ইউরোপে তখন মধ্যযুগ চলমান। গভীর জলরাশির বুকে চিরে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলছে সুচারু কতক কাঠের জাহাজ। স্বর্ণকেশী সুঠাম দেহের কিছু মানুষ ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অথৈ জলরাশির দিকে, কোনো তটের দেখা পাওয়া যায় কি না। রক্তে তাদের হিংস্রতা, খুনোখুনি এবং লুটতরাজের বীজ লুকিয়ে আছে সেই জন্ম থেকেই। যুদ্ধোন্মাদ এই মানুষগুলো আর কেউ নয়, তারা হলো ইতিহাসে বর্ণিত দুর্ধর্ষ সেই ভাইকিং জাতি। হিস্ট্রি চ্যানেলের বরাতে এই ভাইকিংদের নিয়ে নির্মিত হয়েছে দীর্ঘ এক সিরিজ। দর্শকপ্রিয়তাও পেয়েছে ভালো। তাই, ইতিহাসভিত্তিক সিরিজের আলাপে ভাইকিংস সিরিজ সবসময় সমাদর পায়। এই ভাইকিংস সিরিজের অজানা যত দিক নিয়েই আজকের আয়োজন।
অরিজিন
ভাইকিংস টিভি সিরিজ বাস্তব ইতিহাসের ভাইকিংদের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। তৎকালীন স্ক্যান্ডিনেভিয়া (ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন) অঞ্চলে ছিল তাদের বসবাস। ৮ম শতক থেকে ১১শ শতক পর্যন্ত ইউরোপের নানা জায়গা জুড়ে তারা ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়েছে। প্রাচীন নর্স উপকথায় বিশ্বাসী ছিল তারা। থর, ওডিন ছিল তাদের প্রধান দেবতা। তাদের বর্তমান বংশধরেরা ব্রিটেন, ফ্রান্স, এস্তোনিয়া, ইতালি, রাশিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এরাই প্রথম আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ডের মতো জায়গায় বসতি গেড়েছিল। ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জগদ্বিখ্যাত নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের পূর্বেই প্রথম ইউরোপীয় জাতি হিসেবে তারা আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করে।
মুভি নাকি সিরিজ?
ভাইকিংস টিভি সিরিজের শো-রানার মাইকেল হার্স্ট প্রথমে এই কাহিনিকে মুভি হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। প্রথমদিকে তিনি ওয়াসেক্সের সম্রাট আলফ্রেড দ্য গ্রেটকে (৮৭১ সাল – ৮৮৬ সাল) নিয়ে একটি কাহিনি দাঁড় করান, যেখানে আলফ্রেড মুখোমুখি হবে দুর্ধর্ষ ভাইকিংসদের। কিন্তু স্ক্রিপ্ট লিখতে বসে তিনি বুঝতে পারলেন, ভাইকিংস সম্পর্কে তার বহু জিনিসই এখনও অজানা। সেজন্য তাদের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেন হার্স্ট। যখন দেখলেন ভাইকিংসদের নিজস্ব বিশাল এক উপাখ্যান রয়েছে, তখন তিনি মুভি বানানোর চিন্তা থেকে সরে আসেন। ভাবলেন, এটা সিরিজ আকারে রূপালি পর্দায় নিয়ে আসা যাক। এরপর থেকেই সিরিজ নির্মাণের কাজ শুরু হলো পুরোদমে।
মিনি সিরিজ
হিস্ট্রি চ্যানেলে ২০১৩ সালের ৩রা মার্চ প্রিমিয়ার করা হয় সিরিজটি। শুরুর দিকে কথা ছিল শুধু ৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দ এবং এরপরের কিছু বছরের উপর আলোকপাত করা হবে। সেজন্য, এটা ৯ পর্বের একটা মিনি সিরিজ হিসেবে আসার কথা ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যখন এই শো-র ভক্তবৃন্দের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল, তখন নির্মাতারা কাহিনি নিয়ে আরও সামনের দিকে এগোলেন। ফোকাস সরিয়ে আনলেন র্যাগনার ও তার পরিবারের দিকে। হলিউড রিপোর্টারের মতে, প্রথম সিজন বানানোর জন্য ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়।
বাস্তবের ল্যাগার্থা
র্যাগনারের প্রথম স্ত্রী ল্যাগার্থার ভূমিকায় অভিনয় করা ক্যাথরিন উইনিক বাস্তব জীবনে একজন দক্ষ মার্শাল আর্টিস্ট। টাইকোয়ান্ডোতে থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট, এবং ক্যারাটেতে সেকেন্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট আছে তার। সেই সাথে তিনি একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেহরক্ষীর দায়িত্বও পালন করেছেন একসময়।
সম্রাট র্যাগনার
এবার আসা যাক সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র সম্রাট র্যাগনারের প্রসঙ্গে। এই শো-তে র্যাগনার আর তার পরিবারের কাহিনি দেখানোর জন্য প্রাচীন আইসল্যান্ডের লোককথার চরিত্র র্যাগনার লথব্রক থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে, নেয়া হয়েছে ফোক থেকেও। এই সিরিজে ১৩শ শতাব্দীর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান লোককাহিনি, “সাগা অভ র্যাগনার লথব্রক”, “টেলস অভ র্যাগনার’স সনস” এসব থেকেও গল্প এসেছে সিরিজের প্লটে। মজার ব্যাপার হলো, র্যাগনার নামে আসলেও ইতিহাসে কারও অস্তিত্ব ছিল কি না, এই ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ভাইকিংসের কোনো লিখিত ইতিহাস না থাকায়, সিরিজ নির্মাতা ভাইকিং সম্পর্কিত সকল নথিপত্র খুঁজে দেখে কাহিনি লিখেছেন।
নর্স উপকথা অনুসারে, র্যাগনার মোট তিনটি বিয়ে করেছিল, এবং তার কোনো কন্যাসন্তান ছিল না। কিন্তু সিরিজে দেখানো হয়েছে- তিনি প্রথমে ল্যাগার্থা, এরপর রাজকুমারী অ্যাসলাগের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, এবং গাইডা নামে তাদের এক মেয়েও হয়। শো-তে একবার্ট নামে এক মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ খাতির ছিল র্যাগনারের। কিন্তু ইতিহাসে এমন কোনো মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাই বলা যায়, এই শো পুরো ইতিহাসনির্ভর নয়।
ফাইটিং সিন
এই সিরিজে যত মারামারি-কাটাকাটির দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তাতে সিরিজের অভিনেতারা নিজেরাই অভিনয় করেছেন। আলাদা কোনো স্টান্টম্যানের সহায়তা নেওয়া হয়নি। আসল হাতিয়ার দিয়ে সপ্তাহভরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলো পাকাপোক্তভাবে কোরিওগ্রাফি করা হতো। তারপর কুশীলবরা অংশ নিতেন পর্দায় দেখানো এই মৃত্যুখেলা দৃশ্যায়নের জন্য। ভাইকিংসের তৃতীয় সিজনের একটি মারামারির দৃশ্যে সিজিআইয়ের বদলে বাস্তবিক অর্থেই আগুন লাগানো হয়েছিল বারোজন স্টান্টম্যানের শরীরে। তাদের শরীরের সুরক্ষার জন্য ১৫০ গ্যালন আগুন নিরোধক জেল ব্যবহার করা হয়। শুধুমাত্র ওই এপিসোডের জন্যই ২০০ স্টান্টম্যান এবং নারী ভাড়া করা হয়।
অডিশন বিভ্রান্তি
সিরিজে এমন অনেক অভিনেতা আছেন, যারা তাদের পছন্দের চরিত্রের জন্য অডিশন দিলেও শেষে তাদেরকে বেছে নেওয়া হয় অন্য চরিত্রের জন্য। যেমন- ফ্লোকির চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করা গুস্তাফ কাসগার্ড, রোলোর ভূমিকায় অভিনয় করা ক্লাইভ স্ট্যানডেন প্রথমে র্যাগনারের ভূমিকায় অডিশন দেন। র্যাগনারের অবতার ট্র্যাভিস ফিমেল চেয়েছিলেন ফ্লোকির ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য। কিন্তু নির্বাচকদের সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়।
প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র
দক্ষ হাতে ভাইকিংস সিরিজের সুরঘর সামলেছেন নরওয়ের বিখ্যাত মিউজিক কম্পোজার এইনার সেলভিক। এখানে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সাথে তিনি বহু ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নর্স বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করেছেন। যেমন- ছাগলের শিং দিয়ে তৈরি বাকহর্ন, প্রাচীন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বেহালা-সদৃশ বাদ্যযন্ত্র ট্যাগেলহার্পা, প্রাচীন বীণা ইত্যাদি।
মৃত ভাষা
এই সিরিজে ইংরেজির পাশাপাশি চারটি মৃত এবং অব্যবহৃত ভাষা ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। এগুলো হলো প্রাচীন নর্স ভাষা, অ্যাংলো-স্যাক্সন, প্রাচীন ল্যাটিন, এবং প্রাচীন ফ্র্যাংকিস ভাষা। ভাইকিংসরা কীভাবে, কোন ভাষায় কথা বলত, সেই সম্পর্কে সবাইকে ধারণা দেওয়ার জন্যই এই আয়োজন।
ক্যামিও
এই শো-তে উল্লেখযোগ্য কিছু ক্যামিও বিদ্যমান। যেমন- মিউজিক কম্পোজার এইনারকে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে দেখা গেছে সিরিজের এক দৃশ্যে। চতুর্থ সিজনে ভাইকিং যোদ্ধা হসকোল্ডের চরিত্রে পর্দায় এসেছেন আমেরিকার বেসবল খেলোয়াড় জশ ডোনাল্ডসন। পঞ্চম সিজনের পঞ্চম এপিসোডে জ্যাটিল ফ্ল্যাটনোসের আদলে অবতীর্ণ হয়েছেন কুস্তিগির অ্যাডাম কোপল্যান্ড।
কমিক বইয়ের প্রিক্যুয়েল
ভাইকিং সিরিজের পূর্বের কাহিনি জানতে হলে পড়তে হবে কমিক বই। সান দিয়েগো কমিককনে এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। গল্প লিখেছিলেন শো-রানার মাইকেল হার্স্ট, চিত্র সম্পাদনা দায়িত্ব সামলেছিলেন ড্যানিস ক্যালেরিও। র্যাগনার আর রোলো তার পিতার সাথে লড়ছেন, এমন গল্প নিয়ে আবির্ভূত হয় কমিকের প্লট। ওখানেই প্রথম তাদের ল্যাগার্থার সাথে দেখা হয়। ২০১৮ সালে ‘গডহেড’ নামে ভাইকিংসয়ের আরেক প্রিক্যুয়াল পাবলিশ করা হয়েছে। এর গল্প ও চিত্রকর্ম এসেছে যথাক্রমে ক্যাভিন স্কট আর স্ট্যাজ জনসনের হাত ধরে।
নারীদের সাহসিকতা
ভাইকিংস শো-তে নারীদের এমন লড়াকু মনোভাব দেখে অনেকে ভ্রু কুঁচকেছে। কিন্তু নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়েছে সদ্যপ্রাপ্ত এক ডিএনএ বিশ্লেষণের ফলাফল। আমেরিকান জার্নাল অব অ্যান্থ্রোপলজির নতুন এক গবেষণা জানিয়েছে, ভাইকিং যুগে সুইডেনের এক নারী যোদ্ধার ডিএনএ-র অস্তিত্ব মিলেছে। তার কবরে কুঠার, বর্ম ইত্যাদি অস্ত্র পাওয়া গেছে। তখনকার দিনে কোনো যোদ্ধা মৃত্যুবরণ করলে তাকে তার অস্ত্রসমেত সমাহিত করা হতো। যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করাকে তারা জীবনের সর্বোচ্চ সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করত। নারীদের পুনরায় বিয়ে এবং স্বেচ্ছায় বিবাহবিচ্ছেদের রীতি চালু ছিল সেসময়।
ওপেনিং সিকুয়েন্স
ডিরেক্টর র্যামা অ্যালেন তৈরিকৃত ভাইকিংস সিরিজের ওপেনিং সিকুয়েন্স দর্শকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ৫২ সেকেন্ডের এই দৃশ্যের পেছনে ফেভার রে’র “If I Had A Heart” বাজতে শোনা যায়।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান,
আমাদের এই ওপেনিং ইন্ট্রো নর্সের এক লোককথা থেকে অনুপ্রাণিত। ওই লোককথায় বর্ণিত আছে, নয় বোন (নর্স বায়ুদেবী) জাহাজে থাকা ভাইকিংদের ধরে ধরে সমুদ্রে অতল গভীরে ফেলে দিত।