দান-খয়রাত করার বিষয়টার সাথে সকলেই পরিচিত। নিজের সামর্থ্য না থাকলে কিংবা নিজে দান-খয়রাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন না করলেও ব্যাপারটি যে উদারতার একটি মহৎ উদাহরণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই দান করার কাজটি একেক জনের কাছে একেক ধরণের গুরুত্ব বহন করে। সবাই আসলে বিনা কারণে এই দান-খয়রাত করে না। এর পেছনেও লুকায়িত থাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ। দান-খয়রাতের বিষয়টা নিয়ে আসলে এত মাথা ঘামানোর কথা ছিল না। যে যার মতো দান করবে, যা খুশি দান করবে; এটা নিয়ে এত ভাবার কি হলো? তবে ব্যাপারটা অর্থনীতিবিদদের কাছেও সাড়া পেতে শুরু করে যখন এর সাথে একটি দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের একটি মেলবন্ধন খুঁজে পাওয়া গেল। একটি দেশের উন্নয়নের উপর সেই দেশে দান-খয়রাতের বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করে।
অনেক সময় কোনো কোনো দেশে সরকারিভাবে অনুদানের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে এই দান করার ব্যাপারে অনেকেই সচেতন। মূলত শিল্পোন্নত দেশে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে পরিস্থিতি হয় এর বিপরীত। কম মানুষই এই দান করার কাজে অংশগ্রহণ করে। দানের জন্য কেনা দ্রব্য নিয়ে আবার ঘটে জোতচুরির ঘটনা। যারা এই মহৎ কাজটি করে থাকে তাদেরকে আবার অনেক সময় হেনস্তার স্বীকার হতে হয়! কি ভয়ংকর ব্যাপার! দান-খয়রাতের কাজেও আজকাল বিপদ। তবে ঘটনা সত্য। কোন ধরণের দ্রব্য আপনি পুণ্য অর্জনের জন্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন সেটার উপরই নির্ভর করে আপনার সাথে কি ঘটতে যাচ্ছে।
যুগের পর যুগ দান-খয়রাতের কাজটি ধর্মতত্ত্বের একচেটিয়া দখলে ছিল। কোরআন হোক, বাইবেল হোক কিংবা যেকোনো ধর্মীয় গ্রন্থ; সব জায়গাই এই মহৎ কাজটির গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়। ব্যাপারটা আসলে বিশ্বাসের, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার-স্যাপার। অন্যদিকে, আামদের বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি যে মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত তা আসলে এই মহৎ কাজটির প্রতিকূলে। অর্থনীতিতে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয় যে, সকল মানুষই স্বার্থপর।
আর এরকম স্বার্থপর অর্থব্যবস্থায় দান-খয়রাত হলো অত্যন্ত অযৌক্তিক আচরণ। এমনকি ব্যক্তিগতভাবে করা এই দানের কাজটি অর্থনৈতিক তত্ত্বে উপেক্ষিত। তবে অর্থনীতিবিদরা ধীরে ধীরে এই ব্যাপারটিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা শুরু করে। আর অর্থনীতির এই শাখার নাম দেওয়া হয় ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ (Economics of Altruism)। এ সম্পর্কে এডাম স্মিথ তার বই ‘ওয়েলথ অব ন্যাশনস’-এ আলোচনা করেন। সেখানে তার মূল বক্তব্য ছিল, “মানুষ স্বার্থপর এবং বাজারে অদৃশ্য হাতের মাধ্যমে এই স্বার্থ চরিতার্থ হয়।
তবে একজন মানুষ একই সাথে কিভাবে স্বার্থপর এবং পরার্থপর হয় তা তিনি ব্যাখা করতে পারেন নি। এই দ্বন্দ্বটি ‘এডাম স্মিথ সমস্যা’ নামে পরিচিত। এডাম স্মিথ এর ব্যাখা না দিলেও ইংরেজ দার্শনিক ডেভিড হিউম এবং সমাজবিজ্ঞানী বোগারডাস সামাজিক মাপকাঠির প্রেক্ষিতে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেন।
তাদের মতে পরার্থপরতার অর্থনীতির তিনটি প্রধান প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, কেন এবং কারা এই দান-খয়রাত করে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, কি ধরণের দান-খয়রাত সবচেয়ে উপকারী? তৃতীয়ত, সামগ্রিক দিক থেকে দান-খয়রাত অর্থনীতির জন্য কতটা কল্যাণকর?
কারা এবং কেন দান-খয়রাতের কাজটি করে থাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বটে। কারণ কারা দান করে সেই বিষয়ে জানা থাকলে চাঁদা আদায়ে অধিকতর সফল হওয়া যাবে। এ বিষয়ে তিনটি মতবাদও রয়েছে। সাধারণত একজন ব্যক্তি জৈব তাড়নার বশে নিজের আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবার-পরিজনের মাঝে দান-খয়রাত করে থাকে।
দ্বিতীয়ত, মনস্তাত্ত্বিক বিষয়বস্তুও এক্ষেত্রে কাজ করে। যেমন যদি কেউ মাদকাসক্তি পছন্দ না করেন, তাহলে সে মাদকাসক্তিবিরোধী কোনো সংস্থায় চাঁদা দিবেন। তৃতীয় কারণ হতে পারে যে, সরকারের কাছ থেকে বাড়তি কোনো সুবিধা আদায়ের জন্য একজন ব্যক্তি দান-খয়রাত করছে। তবে এরকম পরিস্থিতি সাধারণত শিল্পোন্নত দেশ ছাড়া অন্য কোথাও দেখা সম্ভব নয়। এসব দেশে দান করলে কর-অব্যাহতি পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারিভাবে গৃহীত এই পদক্ষেপটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে করের হার প্রায়শই বেশি থাকে যার ফলে ব্যক্তিবিশেষের আয় হ্রাস পায়। অন্যদিকে কর-অব্যাহতি পাওয়ার আশায় অনেকে দান-খয়রাত শুরু করে। তবে এখানে আয়, কর এবং কর-অব্যাহতির পরিমাণ এবং হিসাব স্পষ্ট না হওয়ায় বোঝা কষ্টকর যে এই ব্যবস্থায় লাভ হচ্ছে নাকি ক্ষতি।
পরের প্রশ্নটি ছিল কি রকমের দ্রব্য দান-খয়রাতে দেওয়া উপকারী। আয়ের প্রেক্ষিতে সাধারণত তিন ধরণের দ্রব্য রয়েছে। যেমন- স্বাভাবিক পণ্য (Normal good), বিলাস পণ্য (Luxury good) এবং নিকৃষ্ট পণ্য (Inferior good)। যেসকল পণ্যের চাহিদা আয় বাড়লে আরো বেড়ে যায় তবে আয় কম থাকলেও প্রয়োজনের তাগিদে এদের চাহিদা সবসময়ই থাকে সেগুলোকে স্বাভাবিক পণ্য বলে। এগুলোর চাহিদা ধনী-গরীব সবার মধ্যেই থাকে। চাল, ডাল, আটা এর বাস্তব উদাহরণ। বিলাস পণ্য হলো সেইসব পণ্য যা স্বাভাবিক পণ্য কেনার পরও ক্রেতার ক্রয় করার সামর্থ্য থাকলে তা কিনে বা কেনার ইচ্ছা থাকে।
এই ধরনের দ্রব্যের চাহিদা শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত কিংবা ধনীদেরই থাকে। এসব পণ্যের জরুরি কোনো প্রয়োজন থাকে না, অধিক আরাম বা আনন্দের জন্যই এদের চাহিদা। যেমন- কোনো নামি-দামি ব্র্যান্ডের শার্ট, এসি ইত্যাদি। আর নিকৃষ্ট পণ্য হলো নিতান্তই খারাপ মানের কোনো পণ্য যা অভাবের তাগিদে স্বাভাবিক পণ্য কিনতে না পারায় বাধ্য হয়ে কিনতে হয়। আয় বাড়লে এর চাহিদাও কমে যায়। ধনী ও গরীব সবার ক্ষেত্রেই এই ঘটনাটি সত্য। যেমন- নিকৃষ্ট মানের চাল, গম।
এখন যদি বলি এই নিকৃষ্ট পণ্যই মূলত দান করা উচিত তাহলে ব্যাপারটি আপনারা কিভাবে নিবেন? অনেকের কাছে বিষয়টি হয়ত অমানবিক মনে হবে। কেউ হয়ত বা নৈতিক শিক্ষাও দেওয়া শুরু করে দিবেন। তবে মাঝে মাঝে কোনো ঘটনাকে আবেগের তাড়নায় বিবেচনা না করে বাস্তববাদী হয়ে চিন্তা করা উচিত। দানের পণ্যসামগ্রী এমন হওয়া উচিত যা দরিদ্রদের কাজে আসবে, তবে বড়লোকদের বা ক্ষমতাবানদের আকৃষ্ট করবে না। প্রায়ই খবরে দেখা যায় যে, দানের সামগ্রী গরীবদের ঠিকমত বণ্টন করা হয়নি কিংবা সকলে এসব পণ্য পায়নি। মাঝপথেই ক্ষমতাবানদের হাতে হাতে এসব বিলি হয়ে যায়।
কেননা, সাধারণত স্বাভাবিক পণ্যই (চাল, ডাল, আটা ইত্যাদি) দান করা হয় বা অনুদান হিসেবে দেওয়া হয় যার চাহিদা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবারই থাকে। এই অবৈধ ভোগ কমানো যায় দুইভাবে। একটি উপায় হলো প্রশাসন যদি একটি এলাকায় কারা ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য তা খুঁজে বের করে এবং শুধুমাত্র তাদের হাতেই ত্রাণসামগ্রী দেয়। কিন্তু সত্যি বলতে এটা বেশ ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর বটে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে কাজটা শেষ করাও কঠিন। আরেকটি উপায় আছে যা একটি বাজারভিত্তিক সমাধান। গরিবরা এতে উপকৃতও হবে কিন্তু মানবিক দিক থেকে এটা কতটুকু ঠিক তা নিয়ে একটু সন্দেহ আছে।
সমাধানটা হলো নিকৃষ্ট পণ্য বিলিয়ে দেওয়া। এতে করে ধনীরা গরিবদের ত্রাণসামগ্রীর প্রতি আকৃষ্ট হবে না। বিত্তবানরা এগুলো ভোগ করার জন্যে গরীবদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে উৎসাহিত হবে না। ফলে এসব পণ্য আসলেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কাছে পৌছাবে। আবার দানকারীদের দান করতে গিয়ে কোনো প্রকার হেনস্তার স্বীকারও হতে হবে না। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির উপর দান-খয়রাতের প্রভাব কতটুকু তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। এই বিতর্কের শুরু হয় আঠারো শতকে। ইংল্যান্ডে সেই সময় গরীব আইন চালু ছিল। এই আইন অনুসারে, স্থানীয়-সরকারসমূহ তাদের প্রাপ্ত আয় থেকে কিছু অংশ গরিবদের ভরণপোষণের জন্য ব্যবহার করবে। আপাতদৃষ্টিতে আইনটি ভালো মনে হলেও এর কুফল সম্পর্কে অবহিত করেন ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ ম্যালথুস।
তার মতে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দরিদ্রদের সহায়তা করলে তারা রাষ্ট্রের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাবে। গরীবরা এই সাহায্যের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা শুরু করে এবং বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। পরবর্তী প্রজন্ম সরকারের উপর আরো বেশি নির্ভরশীল হতে শুরু করে। এতে কাজের প্রতি তাদের স্পৃহাও কমে যায়। যা অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা এবং প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ দান-খয়রাত নয়, বরং সকলে যাতে কাজ করে রোজগার করতে পারে সেই ব্যবস্থা করলেই একটি দেশ বেশি লাভবান হবে।
দান-খয়রাতের মতো বিষয়ের মৌলিক তাগাদা পরার্থপরতা হলেও অর্থনীতির মৌলিক উপাদানসমূহ অস্বীকার করে তা করলে কখনই ভালো হবে না। শুধুমাত্র গরীবদের সাহায্য করার সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়। তাদেরকে এমনভাবে সহায়তা করতে হবে যাতে তারা পরনির্ভর না হয়ে উঠে এবং দেশের অর্থনীতিরও ক্ষতি না হয়৷ এক্ষেত্রে বাজারের অদৃশ্য হাতকে অগ্রাহ্য করে এই বিষয়ে কোনো নীতি প্রণয়ন করলে তা সফল হবে না, আর হলেও এর ফল হবে সীমিত।
দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে বাজার-অর্থনীতির তিনটি অনুশাসন অবশ্যই মোনে চলতে হবে। প্রথমত, গরীবদের এমনভাবে সাহায্য করা যাবে না যাতে তারা কাজ করতে নিরুৎসাহিত হয়। এরকম ব্যবস্থা কখনও টেকসই হবে না। দ্বিতীয়ত, যতদিন পর্যন্ত সমাজে বিত্তবানদের আধিপত্য রয়েছে ততদিন নিকৃষ্ট পণ্যই দান করা ভালো হবে। তৃতীয়ত, গরীবদের কর্মসূচি হতে হবে বাকি কর্মসূচি থেকে আলাদা। সবার জন্য একই কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে তা কখনও সফল হবে না।