গত দুই দশকের কম সময়ের মধ্যে ইন্টারনেট আমাদের জীবনকে অবিশ্বাস্যভাবে বদলে দিয়েছে। ইন্টারনেট কেনাকাটা থেকে শুরু করে যোগাযোগ, সংবাদপ্রাপ্তি পর্যন্ত আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিক পরিবর্তন। এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার বিকাশের ধরনকে প্রভাবিত করেছে। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেটের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছে, এবং আরো অনেকে এই ধরনের সফলতার প্রত্যাশাও করছে।
তবে ইন্টারনেটের সম্ভাবনা সম্পর্কে উদ্যোক্তাদের অত্যাধিক আশাবাদী হওয়াই নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে কুখ্যাত ‘ডটকম বাবল’ তৈরি করেছিল। সতর্ক না থাকলে বা সঠিকভাবে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা না করলে ভবিষ্যতে বাজারে আরেকটি বাবল তৈরি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
ডটকম বাবল কী?
ডটকম বাবল হলো স্টক মার্কেটের বাবল, যা ১৯৯৫-২০০০ সাল পর্যন্ত ডটকম বা ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসায় স্পেকুলেশন বা জল্পনা-কল্পনার কারণে সৃষ্টি হয়। এটি ইন্টারনেট বাবল নামেও পরিচিত। এর ক্ষতির শিকার হওয়ার বেশিরভাগ কোম্পানির ইন্টারনেট ঠিকানায় ডটকম (.com) ডোমেইন ছিল। আসলে ডটকম বাবলের উৎপত্তি ১৯৮৯ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (World Wide Web)-এর সূচনা, নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলোর প্রতিষ্ঠা, এবং নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ক্রমবর্ধমান গতিতে এসব বাড়তে থাকার কারণে। এই সময়টি অনলাইন কেনাকাটা, যোগাযোগ ও সংবাদের উৎস থেকে ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহারের বিষয়টি চিহ্নিত করেছে।
নব্বইয়ের দশকের ডটকম বা ইন্টারনেট বাবল
বিংশ শতকের শেষের দিকে ইন্টারনেটের বিস্তৃতি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার পরিধিকে আরো প্রসারিত করে, এবং ভবিষ্যতে অনলাইন ব্যবসার সফলতা নিয়ে মানুষের মনে অনুপ্রেরণা যোগায়। মূলত এই আশায় নতুন করে অনেক ইন্টারনেটভিত্তিক কোম্পানি (‘ডটকম’ নামে পরিচিত) চালু করা হয়েছিল, এবং বিনিয়োগকারীরা ধরেই নিয়েছিল যে অনলাইনে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাচ্ছে এমন একটি কোম্পানির মূল্য সাধারণ কোম্পানির তুলনায় কয়েক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।
তবে স্পষ্টতই বেশিরভাগ ডটকম বা ইন্টারনেটভিত্তিক কোম্পানি আশানুরূপ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আর যেগুলো সফল হয়েছিল, সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল অতিমূল্যায়িত। ফলে এসব কোম্পানিতে নেমে আসে ধস, যার কারণে বিনিয়োগকারীরা বেশ ক্ষতির শিকার হয়। প্রকৃতপক্ষে, ইন্টারনেট মার্কেটের এই পতন ২০০১ সালের স্টক মার্কেটের পতনকে আরো ত্বরান্বিত করে। সামগ্রিকভাবে, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেট নিয়ে মানুষজনের প্রত্যাশা ছিল অবাস্তব ও আকাশচুম্বী। স্বতন্ত্র ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী হোক, কিংবা বড় কোনো কর্পোরেশন, সকল ইন্টারনেট উদ্যোক্তাই ডটকম মিলিয়নিয়ার বা বিলিয়নিয়ার হওয়ার স্বপ্নে মগ্ন ছিল। এ সকল উদ্যোক্তা অ্যামাজন (Amazon), ইবে (eBay) এবং কজমো (Kozmo)-এর মতো কোম্পানিগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। কিন্তু তারা এটা ভুলে গিয়েছিল যে, একটি কোম্পানি মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলারে ব্যবসা করছে মানে সমসাময়িক অনেক কোম্পানির ব্যবসাই ব্যর্থ হয়েছে। তাই ব্যবসার মৌলিক বিষয়গুলো পর্যালোচনা না করে সবার দেখাদেখি কোনো খাতে বিনিয়োগ করা উচিত নয়।
অনেক বিনিয়োগকারীই স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করার কিছু মৌলিক নিয়ম, যেমন- মূল্য-আয় অনুপাত বিশ্লেষণ, বাজার ক্ষমতা অধ্যয়ন, এবং ব্যবসায়িক পরিকল্পনা পর্যালোচনার মতো বিষয়গুলো উপেক্ষা করেন। এসবের পরিবর্তে বিনিয়োগকারীরা এবং উদ্যোক্তারা এমন এক নতুন ব্যবসায়িক ধারণা নিয়ে পড়ে থাকেন, যার মার্কেট পটেনশিয়াল বা বাজার সম্ভাবনা তখনও প্রমাণিত হয়নি। তাছাড়া, ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক ল্যারি ইলিয়ট ডটকম বা ইন্টারনেট বাবল যে ফাটতে চলেছে, সেটার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেও তারা তা অগ্রাহ্য করে চলেন।
ডটকম বাবল ফেটে যাওয়ার পেছনে প্রধান কিছু কারণ
নিম্নলিখিত কারণগুলোকে ডটকম বাবল ফেটে যাওয়ার পেছনে দায়ী করা যেতে পারে।
১. ডটকম কোম্পানিগুলোর অতিমূল্যায়ন
ডটকম বাবল তৈরি হয়েছিল একটি নতুন আবিষ্কার ‘ইন্টারনেট’-এর অতিরিক্ত জনপ্রিয়তার কারণে। এই ইন্টারনেট নব্বইয়ের দশকের আগেও বিদ্যমান ছিল। তবে বাবল তৈরির শুরু যখন তা গণতন্ত্রীকরণ করা হয়, এবং এর ফলে অনেক কোম্পানি আইপিও ধারণ করার সুযোগ পায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং সঠিক মূল্যায়ন মডেলের অভাবে আইপিও ধারণকৃত বেশিরভাগ প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোকে উচ্চ মূল্যায়ন করা হয়েছিল সেই সময়। ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর মূল্যায়নে উচ্চ মূল্য গুণক ব্যবহার করা হয়। এর ফলে প্রাপ্ত অবাস্তব মানগুলো বেশ আশাবাদী করে তোলে সকলকে। কিন্তু বিশ্লেষকরা এই ব্যবসাগুলোর মৌলিক বিশ্লেষণে ফোকাস করেনি, এবং রেভিনিউ জেনারেশন ক্যাপাবিলিটি বা আয় উৎপাদন ক্ষমতা আছে কিনা সেটাও ভালোমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা জরুরি মনে করেনি। কারণ, এসব কোম্পানি ওয়েবসাইট ট্রাফিক ম্যাট্রিক্সের ওপর ফোকাস করে ঠিকই, তবে তা কোনো মূল্য সংযোজন ছাড়াই।
২. মূলধনের প্রাচুর্য
বিনিয়োগকারীদের দ্বারা প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটভিত্তিক কোম্পানি বা স্টার্ট-আপগুলোতে অতিরিক্ত অর্থ ঢালা ডটকম বাবলের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। তাছাড়া, খুব কম সুদের হারের মাধ্যমে প্রাপ্ত সস্তা ফান্ড বা তহবিলগুলো মূলধনকে সহজলভ্য করে তোলে। এ কারণে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর জন্য ফান্ড বা তহবিল অর্জনে বেশি বেগ পেতে হয়নি। খুব সহজেই অনেকে এই সেক্টরে বিনিয়োগ করা শুরু করে, যা ডটকম বাবলকে আরো প্রসারিত করে।
৩. মিডিয়া উন্মাদনা
মিডিয়া কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যতের রিটার্নের ওপর অত্যাধিক আশাবাদী করে তোলে এবং ‘দ্রুত বড় হও’ এই মন্ত্রের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তি বা ইন্টারনেট স্টকগুলোতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রকাশনা, যেমন- দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ফোর্বস, ব্লুমবার্গ এবং অনেক বিনিয়োগ বিশ্লেষণ প্রকাশনা- তাদের মিডিয়া আউটলেটগুলোর মাধ্যমে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে এবং ডটকম বাবলকে আরো স্ফীত করতে সহায়তা করে। ১৯৯৬ সালে ৫ ডিসেম্বর অ্যালান গ্রিনস্প্যানের একটি বক্তব্য ডটকম বাবলকে আরো স্ফীত করে তোলে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যালান আর্থিক বাজারের ‘ইরর্যাশনাল এক্সাবারেন্স’ বা ‘অযৌক্তিক উচ্ছ্বাস’ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। এই বক্তব্য বাজারের অবস্থাকে স্থিতিশীল করার কথা ছিল। তবে আসলে ঘটে এর উল্টো। অনেকেই এই বক্তব্যকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু করে, এবং ভাবতে শুরু করে যে এটা সেই সময়ের তথা ডটকম বাবলের সময়ের পক্ষে একটি বক্তব্য।
অর্থনীতিতে ডটকম বাবলের প্রভাব
ডটকম বাবল শুধুমাত্র হালকা মন্দাই সৃষ্টি করেনি, বরং এটি একটি নতুন ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প নির্মাণের ওপর মানুষের আস্থার বিষয়েও নাড়া দেয়। যার ফলে পরবর্তীতেও নতুন শিল্প তৈরি করার ক্ষেত্রে মানুষ অতিরিক্ত চিন্তায় পড়ে যায়। এর প্রভাব এতটাই তীব্র ছিল যে, অনেক সফল কোম্পানিও এই আঘাতের শিকার হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইন্টেলের স্টকের কথা বলা যেতে পারে, যা আশির দশক থেকেই আর্থিক বাজারে ছিল। তবে যখন ডটকম বাবল ফেটে যায়, তখন ইন্টেলের শেয়ারগুলোতে পতন দেখা যায়। কোম্পানিটি সরাসরি ডটকম বাবলের সাথে সম্পর্কিত না থাকা সত্ত্বেও কোম্পানিটি এই বাবল দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর পরবর্তীতে ইন্টেলকে বেশ সংগ্রাম করতে হয় তাদের শেয়ারগুলোর মূল্য স্থিতিশীল করার জন্য।
সামগ্রিকভাবে, এই ডটকম বাবল ফেটে যাওয়ার কারণে কোম্পানিগুলোর তুলনায় বিনিয়োগকারীরাই বেশি ক্ষতির শিকার হন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৪৮% ডটকম কোম্পানি ডটকম বাবল ফেটে যাওয়ার পরও রক্ষা পেয়েছিল, যদিও তাদের কোম্পানির বাজার মূল্য বেশ কমে যায়। ২০২১ সালে গেমস্টপসহ নতুন বেশ কিছু প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানি দ্বারা আইপিও জারির আকস্মিক বৃদ্ধি আবারও অনেক বিনিয়োগকারীকে সম্ভাব্য ইকোনমিক বাবলের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
নতুন প্রযুক্তি প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে একটি বাবল বা বুদবুদ তৈরি করে। যদিও সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগিং এবং ই-কমার্সের সুযোগ-সুবিধার দরুন এগুলোর প্রতি ঝুঁকে পড়াটাই স্বাভাবিক, তবুও কোনো কোম্পানিতে বা শেয়ারে বিনিয়োগ করার আগে উত্তেজিত না হয়ে কোম্পানির বিষয়ে ভালোমতো খোঁজ-খবর নেওয়া এবং বিশ্লেষণ করাটা জরুরি। এটা মনে রাখতে হবে যে, সম্ভাব্য বাবল বা বুদবুদে বিনিয়োগ করে অর্থ হারানোর সম্ভাবনা এখনও বিদ্যমান। ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করা অবশ্যই দোষের কিছু নয়। তাছাড়া, সবসময় বিনিয়োগকারী যে ক্ষতির শিকার হবে সেটাও নয়। কিন্তু এসকল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো কোম্পানির মতোই বিনিয়োগ করার পূর্বে কোনো গুঞ্জনে কান না দিয়ে তাদের ব্যালেন্স শিট ও লাভজনকতা (Profitability) দেখতে হবে।