শায়েস্তা খাঁ-এর আমলের সেই বিখ্যাত এক টাকার মূল্য এখন কত? মূল্য যেটাই হোক, বর্তমান বিচারে এক টাকা যে অত্যন্ত নগণ্য একটি মুদ্রা সেটি বিশদ বর্ণনা করা অপ্রয়োজনীয়। ব্যাপারটা আরো ভালো করে বোঝা যায় মুদি দোকানে গেলে। ওখানে এক টাকার ব্যবহার প্রায় উঠেই গেছে, এক টাকার পরিবর্তে দেয়া হচ্ছে চকলেট!
শায়েস্তা খাঁর আমল রেখে আমরা কয়েকটা বছর আগের কথাই ধরি। তখন দশ টাকায় সুস্বাদু ভ্যানিলা ফ্লেভারের কাপ আইসক্রিম পাওয়া যেত। সেই আইসক্রিম বাজারে এখনো পাওয়া যায়। তবে দশ টাকা দামে নয়, বিশ টাকা দামে।
দাম বেড়েছে কিন্তু আইসক্রিমের স্বাদ এবং পরিমাণে কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ আগে যা কেনার জন্য আমরা দশ টাকা খরচ করতাম, এখন সেই একই পণ্যের জন্য আমাদের গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ টাকা। এর জন্য দায়ী মুদ্রাস্ফীতি নামক এক শব্দ, যাকে ইংরেজিতে বলে Inflation।
মুদ্রাস্ফীতি কী?
জটিল এই প্রশ্নটির উত্তর সহজভাবে উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। মনে করুন, আপনি দশ টাকার চকচকে একটা নোট নিয়ে বাইরে বের হলেন। খানিকটা হাঁটতেই দেখলেন রাস্তার ধারে এক লোক গরম তেলে সিঙ্গারা ভেজে উঠাচ্ছে। কেনার জন্য দোকানদারের কাছে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করলেন, এবং উত্তর এলো একটার দাম পাঁচ টাকা। আপনি আপনার দশ টাকা দিয়ে দুটি সিঙ্গারা নিলেন।
কিন্তু কোনো কারণে যদি একটার দামই বেড়ে দশ টাকা হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আপনি দুটি সিঙ্গারা কিনতে পারবেন না। আপনাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে একটি সিঙ্গারা নিয়েই। অর্থাৎ মূল্য বৃদ্ধি পেলে একই পণ্য ক্রয় করার জন্য আমাদের আরও বেশি টাকা প্রয়োজন হয়। ফলে পণ্যটি কেনার সক্ষমতাও আমাদের কমে যায়। আর এই অবস্থাকেই অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় মুদ্রাস্ফীতি।
মুদ্রাস্ফীতি কেন হয়?
প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের আগে আগে ইলিশ মাছের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়। কারণ ব্যবসায়ীরা জানে যে, আপনি না কিনলেও অন্য কেউ ঠিকই বেশি টাকা দিয়ে হলেও মাছ কিনবে। তাই তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দেয়। যে মাছটা কয়েকদিন আগেও আপনি পাঁচশ টাকায় কিনেছেন, ঠিক সেই মাছটাই আপনার চোখের সামনে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে যাবে। দোকানদার একবার যখন দুই হাজার টাকায় একটা ইলিশ বিক্রি করবে, তখন সে বাকিগুলোর দামও এমনই হাঁকাবে। তার দেখাদেখি অন্য বিক্রেতারাও পিছিয়ে থাকবে না। ফলস্বরূপ ইলিশ মাছের দাম বেড়ে যাবে তিনগুণ, চারগুণ!
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বেশি টাকা ছাপিয়ে ফেলে সেক্ষেত্রেও মানুষের কাছে অতিরিক্ত টাকা চলে আসবে। মানুষের কাছে যখন বেশি টাকা থাকবে তখন তার কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি নিজের করে নেয়ার জন্য বেশি টাকা পরিশোধ করতেও বিচলিত হবে না। ফলে ইলিশ মাছের মতো সব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি হবে। এজন্য ইচ্ছা করলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক যত খুশি টাকা ছাপাতে পারে না। অনেক জটিল হিসাব-নিকাশ করে তারপর টাকা বাজারে ছাড়ে।
এখন আবার সেই গরম গরম সিঙ্গারায় ফেরত যাই। আপনি একটা সিঙ্গারা শেষ করে হঠাৎ খেয়াল করলেন পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় সিঙ্গারার সাথে পেঁয়াজ দেয়া হয়নি। কিন্তু পেঁয়াজের দাম না বেড়ে যদি আলুর দাম বাড়ত তখন কেমন হতো? আলু ছাড়া তো আর সিঙ্গারা হয় না! উত্তরটা সহজ- তখন সিঙ্গারার দাম বাড়িয়ে দিতে হতো। একই কারণে মাংস বা চালের দাম বাড়লে বিরিয়ানির দাম বেড়ে যায়। চামড়ার দাম বাড়লে জুতার দাম বেড়ে যায়। শুধু কাঁচামালের মূল্য নয়, শ্রমিকদের মজুরি এবং আনুষঙ্গিক নানা খরচের পরিমাণ বৃদ্ধিও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি ঘটানোর জন্য দায়ী।
সিঙ্গারায় পেঁয়াজ না পেয়ে সারাদেশে পেঁয়াজ সংকটের কথা হঠাৎ মনে পড়ল আপনার। প্রচুর চাহিদা কিন্তু যোগানের অভাব। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। অর্থাৎ যদি চাহিদা থাকে কিন্তু পর্যাপ্ত যোগান না থাকে, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি উঁকি দিতে দেরি করবে না একটুও।
মুদ্রাস্ফীতি কি আসলেই ভিলেন?
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ যাবতীয় পণ্য বা সেবার মূল্যবৃদ্ধি হয় মুদ্রাস্ফীতির কারণে এ কথা সত্যি। তবে একটু অন্যভাবে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে, মুদ্রাস্ফীতি জিনিসটা অতটাও খারাপ না।
মুদ্রাস্ফীতি যখন হয় তখন সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ আশঙ্কা করে ভবিষ্যতে হয়তো মূল্য আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে তারা বেশি করে তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে রাখতে চায়। যেমন- লবণের দাম বেড়ে যাওয়ার গুজবে সবাই দশ কেজি, পনের কেজি করে লবণ কিনতে শুরু করেছিল! অর্থাৎ (শুনতে অদ্ভুত ঠেকলেও) মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। চাহিদা বেড়ে গেলে ভোগ বেড়ে যায় এবং বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাড়তি যোগানের ব্যবস্থা করতে হয়। ফলে নতুন পণ্য উৎপাদন করা শুরু হয় এবং নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়। যার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এছাড়া দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা নতুন নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী হয়, যেন তারা বেশি লাভ করতে পারে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মুদ্রাস্ফীতিকে বেশ উপকারীই বলা চলে!
তবে মুদ্রাস্ফীতিকে একেবারেই নায়কের আসনে বসিয়ে দেয়া যায় না। এর প্রধান কারণ হলো জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। ফলে দ্রব্য বা সেবার জন্য মূল্য পরিশোধের অক্ষমতা সৃষ্টি হয়।
দশ বছর আগে যে দূরত্বের রিকশা ভাড়া ছিল বিশ টাকা, এখন হয়তো সেটা পঞ্চাশ টাকা হয়ে গেছে। আবার চালের দাম হয়তো ছিল চল্লিশ টাকা কেজি, এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ষাট টাকা কেজিতে। এভাবে প্রত্যেকটা পণ্যের দাম বেড়ে গেলেও কারো বেতন হয়তো সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার জীবনযাত্রার মানে একটা বিশাল পরিবর্তন দেখা দেবে। মুদ্রাস্ফীতির জন্য অবসরপ্রাপ্ত কিংবা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের দুর্ভোগটা হয় অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি।
এবার ধরুন, আপনার কাছে এক লাখ টাকা আছে। আপনি ঠিক করলেন, এই টাকা দিয়ে আপনি একটি আইফোন এবং একটি ল্যাপটপ কিনবেন। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির জন্য আইফোন এবং ল্যাপটপ দুটোর দামই বেড়ে যদি এক লাখ টাকা হয়ে যায় সেক্ষেত্রে আপনাকে হয় ল্যাপটপ অথবা আইফোন কিনতে হবে। এরকম একটি সুযোগ গ্রহণ করে আরেকটি হাতছাড়া করাকে বলে সুযোগ ব্যয়। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির জন্য সুযোগ ব্যয় বেড়ে যায়। তখন আপনার অনেকগুলো চাহিদা থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।
আবার, যেহেতু ভবিষ্যতে টাকার মূল্য কমে যাবে তাই আজকে আপনার বন্ধু বা ব্যাংক আপনাকে যে মূল্যের টাকা ঋণ দেবে, ফেরত নেয়ার সময় কিন্তু সেই টাকার মূল্য একই থাকবে না। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুন করে সুদের হার বের করতে হবে, যেন আপনার বন্ধু বা ব্যাংক টাকা ফেরত নেয়ার সময় সঠিক মূল্যের অর্থ ফেরত পায়।
শেষ কথা
আসলে মুদ্রাস্ফীতি নায়ক কিংবা খলনায়ক কোনোটাই না! দেশের অর্থনীতি ঠিকঠাক রাখার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রাস্ফীতির প্রয়োজন আছে। তবে সেটা কম-বেশ হয়ে গেলে সমস্যা। অনেক বেশি মুদ্রাস্ফীতির জন্য জিম্বাবুয়েতে একসময় কাড়ি কাড়ি টাকা মাথায় নিয়ে বাজারে যেতে হতো! ভেনিজুয়েলায় ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া মুদ্রাস্ফীতি দেশটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই মুদ্রাস্ফীতি অনুকূলে রাখতে প্রত্যেকটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বসতে হয় জটিল সব হিসাব-নিকাশে।