‘স্মৃতি’ খুবই ছোট একটি শব্দ। কিন্তু এই ছোট শব্দই পরতে পরতে জীবনকে বেঁধে রাখে অনন্য উপায়ে, জীবনের একান্ত সময়গুলো রাঙিয়ে দেয় নিজের মতো করে। স্মৃতি আমাদের চিরসবুজ এক সম্পদ, যা আমাদের হাসায়, কাঁদায়, উচ্ছ্বসিত করে, উদ্বেলিত করে। স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতে ভাসতে আমরা আমাদের হারিয়ে ফেলা সময়কে খুঁজে ফিরি। কখনও কখনও কিছু ঘটনা আমাদের স্মৃতিকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে, আমরা যেন তা ভাবতে ভাবতে টাইম মেশিনে করে সেই সময়েই চলে যাই।
এক সন্ধ্যায় কাজ থেকে বাসায় ফিরে ডা. ন্যায়না তালওয়ার (দীপিকা পাডুকোন) দেখল, তার জন্য একটি পার্সেল এসেছে, যেখানে রয়েছে তার প্রিয় বান্ধবী অদিতির (কল্কি কেকলা) বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র। নিমন্ত্রণপত্রটি হাতে নিতেই তার মুখে একটা স্মিত হাসির আভা খেলে যায়, সেই হাসি যেন মেঘের মধ্য উঁকি দেওয়া এক সূর্যরশ্মির মতো। ন্যায়না ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে আট বছর আগের সেই স্মৃতিতে, যখন কোনো এক গ্রোসারি স্টোরে তার সাথে বহু বছর পর হঠাৎ দেখা হয় স্কুলের সহপাঠী অদিতি মেহরার।
তারুণ্যের উদ্দীপনায় উজ্জীবিত নব্বই দশকের সাড়া জাগানিয়া একটি সিনেমা হচ্ছে করণ জোহরের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’। তখনকার সেই ‘ডিডিএলজে’ থেকে যেন পুরনো অল্ড স্কুল ভাইবটা সরিয়ে পরিচালক আয়ান মূখার্জী করণ জোহরের ধর্ম প্রোডাকশনের ব্যানারে নতুন মোড়কে সাজিয়ে বর্তমানের ‘জিন্দেগী না মিলেগি দোবারা’ প্রজন্মের তরুণদের জন্য নিয়ে এলেন ‘ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’। এই সিনেমা মুক্তির প্রায় এক যুগ আগে ফারহান আখতার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রায় একই রকম তারুণ্যনির্ভর সিনেমা ‘দিল চাহতা হ্যায়’-এর সাথে। যদিও সিনেমা দুটির প্রেক্ষাপট একদমই আলাদা।
পরিচালক হিসেবে আয়ান মুখার্জীর যাত্রা শুরু হয় ‘ওয়েক আপ সিড’ দিয়ে। ‘ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ তার দ্বিতীয় সিনেমা। মুখার্জীবাবু নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তার প্রথম সিনেমা দিয়েই। সেই বছর ফিল্ম ফেয়ারে তিনি সেরা নবাগত পরিচালকের পুরস্কার জিতে নেন ‘ওয়েক আপ সিড’ দিয়ে। তার দুটি সিনেমাতেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রণবীর কাপুর। তবে দুই রণবীর যেন দুই মেরুর মানুষ। সিড হিসেবে রণবীর নিজের জীবন নিয়ে বিভ্রান্ত, অন্যদিকে ‘ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’র রণবীরের একটা স্বপ্ন আছে, সে বাঁচার মতো বাঁচতে চায়, জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করতে চায়।
ন্যায়না তালওয়ার একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী, যে পড়াশোনা ছাড়া জীবনে আর কিছুই করেনি। অন্তর্মুখী স্বভাবের ন্যায়নার কোনো বন্ধু নেই। তার জীবন অনেকটা বইয়ের পৃষ্ঠাতেই বন্দী হয়ে আছে। একদিন হঠাৎ তার দেখা হয় স্কুলের সহপাঠী অদিতির সাথে। সেখানে সে জানতে পারে তারা তিন বন্ধু- অদিতি, কবির ওরফে বানি (রণবীর কাপুর) আর অভি (আদিত্য রয় কাপুর) মানালি যাচ্ছে ট্রেকিং ট্রিপে। এদিকে নিজের একঘেয়ে জীবনের উপর চরম বিরক্ত ন্যায়না সিদ্ধান্ত নেয়, সে-ও যাবে এই ভ্রমণে। বাড়ি থেকে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে মানালির উদ্দেশে। সেখানে তার সাথে দেখা হয় বানির।
বানি মা-মরা ছেলে। স্বভাব একদমই উড়নচণ্ডী। বাবা (ফারুক শেখ) দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সৎমা (তানভী আজমি) তাকে যথেষ্ট স্নেহ করলেও বানির তাকে একদমই সহ্য হয় না। বানির শুধু ঘুরে বেড়ানোর শখ।
এদিকে ন্যায়না মানালি এলেও তার অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য কারও সাথে মিশতে পারছিল না। ছোট থেকে একটা খোলসে আবদ্ধ থাকা ন্যায়নার জন্য হঠাৎ করে সবার সাথে মিশে যাওয়া এতটা সহজও ছিল না। সে মনে মনে চাচ্ছিল, তার এই নিজ সৃষ্ট দেয়ালকে ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে চলতে। কিন্তু এই দেয়াল ভাঙার মতো আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে ছিল না। ন্যায়নার সাহায্যে এগিয়ে আসে বানি। সে ন্যায়নাকে বিশ্বাস যোগায়, সে নিজেকে যেমন দুর্বল মনে করে, আসলে এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তি তার মাঝে আছে। নিজেকে অযোগ্য না ভেবে ভালোবাসতে বলে।
ন্যায়না আস্তে আস্তে প্রাণোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ বানির প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সে বুঝতে পারে, তারা দুজন আলাদা প্রকৃতির মানুষ। বানির জীবনে থামার কোনো ইচ্ছা নেই। সে ষাট বছরে অবসর নেওয়া সাধারণ জীবন পার করতে চায় না। সে দুনিয়ার প্রতিটি প্রান্ত দেখতে চায়, সে জীবনের প্রতিটা দিন নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। ভ্রমণের শেষ দিন তারা জানতে পারে, বানি স্কলারশিপ পেয়েছে, জার্নালিজমে কোর্স করতে শিকাগো চলে যাচ্ছে।
এর আট বছর পর, পড়াশোনা শেষ করে বানি এখন ফক্স ট্রাভেলারসে ফটোসাংবাদিক। শো’র কাজে সে প্রচুর ব্যস্ত থাকে। এমন সময় একদিন সে জানতে পারে, তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু অদিতির বিয়ে। সেই বিয়েতে তার আবার দেখা হয় ন্যায়নার সাথে। আট বছর আগের ন্যায়নার সাথে এই ন্যায়নার অনেক অমিল। সে এখন অনেক বেশি পরিণত। বিয়ের মাঝে একদিন তারা ঘুরতে বের হয়। যেখানে আবার তারা নিজেদের আবিষ্কার করে দুই মেরুর মানুষ হিসেবে। তাদের মধ্যে কোনো মিলই নেই পারতপক্ষে। তাদের এই অমিল থাকায় নিজেরদের এক হওয়াটা ছিল অসম্ভব। তাহলে?
অতঃপর বানি এবং ন্যায়না
সিনেমায় বানি চরিত্রের মূলভাব অনেকটা ‘লায়ন কিং’ সিনেমার সিম্বা চরিত্রের সাথে মিলে যায়। বেপরোয়া ‘হাকুনা মাতাতা’ জীবন। কিন্তু বানি সময়ের সাথে ছুটতে ছুটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ‘ইলাহি’ গানের মধ্যে এই বিষয়টি খুব স্পষ্ট বোঝা যায়। গানের শুরুতে তার হাতের মধ্যে একটি ট্যাটু দেখা যায়, যেখানে লেখা থাকে ‘আওয়ারা’। গানের শুরুতে তাকে খুব উৎফুল্ল দেখা গেলেও গান শেষে তার চেহারায় এক ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বানির চরিত্র অনেক ইতিবাচক। সে জীবনের ইতিবাচক বিষয়গুলোকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। সে তার স্বপ্নের পেছনে ছোটে। কিন্তু ভালো-মন্দ মিলিয়েই আমাদের জীবন। বানি তার স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে একসময় যেন তার বন্ধুদের অনেক পেছনে ফেলে আসে।
অপরদিকে, ন্যায়না প্রথমে নিজেকে নিয়ে সংশয়ে থাকলেও পরে নিজেকে চিনতে শিখেছে, নিজের মতো করে বাঁচতে শিখে গেছে। তার সুখে থাকার ধরন বানির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেখানে বানি শুধু ছুটে বেড়াতে চায় পুরো পৃথিবী জুড়ে, সেখানে ন্যায়না একটা জায়গায় স্থির হয়ে বর্তমান নিয়ে সুখে থাকতে চায়।
সিনেমাটি এত উপভোগ্য ও জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে অবশ্যই পরিচালক আয়ান মুখার্জীর অবদান সবচেয়ে বেশি। বানির ভ্রমণের প্রতি নেশাটা পর্দায় এমন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের একটা বড় অংশ বানি হয়ে যেতে চায় জীবনে। তবে সিনেমাটোগ্রাফার ওয়াই মানিকান্ডানের সৃজনশীলতাও সিনেমাকে আরও প্রাণবন্ত করেছে। তিনি এ সিনেমা ছাড়াও ‘প্রেম রাতান ধান পায়ো’, ‘রা ওয়ান’, ‘রাবণন’, ‘বিল্লু বার্বার’সহ আরও অনেক সিনেমায় ক্যামেরার কাজে নিজের কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন। সঙ্গীত পরিচালক প্রীতমের গানগুলোও সিনেমার আবহ আরও উপভোগ্য করে তোলে। এছাড়া সিনেমার শুরুতে ‘ঘাঘরা’ গানে মাধুরী দীক্ষিতের ক্যামিও ছিল দুর্দান্ত।