বিগত পর্বসমূহে একটি দেশের অর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের গুরুত্ব, গত পঞ্চাশ বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের ওঠা-নামার ইতিহাস, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণ এবং মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানিকারক দেশ ও রপ্তানিকারক দেশের উপর কী প্রভাব ফেলে, সেটি বর্ণনা করা হয়েছে। এই পর্বে জ্বালানি তেলের দরপতনের কারণ এবং জ্বালানি তেলের দরপতনের ফলে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক দেশগুলোর উপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে– সেটি আলোচনা করা হবে।
২০২০ সালে যখন কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে একের পর এক দেশে, তখন সেটি বিভিন্ন দেশের সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে সুস্থ ব্যক্তিরাও কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হতে শুরু করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারকে পরামর্শ দেন, মহামারী দূর হওয়ার আগপর্যন্ত যেন সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়, এতে মানুষের সশরীরী মিথস্ক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব হবে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণও রোধ করা সম্ভব হবে। এরপর বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, জারি করে ‘লকডাউন’, যেটি ভঙ্গ করলে রাখা হয়েছিল শাস্তির বিধান। লকডাউন জারির ফলে জনগণ ঘরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, বাইরের মানুষের সাথে মেলামেশা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। করোনাভাইরাসের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে লকডাউন পুরো পৃথিবীতেই একটি ‘কার্যকর পদ্ধতি’ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
লকডাউন কিংবা ঘর থেকে বের হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতিও থমকে দাঁড়িয়েছিল। লকডাউন ও অন্যান্য বিধিনিষেধের ফলে যে মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তাই শিল্পকারখানাগুলোও কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এর পাশাপাশি জ্বালানি তেলচালিত যেসব যানবাহন রয়েছে, সেগুলোরও চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীতে সব দেশে যেসব শিল্পকারখানা রয়েছে, সেগুলো পরিচালনা করতে দরকার হয় জ্বালানি তেল। করোনাভাইরাসের সংক্রমন ঠেকাতে অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো যেহেতু শিল্পকারখানাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই এই শিল্পকারখানাগুলো পরিচালনার জন্য যে খনিজ তেলের প্রয়োজন ছিল, সেটিরও আর কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এর প্রত্যক্ষ ফলাফল দেখা দিয়েছিল জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের চাহিদা এত কমে যায় যে, উত্তোলিত তেলের দাম একেবারেই কমে গিয়েছিল। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জ্বালানি তেলের দাম ‘ঋণাত্মক’ আকার লাভ করেছিল সেসময়ে।
চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে কীভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমে যায়, তার একটি চমৎকার ‘কেইস স্টাডি’ হতে পারে ২০২০ সালের এই ঘটনাটি। অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী– যখন পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন পণ্যের যোগান বাড়লেও চাহিদা কমে যায়, কারণ যোগানদাতা পণ্যের দাম বৃদ্ধি কাজে লাগিয়ে বাড়তি মুনাফা অর্জন করতে চায়। আবার যখন পণ্যের দাম কমে যায়, তখন চাহিদা বেড়ে গেলেও যোগান কমে যায়, কারণ কম মূল্যের কারণে যোগানদাতার অনেক সময় লোকসানের মিখ দেখতে হয়। বাজারে যখন চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে তেল মজুদ থাকে, তখন অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী দাম পড়ে যায়। ২০২০ সালে জ্বালানি তেলের চাহিদা হঠাৎ কমে যাওয়ায় তেল উত্তোলনকারী দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলো বিপদে পড়ে গিয়েছিল, যেহেতু জ্বালানি তেলের কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে অনেক তেল উত্তোলনকারী কোম্পানি বিশাল অংকের লোকসানের মুখে পড়ে দেউলিয়াত্বের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
পৃথিবীতে যেসব দেশ জ্বালানি তেল রপ্তানি করে থাকে, তাদের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসে এই তেল রপ্তানি থেকে। যেমন ‘ওপেক’ এর বাইরে থাকা রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। তাদের জাতীয় আয়ের প্রায় ৭০% আসে জ্বালানি তেল রপ্তানির মাধ্যমে। আমরা সবাই জানি, মোট জাতীয় আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি দেশ তাদের ‘বাজেট’ নির্ধারণ করে থাকে। এখন যদি দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে গিয়েছে, তাহলে স্বাভাবিকভাবে রাশিয়া কিংবা অন্যান্য তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর জাতীয় আয়ে সেটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জ্বালানি তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় রাশিয়ার মোট জাতীয় আয় কমে যাবে, ফলে দেশটির বাজেটে ঘাটতি দেখা দিবে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই বর্তমানে জনগণের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে থাকে, এই অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় বাজেটের মাধ্যমে৷ সুতরাং জাতীয় আয় কমে গেলে উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের গতি থেমে যাবে। এভাবে দেশটির জাতীয় উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি থেমে যাবে।
জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো শুধু যে রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করে, সেটার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ নয়। জ্বালানি তেলের রপ্তানির মাধ্যমে প্রাপ্ত মুনাফার একটা অর্থ আবার বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করা হয়। বিনিয়োগের ফলে একটি জ্বালানি তেল উত্তোলনাকারী প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পারে। যখন নতুন কোন তেলক্ষেত্র কিংআা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়, তখন সেখানে অসংখ্য জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একটি দেশের বেকারত্ব হ্রাস এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু যদি এমন হয়, যে জ্বালানি তেলের বাড়তি মুনাফা অর্জিত হচ্ছে না, তাহলে উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও কোন অর্থ ব্যয় করতে পারবে না। ফলে তাদের বাড়তি জনবলের প্রয়োজন হবে না, এভাবে নতুন কর্মসংস্থানেরও তৈরি হবে না। বরং এরকম অনেকবার দেখা গিয়েছে, যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতনের ফলে তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জনবল ছাটাই করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতনের ফলে প্রভাব পড়ে গবেষণাতেও। পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ সীমিত, একদিন তা শেষ হয়ে যাবে। মানবজাতি যদি শক্তির জন্য নতুন কোন উৎস বের করতে না পারে, তাহলে তার অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। তাই ১৯৯০ সাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে বিকল্প উৎসের সন্ধান। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশে সোলার প্যানেল ব্যবহার করে সূর্যের রশ্মি কাজে লাগিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে, যেটি সেই বিকল্প উৎস অনুসন্ধানের ফলাফল। সাধারণত যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়, তখন রাষ্ট্রগুলো এর বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করে, বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে৷ কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন হয়, তখন জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমেই শক্তির চাহিদা পূরণের ব্যাপারটি গুরুত্ব লাভ করে।
এবার আসা যাক আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতনের ফলে তেল আমদানিকারক দেশগুলোর অর্থনীতিতে কীভাবে প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে। সাধারণত যখন তেলের দরপতন ঘটে, তখন আমদানিকারক দেশগুলোর বেশ সুবিধা হয়। কারণ তাদের দেশের শিল্পকারখানা পরিচালনা ও পরিবহনের ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের স্বল্প মূল্য বাড়তি সুবিধা প্রদান করে, একটি পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে সহযোগিতা করে। এতে করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশাল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে সমর্থ হয়। এছাড়া নাগরিক জীবনেও জ্বালানি তেলের দরপতন বাড়তি সুবিধা এনে দেয়। যেমন ধরা যাক, একজন মানুষের যাতায়াতের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। যদি তার ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য জ্বালানি তেলের দাম সহনীয় মাত্রায় থাকে, তাহলে তিনি তার আয়ের একটি অংশ জ্বালানি তেলের পেছনে ব্যয় করে বাকি অর্থ অন্যান্য ক্রয়ের পেছনে ব্যয় করতে পারবেন। আর যদি জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়, তাহলে দেখা যাবে ব্যক্তির আয়ের একটি বড় অংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে জ্বালানি তেলের পেছনে, অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের পেছনে ব্যয় করার মতো অর্থ থাকছে না। তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, জ্বালানি তেলের দরপতন হলে আমদানিকারক দেশগুলোর জাতীয় অর্থনীতিতে সেটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে যেমন এক পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্য পক্ষ লাভবান হয়, ঠিক জ্বালানি তেলের দরপতনের ফলেও একই ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্পমেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হলেও আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য এটি বেশ সুবিধা বয়ে আনে। জ্বালানি তেলের দরপতন কিংবা মূল্য বৃদ্ধির ফলে সবসময়ই দেখা গিয়েছে এক পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্য পক্ষ লাভবান হচ্ছে।