Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.
একের পর এক বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটা তো নেহাতই পুরনো খবর। অনেককে তো আবার এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্বও আউড়াতে শোনা যায় যে, এভাবে একদিন নাকি চীন গোটা বিশ্বকেই হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার পাঁয়তারা করছে। এ কথায় অতিরঞ্জন থাকতে পারে বটে, তবে চীন যে এশিয়া ও আফ্রিকার মতো অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মহাদেশগুলোর অধিকাংশ দেশেই নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের স্বাক্ষর রেখেছে, সে ব্যাপারে কমবেশি সকলেই অবগত।
তবে সত্যিকারের বিস্ময়ের জন্ম হয় তখনই, যখন জানা যায় যে ইউরোপের মতো আপাত ধনী মহাদেশের নিয়ন্ত্রণও চীন নেবার চেষ্টা করছে। এবং তাদের সেই প্রচেষ্টা খোদ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকেও এতটাই দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে যে, তারা একটি নতুন মেকানিজম চালু করেছে, যার মাধ্যমে তাদের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ জানা যাবে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এই নজরদারি সবার জন্য নয়, প্রধানত চীনা বিনিয়োগের জন্য।
নতুন এই ব্যবস্থার ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী সংস্থা ইউরোপিয়ান কমিশনের হাতে ক্ষমতা আসবে নিজস্ব মতামত প্রদানের, যখনই কোনো বিদেশী বিনিয়োগের ফলে একাধিক সদস্য রাষ্ট্র, কিংবা সমগ্র ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বিস্তৃত প্রকল্পসমূহের (যেমন: গ্যালিলিও স্যাটেলাইট প্রকল্প) “নিরাপত্তা বা লোকনীতি হুমকির সম্মুখীন” হবে।
সেই সূত্র ধরে, গত মার্চে ইউরোপিয়ান কমিশন চীনকে আখ্যায়িত করেছে “পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী” এবং “কৌশলগত প্রতিযোগী” হিসেবে। এর প্রত্যুত্তরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চীনা রাষ্ট্রদূত আহ্বান জানিয়েছেন যেন এ অঞ্চলের দেশগুলো চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে আগের মতোই “উদারনৈতিক মনোভাব” ধরে রাখে, এবং কোনো “বৈষম্য” না করে।
ইউরোপিয়ান কমিশনকে এক হাত নিয়েছেন চীনা রাষ্ট্রদূত; Image Source: South China Morning Post
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে কী পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ রয়েছে?
শুরুতেই একটি কথা পরিষ্কার করে নেয়া দরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে চীনা মালিকানাধীন ব্যবসার সংখ্যা কিন্তু অপেক্ষাকৃতভাবে বেশ কম। তারপরও তাদের কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে, কেননা গত এক দশকে ব্যবসায়ের সংখ্যা বেশ দ্রুতগতিতে বাড়তে আরম্ভ করেছে।
মার্চে প্রকাশিত ইউরোপিয়ান কমিশনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে এ ব্লকের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদই রয়েছে বৈদেশিক-মালিকানাধীন, নন-ইইউ কোম্পানিগুলোর হাতে।
এর মধ্যে ৯.৫ শতাংশ কোম্পানির মালিকানা রয়েছে চীন, হংকং কিংবা ম্যাকাউতে। অথচ ২০০৭ সালেও এর পরিমাণ ছিল মাত্র ২.৫ শতাংশ। অপরদিকে ২০০৭ সালে প্রায় ৪২ শতাংশ কোম্পানির মালিকানা যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় থাকলেও, ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ তা কমে দাঁড়ায় ২৯ শতাংশে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এখনো কাগজে-কলমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিদ্যমান যুক্তরাষ্ট্রেরই। কিন্তু যদি বিবেচ্য হয় বিগত এক দশক, তাহলে একাধারে যেমন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমেছে, সেই একই সমান্তরালে বেড়েছে চীনের নিয়ন্ত্রণ।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে চীন
২৮টি সদস্য রাষ্ট্রে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ:
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে চীনা বিনিয়োগ; Image Source: BBC
২০১৬ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে চীনের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ২০১৬ সালে তা সর্বোচ্চ ৩৭.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়, যখন বাকি সারা বিশ্বে চীনের বিনিয়োগ ক্রমশই কমছিল- এমনটিই জানিয়েছে রোডিয়াম গ্রুপ এবং মার্কেটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজ। তবে এরপর থেকে দুই বছরই তাদের বিনিয়োগ কমেছে।
এদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলোতেও ২০১৮ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
চীন কী এবং কোথায় বিনিয়োগ করছে?
রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চীনের সিংহভাগ সরাসরি বিনিয়োগই হচ্ছে সম্মিলিতভাবে ইউরোপে বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলো তথা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিতে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত শীর্ষ ১০ দেশে চীনা বিনিয়োগ; Image Source: BBC
গত বছর ব্লুমবার্গের করা এক বিশ্লেষণ থেকে উঠে এসেছে এক অতি চমকপ্রদ তথ্য: এই মুহূর্তে ইউরোপে চীনের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে চারটি এয়ারপোর্ট, ছয়টি মেরিটাইম পোর্ট এবং ১৩টি পেশাদার ফুটবল দল।
ব্লুমবার্গ গাণিতিক পরিসংখ্যান ও হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে আন্দাজ করেছে, ২০০৮ সালের পর থেকে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিমাণ বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, তার চেয়ে চীনের বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে ৪৫ শতাংশ বেশি। এবং তারা আরো সাবধান করে দিয়েছে যে, ইউরোপে চীনের প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ এর থেকেও অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অবকাঠামোর কী অবস্থা?
গত মার্চে, ইটালি ইউরোপের প্রথম বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে চীনের সিল্ক রোড কার্যক্রম বা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় আছে বিশালাকার অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে চীনের সাথে এশিয়া ও ইউরোপের বাজারে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি।
সব মিলিয়ে, এখন পর্যন্ত রাশিয়াসহ ২০টির বেশি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের অংশীদার হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, চীন অর্থায়ন করছে গ্রিসের পিরিউস বন্দর বিস্তৃতকরণে, এবং তারা সড়ক ও রেলওয়ে নির্মাণ করছে সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা এবং উত্তর মেসিডোনিয়াতে।
সিল্ক রোড প্রকল্প; Image Source: World Economic Forum
এই প্রকল্পটি ভবিষ্যতে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র বলকান এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোর কাছে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, বিশেষত এ কারণে যে, স্বচ্ছতা ও সঠিক পরিচালনার দাবির কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের তহবিল গ্রহণ করা তাদের জন্য বেশ কঠিন একটি ব্যাপার।
তবে চীনের কাছ থেকে নেয়া লোনও যে একেবারে শর্তহীন, তা কিন্তু নয়। বরং চীন লোন প্রদানের সময়ই শর্ত জুড়ে দেয় যেকোনো প্রকল্পের কার্যক্রমে তাদের দেশের কোম্পানিগুলোকে নিয়োগ দেয়ার। তাছাড়া চীনের কাছ থেকে বিশাল লোন নেয়ার ফলে, এসব দেশের কাঁধে বড় অংকের দেনার বোঝাও চেপে বসতে পারে, যেমনটি ঘটেছে শ্রীলংকা কিংবা আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে।
চীনা বিনিয়োগ কি আরো বাড়বে?
বিশ্বব্যাপী এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু গত দুই বছর যাবত তা অনেকটাই কমে এসেছে। অদূর ভবিষ্যতেও চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি কিছুটা স্থবির থাকার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হচ্ছে।
রোডিয়াম গ্রুপের আগাথা ক্রাজ এর কার্যকারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন চীন সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধ, সেই সাথে চীনা বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সন্দেহপ্রবণতা।
এর (চীনা বিনিয়োগ কমার) মূল কারণ হলো চীন থেকে মূলধন প্রবাহের উপর আরোপিত কঠোর নিয়ন্ত্রণ। তবে এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনও একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। অনেক দেশেই চীনা বিনিয়োগ প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে, এবং একে কেন্দ্র করে রাজনীতিও হচ্ছে হরদম।
কমছে বিদেশে চীনা বিনিয়োগ; Image Source: BBC
বাড়ছে চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে সচেতনতা
এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র। এবং সেই যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু একদমই ভালো চোখে দেখছে না চীনা বিনিয়োগের বর্তমান চিত্রকে। তাই ট্রাম্প সরকার ইতিমধ্যেই নিজ দেশে চীনা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
থেমে নেই অন্যান্য দেশগুলোও। তারাও চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে একটু একটু করে সচেতন হতে শুরু করেছে। বিশেষত বিনিয়োগের খাত যদি রাষ্ট্রের কোনো স্পর্শকাতর দিক হয়, যেমন টেলিযোগাযোগ কিংবা নিরাপত্তা, তাহলে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীনা সাহায্য ছাড়াই কাজগুলো সম্পন্ন করার।
কিন্তু এ কথা বলাই বাহুল্য, বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো চীনের ব্যাপারে সচেতন হতে একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছে। আর তাই ইতিমধ্যেই, সরাসরি বিনিয়োগ কিংবা সিল্ক রোড প্রকল্পের মাধ্যমে এমনকি ইউরোপের বাজারেও ঢুকে পড়েছে চীন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/