমাদের গোপন আত্মার অবর্ণনীয় আবেগকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে এই বই।
টোবে ডিটলেবসন একজন ড্যানিশ লেখিকা। যিনি তার মৃত্যুর পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত এবং সম্মানিত একজন লেখিকা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
হাউ দ্য ওয়ার্ড ইজ পাসড – ক্লিন্ট স্মিথ
পুরোপুরি সময়োপযোগী এবং চিন্তা উদ্দীপক একটি বই। স্মিথ আদতে একজন কবি এবং একজন সাংবাদিক। তিনি দাসপ্রথার ইতিহাস, বর্তমান সময়ে তার প্রভাব, থমাস জেফারসনের মন্টিসেলো, অ্যাঙ্গোলাতে দ্য লুসিয়ানা পেনিটেশিয়ারি এবং একটি কনফেডারেটি সিমেট্রি – সবকিছুই পাঠকদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন বোঝানোর উদ্দেশ্যে। পর্যটক, গাইড, স্থানীয় লোকজন, ঐতিহাসিক সবার সঙ্গে তার খণ্ড খণ্ড অথচ বেশ ইন্টারেস্টিং আলাপ-আলোচনাও তুলে ধরেছেন তিনি। দৈনন্দিন জীবন থেকে পৃথিবীর প্রাকৃতিক বিপর্যয় কোনোকিছুই যেন বাদ পড়েনি স্মিথের বর্ণনাশৈলী থেকে।
ক্লিন্ট স্মিথ একজন লেখক, কবি এবং স্কলার। তার কবিতার বই সম্মানিত পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে ইতিমধ্যেই।
ইনভিজিবল চাইল্ড – আন্দ্রিয়া এলিয়ট
ডাসানি কোটস, নিউইয়র্কের এক গৃহহীন মেয়ে। এলিয়ট দীর্ঘ একটা সময় ধরে ডাসানি এবং তার পরিবারের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে মিশে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আশ্রয়কেন্দ্র, কোর্টরুম, স্কুল এবং ওয়েলফেয়ার অফিস সব জায়গায় এলিয়ট ছিল তাদের সঙ্গী। তাই, এলিয়ট এমন একটি বই রচনা করেছেন যেখানে একটি রাষ্ট্রের একটি শহরের একটি মেয়ে জীবিত থেকেও কী করে সবার চোখ গলে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের নিত্যদিনকার জীবনসংগ্রামই মূলত উঠে এসেছে আন্দ্রিয়া এলিয়টের ইনভিজিবল চাইল্ড বইতে।
আন্দ্রিয়া এলিয়ট একজন আমেরিকান সাংবাদিক। যিনি ২০০৭ সালে ফিচার ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরষ্কার পেয়েছেন।
অন জুনটেনথ – অ্যানেট গর্ডন রিড
এই বই ইতিহাস এবং স্মৃতিকথা একত্রে বুনে একটি সংক্ষিপ্ত আয়তনের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, স্পর্শকাতর এবং সাহসী বই উপহার দেয় পাঠকদের। টেক্সাসের জাতিগত এবং সামাজিক প্রতিটি জটিলতা লেখক খুব সুচারুরূপে ভাঁজ খুলে মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। এমনকি ইস্ট টেক্সাস স্কুলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে ছিলেন গর্ডন রিড। ছোটকাল থেকেই তাই রিড একটাই শিক্ষা পেয়েছিলেন, যদি কোনো কারণে এই দুই বর্ণের সূক্ষ্ম লাইনের পরিবর্তন হয় তাহলে জাতিগর আর সামাজিক অনেক পরিবর্তন হবে। আর এই ব্যাপারগুলোই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের বইতে।
অ্যানেট গর্ডন রিড একজন ইতিহাসবিদ এবং আইনের শিক্ষক। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষক ইতিমধ্যে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর নন-ফিকশন পুরষ্কার জিতেছেন।
রেড কমেট – হিদার ক্লার্ক
সিলভিয়া প্লাথের জীবনের গল্প। তার জন্ম, কর্ম এবং ১৯৬৩ সালে তার আত্মহত্যা করা সবই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই বইয়ে। হাজার পাতার এই বইকে স্মারকগ্রন্থ বললেও কম বলা হবে হয়তো। মূলত এই বইতে লেখক সিলভিয়া প্লাথকে বিংশ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। সিলভিয়ার ডায়েরি, চিঠি, সাক্ষাৎকার, নিত্যদিনের জীবনযাপন সবই তুলে ধরেছেন হিদার ক্লার্ক।