“যদি আপনি কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে কিছু করাতে চান, তাহলে সেই কাজটি সহজ করে দিন। যদি আপনি চান সকলে যেন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে উৎসাহী হয়, তাহলে ক্যাফেটেরিয়াতেও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা রাখুন। অর্থাৎ তারা যেন সহজে তা খুঁজে পায় এবং তা যেন সুস্বাদু হয় সেই ব্যবস্থা করুন। তাই আমি প্রত্যেক সাক্ষাৎকারে বলি, ‘সহজ করুন’।”
উক্তিটি অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী রিচার্ড থ্যালারের। মানুষের আচরণের পরিবর্তনের কারণ বা কোনো উদ্দীপক কীভাবে কাউকে প্রভাবিত করে তা বোঝাতে গিয়ে তিনি উল্লেখ্য উক্তিটি করেন। বিহেভিয়রাল ইকোনমিকস বা আচরণগত অর্থনীতি নিয়ে বিস্তর গবেষণার কারণে তিনি নোবেল পুরষ্কারও লাভ করেন। বিহেভিয়রাল ইকোনমির মূল আলোচ্য বিষয় হলো, কোনো অবস্থা বা উদ্দীপক কীভাবে একজন ব্যক্তির আচরণের উপর প্রভাব ফেলে তা নিয়ে। তবে এর মূল উদ্দেশ্য কাউকে পরিবর্তন করা নয়, বরং তার জীবন ‘সহজ করা’। থ্যালারের গবেষণার মূল বিষয় ছিল ‘নাজ ইকোনমি’। এটি বিহেভিয়রাল ইকোনমির একটি বিশেষ অংশ। আর আজকের আলোচনা এই নাজ ইকোনমি নিয়েই।
নাজ
নাজ হলো এমন একটি নীতি বা ধারণা, যা একজন মানুষের চিন্তাভাবনা, পছন্দ বা ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। এখন এই প্রভাব ভালো হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, ইতিবাচক নাজ যখন বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়, তখন তা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
নাজ থিওরির নামকরণ এবং এ সম্পর্কে প্রথমবারের মতো আলোচনা হয় ২০০৮ সালে রিচার্ড এইচ থ্যালার এবং ক্যাস আর সান্সটেইনের প্রকাশিত বই “নাজ: ইম্প্রুভিং ডিসিশনস অ্যাবাউট হেলথ, ওয়েলথ অ্যান্ড হ্যাপিনেস” এ। এই বই প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আমেরিকার সরকার এই নাজ ইকোনমির বিষয়গুলো খুব গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করা শুরু করে।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং সেই বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টকে এই বিহেভিয়রাল ইকোনমিকস গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেন, যা জনগণের অধিকারগুলো, যেমন- ভালো চাকরি খোঁজা বা স্বাস্থ্যকর জীবন গড়ে তোলার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
২০১০ সালে যুক্তরাজ্যে নাজ তথা বিহেভিয়রাল ইকোনমি নিয়ে সরকার ‘বিহেভিয়রাল ইনসাইটস টিম (বিইটি)’ বা নাজ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে। একে ২০১৪ সালে আংশিকভাবে বেসরকারি করা হয়, এবং সেই সময়ে নাজ ইউনিটের কর্মচারী ছিল মাত্র ১৪ জন। তারা সবাই লন্ডনেই কর্মরত ছিলেন। তবে বর্তমানে নাজ ইউনিটের লন্ডন, নিউ ইয়র্ক এবং সিডনি শাখায় প্রায় ৭০ জন এই কাজে নিয়োজিত। আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্য এই বিহেভিয়রাল ইকোনমি প্রয়োগ করা শুরু করলে অন্যান্য দেশও এর ব্যবহার শুরু করে। যেমন- কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, এমনকি এশিয়ার অনেক দেশেও এর ব্যবহার দেখা যায়।
নাজ কি ভালো না খারাপ?
রিচার্ড থ্যালারকে যখনই তার বই ‘নাজ’-এর কপিতে সাইন করতে বলা হয়, তখনই তিনি “নাজ ফর গুড” অর্থাৎ “ভালো কিছুর জন্য নাজ” লিখে দেন। এর ব্যাখা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “এটি একটি অনুরোধ, কোনো প্রত্যাশা নয়”। তার এই উক্তিটি থেকেই বোঝা যাচ্ছে, নাজ খারাপও হতে পারে এবং এ নিয়ে থ্যালার তার শঙ্কার প্রেক্ষিতেই কথাটা বলেন। কেননা, এই নাজের বিষয়টি কেউ কেউ অন্যদেরকে নিজেদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে পারে। থ্যালার বলেন, “কোনো ব্যক্তি আপনাকে নিজের স্বার্থের জন্য কাজে লাগাতে পারে। বার্নি ম্যাডফ (আমেরিকার সাবেক স্টকহোল্ডার ও বিনিয়োগকারী) সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জয় করে তা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন। আমার মনে হয় না যে, আমার বই তার পড়ার কোনো প্রয়োজন ছিল। আমার মনে হয় তিনি আমার থেকেও ভালো বই লিখতে পারতেন”।
যারা নাজ থিওরির পক্ষে কথা বলেন, তারাও এই একই কারণে এর সমালোচনাও করেন। যেমন- হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অধ্যাপক ম্যাক্স ব্যাজারম্যান এ বিষয়ে তার সন্দেহ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, “প্রশ্ন হলো, আমরা কি মানুষের আচরণ ‘প্রভাবিত করছি’, নাকি ‘ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছি’”। “এটি একটি জটিল বিষয়। বিহেভিয়রাল ইকোনমিক্স হলো একজন ব্যক্তি সবসময় কেন তার জন্য যেটা সবচেয়ে ভালো সেটা বেছে নেয় না তা নিয়ে আলোচনা করে। তবে এর পূর্বে নির্ধারণ করে নিতে হবে যে, কোন ব্যবস্থাটা গ্রহণ করা ঠিক হবে”।
কারো কোনো স্বভাব বা অবস্থাকে ‘নাজ’ করা এবং কোনো ব্যক্তিকে তার ইচ্ছা বা অভিমত পরিবর্তনে বাধ্য করার মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি ইতিবাচক নাজ সবসময় ভালো কিছু বেছে নিতে সহায়তা করে, তবে তা জোর করে নয়।
তবে এজন্য নাজগুলো অবশ্যই স্বচ্ছ ও স্পষ্ট থাকতে হবে। অর্থাৎ যে নাজের কথা বলা হবে, সেটার জন্য কত খরচ পড়তে পারে বা কী কী দরকার হতে পারে এবং নাজের উপকারিতা বা প্রভাব কী তা ঠিকমতো উল্লেখ করা লাগবে। কোনো ব্যক্তি কোনো নাজ বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করবে কি না তা অবশ্যই সেই ব্যক্তির ইচ্ছার নির্ভর করবে। তার মতামতই প্রাধান্য পাবে এক্ষেত্রে। তবে নাজ আপনাকে অনেক সময় কোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার আগাম বার্তা দেয়। তাই সকলের বুঝে শুনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তবে এরকমও হতে পারে যে, কোনো ব্যাপারে নাজ কাজে লাগলো না। যেমন- ধূমপান কমানোর জন্য এর ক্ষতিকারক প্রভাব সবাইকে বোঝানো বা নাজই যথেষ্ট নয়। এর সাথে বিভিন্ন নীতিও গ্রহণ করা জরুরি। এর মধ্যে আছে সিগারেটের উপর অধিক কর দেওয়া, ধূমপানের জন্য কিছু স্থান ঠিক করে দেওয়া এবং এ সকল এলাকার বাইরে ধূমপান নিষিদ্ধ করা।
কয়েকটি বাস্তব নাজের উদাহরণ
২০১৬ সালের প্রথমদিকে ভারতের মুম্বাইসহ সমগ্র মহারাষ্ট্র প্রদেশে প্রচণ্ড খরার কারণে সেখানে ভয়াবহ পানির সংকট দেখা যায়। এজন্য মুম্বাইয়ের রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবার টেবিলে অর্ধেক গ্লাস পানি ও টিস্যু রাখা হয়, যাতে খাওয়ার পর হাত ধোওয়ার ক্ষেত্রে পানি ব্যবহারে সকলে মিতব্যয়ী হয়।
সিঙ্গাপুরকে নাজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মডেল হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। শুধুমাত্র বিভিন্ন নাজের কারণেই এই দেশ উন্নতি করতে পেরেছে। সেখানে ডাস্টবিন বাস স্ট্যান্ড থেকে দূরে রাখা হয়, যার ফলে ধূমপায়ীরা অন্যান্য বাস যাত্রীদের থেকে দূরে থাকে। বিভিন্ন ভবনের বাইরে জিমের ব্যবস্থাও রাখা হয়, যা সাধারণ জনগণকে জিম ব্যবহারে ও স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হতে সহায়তা করবে। ট্রেন স্টেশনগুলোতে লাল ও সবুজ রঙের তীর দিয়ে প্লাটফর্মে কোথায় দাঁড়ানো উচিত তা নির্দেশ করা হয়। আবার আপনি যদি সকাল সাতটার আগে কোথাও যাওয়ার জন্য বের হন, তাহলে আপনার ভাড়া কমিয়ে দেওয়া হবে। এরকম আরও অনেক নাজের প্রয়োগই সিঙ্গাপুরে দেখা যায়, যা পরবর্তীতে অন্যান্য দেশেও ব্যবহার করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোতে পানিবাহিত রোগ, যেমন- কলেরা প্রায়শই মহামারী আকারে দেখা যায়। এসব স্থানে সাধারণ জনগণের জন্য বিশুদ্ধ পানি এবং সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশনের যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। কেনিয়ার কিছু এনজিও এবং প্রতিষ্ঠান জনগণের মাঝে ক্লোরিন ট্যাবলেট বিতরণ করে, যা পানিকে জীবাণুমুক্ত করে। তবে এ সকল ট্যাবলেট বেশিরভাগ মানুষই ব্যবহার করেন না। এ ঘটনার ক্ষেত্রে ট্যাবলেটগুলোর মূল্য এগুলোর ব্যবহার কম হওয়ার পেছনে দায়ী নয়, বরং এই পানি বিশুদ্ধকরণে যে পরিমাণ ঝামেলা পোহাতে হয় তা সবাইকে এই কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে। এক্ষেত্রে আসলে বোঝা মুশকিল যে নাজটি আসলেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে কি না।
এছাড়াও আরও নাজ বিভিন্ন জায়গার ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মূল উদ্দেশ্য সকলের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। যেমন- বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে আপনাকে শুধুমাত্র তখনই প্লাস্টিকের স্ট্র দেওয়া হবে, যখন আপনি নিজে থেকে দিতে বলবেন। এয়ারলাইন্সে আপনি প্লাস্টিক কাপ না চাইলে সরাসরি পানির ক্যান থেকেই তা পান করতে হবে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রিন্টারগুলো এমনভাবে সেট করা থাকে যেন তা কাগজের দুদিকে প্রিন্ট করে। ক্যাশ পেমেন্টের কথা না বললে ইলেকট্রনিক বিলের জন্য অনুরোধ করা। এ দুই পদ্ধতিতে কাগজের ব্যবহার কমানো যায়।
এরকম আরও নাজের উদাহরণ আমাদের আশেপাশেই দেখা যায়। কখনও কখনও আমরা নাজের বিষয়টা না জেনেও এর প্রয়োগ করি। তবে সবসময় নাজ ভালো হয় না। কিছু কিছু নাজ একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করতে পারে। আবার অনেক সময় কোনো নাজ ভালো কী মন্দ তা-ও বোঝা যায় না। এখানে কেনিয়ার যে উদাহরণ দেয়া হলো তা লক্ষ্য করুন। বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাজ প্রয়োগ করা হলেও বেশিরভাগ মানুষই এই বিষয়টি বুঝতে পারে নি। যেমন- সকলের মধ্যে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন নাজ বাংলাদেশেও প্রয়োগ করা হয়।