![](https://assets.roar.media/assets/QDsF8Z1RvXawnDWf_Cover.jpg?w=1200)
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী দুইটি ভিন্ন শব্দ, ভিন্ন ধরনের পেশাকে নির্দেশ করে। কিন্তু আজকাল সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডায় পর্যন্ত শব্দ দুইটিকে একত্রিত করে ফেলা হচ্ছে। উদ্যোক্তাকেই কখনও বলা হচ্ছে ব্যবসায়ী, আবার ব্যবসায়ীকে কখনও বলা হচ্ছে উদ্যোক্তা। সহজ ভাবনায় দুইজনকে একইরকম মনে হলেও তাদের মধ্যে বড়সড় পার্থক্য রয়েছে।
একজন ব্যবসায়ী সুনির্দিষ্ট এবং প্রতিষ্ঠিত কোনো আইডিয়া অনুসরণ করে তার ব্যবসা শুরু করেন। বেশিরভাগ সময়েই তিনি এমন পণ্য বা সেবার ব্যবসা করেন বাজারে যার প্রচুর চাহিদা রয়েছে, ফলে তার ব্যবসাতে ঝুঁকি কম হয় এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ মুনাফা তার লক্ষ্য হয়ে থাকে। তবে, প্রতিষ্ঠিত আইডিয়া হওয়ায় এখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি।
অন্যদিকে, একজন উদ্যোক্তা স্বতন্ত্র, নতুন কোনো আইডিয়া প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে তার ব্যবসা শুরু করেন। এই নতুন ধরনের আইডিয়াই প্রধানত ব্যবসায়ীর সাথে তার পার্থক্য তৈরি করে দেয়। নতুন ও অপরীক্ষিত আইডিয়া হওয়ার কারণে তার ঝুঁকি থাকে প্রচণ্ড, সেগুলো সামাল দিতে হলে তাকে প্রতিনিয়ত সৃজনশীল কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে তিনি একটি নতুন ধরনের বাজার তৈরি করে ফেলেন যা মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন নিয়ে আসে।
মৌলিকত্ব
একজন ব্যবসায়ী পুরনো কোনো ধারণা প্রয়োগ করে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। তাই তিনি যে ধরনের বাজারে প্রবেশ করেন, সেটি আগে থেকেই বিদ্যমান, যেমন: ফ্র্যাঞ্চাইজি অথবা খুচরা বাজার। তার প্রধান লক্ষ্য সর্বাধিক মুনাফা অর্জন। তাই ব্যবসাটির মৌলিকত্ব নিয়ে তার চিন্তা করতে হয় না।
একজন উদ্যোক্তা তার পণ্য ও বাজারের প্রথম উদ্ভাবক। তাকে সেই বাজারটি প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। এর পেছনে তাকে পর্যাপ্ত সময়, শক্তি এবং অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় কিন্তু তারপরেও বিশালরকমের ঝুঁকি থেকে যায়। তাই, সবসময়েই তিনি তার আইডিয়া প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না। নতুন পণ্য ও নতুন বাজার তৈরি করতে হয় বলে তার আইডিয়াটি মৌলিক হতে হয়। এই কারণেই তার শুরুকে স্টার্ট-আপ বলা হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/JmHme4IeSHckGqrQ_1.jpg)
উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি
উদ্যোক্তা তার সমস্ত উদ্যম ব্যয় করে তার উদ্যোগটিকে সফল করার জন্যে। নিজের সময় এবং অর্থের ঝুঁকি তার ভাবনায় তুলনামূলক কম আসে। তার প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে, পৃথিবীতে তার আইডিয়াটি প্রতিষ্ঠা করা। এদিক থেকে তিনি একজন উদ্ভাবক। তবে, উদ্ভাবন মানেই এই নয় যে তাকে নতুন ধরনের প্রযুক্তি তৈরি করতে হবে কিংবা একদম নতুন ধরনের কোনো অ্যাপ বানাতে হবে। উপস্থিত কোনো সেবাকে তার উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে তিনি উন্নত করে ফেলতে পারেন। যেমন: পৃথিবীতে ট্যাক্সি সার্ভিস আগে থেকেই ছিল। উবার, লিফটের মতো কোম্পানিগুলো এই সেবার প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন করেছে। এ ধরনের উদ্দীপনামূলক প্রকৃতির জন্যে উদ্যোক্তা কখনোই হাল ছেড়ে দেয় না। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌশল বের করার চেষ্টায় রত থাকেন এবং নিজের স্বপ্নকে সফল করার জন্যে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা রাখেন না।
![](https://assets.roar.media/assets/cezoro6so1Li0QLg_4.jpg)
অন্যদিকে, ব্যবসায়ীর ব্যবসা করার উদ্দেশ্যটি ভিন্ন। তার লক্ষ্য হচ্ছে সর্বাধিক মুনাফা অর্জন। নতুন ধরনের কৌশল প্রয়োগ করার মনোভাব তিনি দেখান না। কারণ, নতুন কৌশলে ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। তিনি সাধারণত প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলো নিয়েই ভেবে থাকেন এবং সেগুলো অনুসরণ করেন। এভাবে তার ব্যবসাটি সফল হয়ে উঠে। তার প্রধান লক্ষ্য থাকে, তার ব্যবসাটি যেন দ্রুত শক্তিশালী হয় ও বেড়ে উঠে। এই উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী তার কোম্পানিতে বিভিন্নরকম পণ্য পরিচিত করাতে পারেন। যেমন: ইউনিলিভার প্রতিনিয়ত সারা পৃথিবী থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ড কিনে নিয়ে তা নিজেদের পণ্য হিসেবে বিক্রি করছে। উদ্যোক্তার প্রধান লক্ষ্য তার আইডিয়া প্রতিষ্ঠা করা, ব্যবসায়ীর লক্ষ্য মুনাফা অর্জন।
ঝুঁকি
উদ্যোক্তাদের সম্পূর্ণ উদ্যোগটিই একটি বিশাল ঝুঁকি। বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করেন তার চিন্তাটি প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। কারণ তারা বিশ্বাস করেন তাদের চিন্তা অনুযায়ী পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে পারবেন। ঝুঁকি নেওয়ার সময়েই একজন উদ্যোক্তা বুঝতে পারেন, তিনি একদমই নতুন কোনো ব্যাপারে ভাবছেন যা এর আগে কেউ সমাধান করেনি। তবে, এই লক্ষ্যের পেছনে দৌড়ানোই তার ঝুঁকি নেওয়ার প্রেরণা দিয়ে থাকে। সফল হতে পারলে তিনিই নেতৃত্ব দিবেন কারণ তিনি এই বাজারের প্রতিষ্ঠাতা। নেটফ্লিক্সের উদাহরণ এক্ষেত্রে দেওয়া যেতে পারে। এইচবিও, অ্যামাজন, ডিজনির মতো বড় মিডিয়া হাউজগুলো স্ট্রিমিংসেবা শুরু করলেও প্রতিযোগিতার দিক থেকে নেটফ্লিক্স ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ী ঝুঁকির পরিমাণ সর্বনিম্ন রাখতে চান। সময় ব্যয় করতে তাদের বাঁধা নেই কিন্তু ঝুঁকি ব্যাপারটি তাদের তালিকায় থাকে না। তাই ব্যর্থ হলে তারা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার মানসিকতা রাখেন এবং নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিলেও সেটা একটা হিসেব করা ঝুঁকি এবং তিনি প্রতিষ্ঠিত কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যেখানে ঝুঁকিটি হালকা হয়ে যায়। তার সিদ্ধান্তটি ভালো ফলাফল বয়ে আনবে তা নিশ্চিত করার জন্যে তিনি একটি লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্যে যান। তবে প্রতিষ্ঠিত পথে হাঁটতে গিয়ে তাকে অনেকগুলো প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হতে হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/WsGN0Llp2l83NtfP_2.jpg)
দক্ষতা
ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার দক্ষতা দুই রকম হয়ে থাকে। উদ্যোক্তা নেতিবাচক ফলাফল ও মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসার মনোভাব দেখান। যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পূর্ববর্তী প্রতিটি ব্যর্থতা তার যে মনোবল তৈরি করে তার মাধ্যমে সাফল্যের দিকে তিনি এগোতে থাকেন।
ব্যবসায়ী তার অভিজ্ঞতার উপর বেশি নির্ভর করেন। দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার ফলে, তিনি এমনভাবে কৌশল সাজাতে দক্ষ হয়ে উঠেন যেখানে কি ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে সে সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা করতে পারেন। এভাবে হিসেব করে তিনি সাফল্যের দিকে এগোতে পারেন।
সাফল্যের সংজ্ঞা
উদ্যোক্তা জানেন না, তার পণ্য বা সেবাটি সাধারণ মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে। তিনি যেভাবে ভেবেছেন সাধারণ মানুষের সাথে যদি তা না মিলে, তাহলে বাজারে তার পণ্যের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা যাবে না। সাধারণ মানুষের জীবনে তাই তার উদ্যোগের একটি প্রভাব থাকতে হবে। তাই একজন উদ্যোক্তার সাফল্য সংজ্ঞায়িত হয় তার ক্রেতাদের দ্বারা। এভাবে, তার সাফল্যের নির্দিষ্ট কোনো সীমানা থাকে না।
ব্যবসায়ীর একটি পরিষ্কার লক্ষ্য থাকে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো গেলে তিনি নিজেকে সফল বলতে পারেন। তবে এই লক্ষ্যটি একেবারে নতুন নয় এবং এই ধরনের লক্ষ্যে তিনিই প্রথম হাঁটছেন তা বলা যাবে না। বরং, অন্য কারো সাফল্য দেখেই তিনি এই পথে এসেছেন। তাই এখানে ব্যর্থতা তার জন্যে দুঃসহনীয়।
অভিযোজন
বাস্তব পৃথিবীতে পরিবর্তন সবচেয়ে সাধারণ ঘটনা, ব্যবসার জগতে সেটা আরো বেশি সত্য। যেকোনো বাজারই খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী এই পরিবর্তনের সাথে ভিন্নভাবে মানিয়ে নেন।
উদ্যোক্তা পরিবর্তনের উপরে নির্ভর করে টিকে থাকেন। তার প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে, নিজের স্টার্টআপ দিয়ে বাজারে পরিবর্তন নিয়ে আসা। এই কারণে তিনি দ্রুত পরিবর্তনে মানিয়ে নিতে চান। এমনকি তা যদি নিজের আইডিয়ার পরিবর্তনও হয়। এইচবিওর টিভি সিরিজ ‘সিলিকন ভ্যালি’তে উদ্যোক্তা রিচার্ড হেন্ড্রিক্সের স্টার্ট-আপ এক্ষেত্রে একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে। বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে তার স্টার্টআপের আইডিয়া বিভিন্নভাবে পরিবর্তন হয়েছে। নতুন ধরনের পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যে এভাবেই উদ্যোক্তা নিজের আইডিয়াতে পরিবর্তন আনেন।
![](https://assets.roar.media/assets/b3kqumpW5Lc2zz9O_3.jpg)
ব্যবসায়ী সনাতনী, প্রতিষ্ঠিত পথ অনুসরণ করেন, তাই তার জন্যে পরিবর্তন সুখকর নয়। প্রতিষ্ঠিত কোনো পদ্ধতি যা আগে ঠিকঠাক কাজ করেছে তা যদি এখন কাজ না করে তাদের জন্যে সেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের পণ্যে তাই সহজে পরিবর্তন আনতে চান না তারা। সাধারণত তাদের বিশ্বাস থাকে পরিবর্তন নেতিবাচক ফলাফল আনবে। কিন্তু অনেক সময়েই, ভোক্তারা বিদ্যমান কোনো পণ্যে একঘেয়ে অনুভব করে নতুন কিছু খুঁজতে পারে।
দৃষ্টিভঙ্গি
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড় মানসিক পার্থক্যটি দেখা যায়, কীভাবে তারা পৃথিবীকে দেখেন এবং তা নিয়ে চিন্তা করেন। একজন ব্যবসায়ী পৃথিবীর সবকিছুর মধ্যে সুযোগ খুঁজেন। উপযুক্তভাবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে তা থেকে অনেক বেশি মুনাফা অর্জন সম্ভব। এভাবে, অর্থনৈতিক অনুপ্রেরণা তাদের ব্যবসার একেবারে কেন্দ্রে থাকে এবং এইপথে সফল হওয়ার জন্যে তারা কীভাবে সুযোগ তৈরি করা যায় তা নিয়ে ভাবেন।
উদ্যোক্তারা অন্যদিকে কল্পনাপ্রবণ ও সমস্যা সমাধানকারী হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাদের আশেপাশের জগৎটিকে তারা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন এবং ভাবেন কীভাবে তা সমাধান কিংবা আরো উন্নত করা যায়। এভাবে তারা প্রতিনিয়ত সমস্যা খুঁজে বের করেন। তবে তাদের সমাধান যে সবসময়েই ভালো হয় তা নয় কিন্তু সেই সমাধান দিয়ে তারা পৃথিবী বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে গিয়ে অনেকে ভুলের শিকার হয়। তবে এটা মনে রাখতে হবে, এখানে কেউই তুলনামূলকভাবে অন্যের চেয়ে ভালো বা খারাপ নয়। কারণ, পৃথিবীতে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে এবং কারো অবদান কোনো অংশে কম নয়। আমাদেরকে উভয়ের উপরেই নির্ভর করতে হয়।