একটি দেশে যখন কোনো পণ্য বা দ্রব্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে আরো বাড়তি কিছু রয়ে যায়, তখন সেই অতিরিক্ত পণ্য বা দ্রব্য অন্য দেশে বিক্রি করে দেয়। এই প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রপ্তানি বলে। আর যখন নিজ দেশে কোনো পণ্য বা দ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন বিদেশ থেকে কিনে আনা হয়। একে বলা হয় আমদানি। মূলত রপ্তানি আর আমদানি কার্যক্রম মিলেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সৃষ্টি।
পৃথিবীর কোনো দেশই সব পণ্যদ্রব্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কিছু দ্রব্য অধিক হারে উৎপাদিত হয়, আর কিছু দ্রব্য কম উৎপাদিত হয়। তাই চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিটি দেশই নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভর করে থাকে। মূলত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিটি দেশই তাদের পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যেকোনো দ্রব্যের দাম নির্ধারণ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। দাম নির্ধারণে তাই বেশ কিছু বিষয়ের উপর লক্ষ রাখা হয়। এছাড়া এই বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে জরুরি কিছু বিষয় সম্পর্কেই আজ জানানো হবে।
মূল্য নির্ধারণ কৌশল
যেকোনো পণ্য চূড়ান্ত ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর আগে তার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকরা বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে থাকেন। একজন রপ্তানিকারক বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে একই মূল্য রাখতে পারেন, অথবা বাজারে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে মূল্য কম-বেশি করতে পারেন। মূলত, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য নির্ধারণের বিভিন্ন কৌশল নিতে দেখা যায়। কিছু মূল্য নির্ধারণ কৌশল নিয়ে আলোচনা করা যাক।
স্কিমিং প্রাইসিং স্ট্র্যাটেজি: এটি এমন এক মূল্য নির্ধারণের কৌশল যেখানে রপ্তানিকারক প্রচার ব্যয়, গবেষণা ও উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করে থাকেন। মূলত ভোক্তাদের পণ্যের দিকে আকৃষ্ট করতে ও তাদের মনে ওই পণ্যের সব ইতিবাচক দিক তুলে ধরতেই এই কর্মযজ্ঞ করা হয়। আর এই অতিরিক্ত খরচকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য প্রাথমিকভাবে অনেক বেশি মূল্য নির্ধারণ করা হয়, যা স্কিমিং প্রাইসিং কৌশল নামে পরিচিত। সমাজের উচ্চশ্রেণী ভোক্তার বাজারকে কাজে লাগানোর পর, রপ্তানিকারক তার বাজারের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য ধীরে ধীরে দাম কমাতে পারে।
পেনিট্রেশন প্রাইসিং স্ট্র্যাটেজি: এটি স্কিমিং প্রাইসিং কৌশলের ঠিক উল্টো। এই কৌশলে একজন রপ্তানিকারক প্রাথমিকভাবে তার বাজার ধরে রাখতে এবং প্রতিযোগীদের বাজার থেকে বের করে একচেটিয়া ব্যবসার উদ্দেশ্যে খুব কম দাম নির্ধারণ করে। এই কৌশল পেনিট্রেশন প্রাইসিং স্ট্র্যাটেজি নামে পরিচিত। এই কৌশল ডাম্পিং হিসেবেও পরিচিত। মূলত পণ্যের উৎপাদনকারী কোনো বাজারে নিজের আধিপত্য বিস্তার ও বাজার দখল করার উদ্দেশ্যে এই ধরনের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। এই কৌশল ব্যাপক ভোগের দ্রব্যগুলোর জন্য উপযুক্ত।
প্রান্তিক খরচ মূল্য: প্রান্তিক খরচ হলো পণ্যের একটি অতিরিক্ত একক উৎপাদনের খরচ। এই পদ্ধতির অধীনে, একজন রপ্তানিকারক আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য নির্ধারণের সময় পরিবর্তনশীল খরচ বা প্রত্যক্ষ খরচ বিবেচনা করে, এবং অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে স্থির খরচ সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার করে।
বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ: এটি মূল্য নির্ধারণে খুব নমনীয় পদ্ধতি, কারণ এটি বাজারের পরিবর্তনের অবস্থা বিবেচনা করে। চাহিদার অবস্থা অনুকূলে এবং এর বিপরীত হলে চার্জ করা মূল্য বেশি হতে পারে। এই পদ্ধতি কখনও কখনও ট্রাফিক পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটি মূল্য নির্ধারণের খুব নমনীয় এবং বাস্তবসম্মত পদ্ধতি।
প্রতিযোগীর মূল্য নির্ধারণ: এই পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণের সময়, প্রভাবশালী প্রতিযোগীদের মূল্য নির্ধারণের কৌশল বিবেচনা করা হয়। প্রভাবশালী কোম্পানি বা ফার্মের মূল্য বাজারের মূল্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। প্রতিযোগীর মূল্য নীতি ত্রুটিপূর্ণ হলে, অনুসারীরাও ভুল মূল্য নির্ধারণ করবে।
অগ্রিম মূল্য নির্ধারণ: প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য দাম কম নির্ধারণ করাই হলো অগ্রিম মূল্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য। এই ক্ষেত্রে দাম একক প্রতি মোট খরচের কাছাকাছি হয়। বর্ধিত ভলিউম থেকে কম খরচের ফলে, কম দাম ক্রেতাদের কাছে উদ্ধৃত করা হয়। সম্ভাব্য প্রতিযোগিতা নিরুৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজন হলে সাময়িকভাবে মোট খরচের নিচেও মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ধরে নেয়া হয়, বাজারের আধিপত্যের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে।
বিলুপ্তি মূল্য নির্ধারণ: বিলুপ্তি মূল্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিদ্যমান প্রতিযোগীদের নির্মূল করা। দুর্বল, প্রান্তিক উৎপাদকদের বাজার থেকে বের করে দেওয়ার সচেতন উপায় হিসেবে এটি উৎপাদকদের দ্বারা গৃহীত হতে পারে। তবে, বিশেষ করে নতুন ও ছোট শিল্পগুলো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য, এটি অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে মন্থর করতে পারে, এবং এভাবে বাজারের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অগ্রিম এবং বিলুপ্তি মূল্যের কৌশল উভয়ই আন্তর্জাতিক বাজারে ‘ডাম্পিং’-এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। প্রকৃতপক্ষে, এগুলো কেবলমাত্র ডাম্পিং প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য হিসেবে করে। যদিও তারা প্রাথমিকভাবে একটি বিদেশী বাজার দখল করতে পারে এবং প্রতিযোগীদের রাখা বা বের করে দিতে পারে, তবে এগুলো সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত। কারণ, এর ফলে বিদেশী সরকার পণ্যের আমদানি এবং বিক্রয়ের উপর স্বেচ্ছাচারী বিধিনিষেধ আরোপ করবে। ফলস্বরূপ, উৎপাদনকারীদের কাছে বাজার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ, একবার গ্রাহকরা কম দামে কেনাকাটা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে পরবর্তীতে তাদের লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করা কঠিন।
মূল্য নির্ধারণের নিয়ামকসমূহ
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। এসব বিষয়ের পরিবর্তন বা সংযোজন পণ্যের দামের উপর ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। চলুন, জেনে নেয়া যাক এই বিষয়গুলো সম্পর্কে।
পণ্যের খরচ
পণ্য তৈরির খরচ বিবেচনা না করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। উৎপাদনের স্থির ও পরিবর্তনশীল খরচ, বিপণন এবং পরিবহন খরচ উৎপাদন খরচের অন্তর্ভুক্ত। কখনও কখনও একটি কোম্পানি খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে এবং বাজারে তার শেয়ার বাড়ায়। দাম নির্ভর করে উৎপাদন খরচের উপর। তাই, মূল্য নির্ধারণের সময় মূল্য বিশ্লেষণ করা এবং স্থির ও পরিবর্তনশীল খরচ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কেবল খরচের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করা যায় না। এটা সত্য যে দাম বেশি দিন খরচের নিচে স্থির করা যায় না। আবার বাজারে চাহিদা বাড়তে থাকলে পণ্যের মূল্যও বাড়ে।
বিনিময় হার
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য নির্ধারণে বৈদেশিক মুদ্রার হার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যায় (তার মানে ১ ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা দিতে হচ্ছে), তখন একজন আমদানিকারক পণ্য আমদানির দরপত্র করতে দ্বিধাবোধ করেন। কারণ, এই অবস্থায় একজন আমদানিকারককে প্রতি ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা দিতে হয়। এই পরিস্থিতিতে ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হয়ে পড়ে।
পণ্যের ধরন ও পার্থক্য
এই বিষয়টি মূল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন একটি পণ্যের বিশেষত্ব থাকে (অর্থাৎ ওই পণ্যটি অন্যান্য পণ্য অপেক্ষা বেশি সুবিধা দেয়) বা তার প্রতিযোগীদের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়, তখন কোম্পানি সেই পণ্যের মূল্য নির্ধারণে বাড়তি সুবিধা পায়। সাধারণত এই ধরনের পণ্যের দাম নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত অন্যদের তুলনায় বেশি রাখা হয়।
সুনাম বা প্রতিপত্তি
উৎপাদক, কোম্পানি ও দেশের সুনাম বা প্রতিপত্তি পণ্যের দামেও প্রভাব রাখে। নামীদামী কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের উচ্চমূল্য নির্ধারণ করে। কিন্তু পণ্য ভালো হলেও স্বল্পোন্নত দেশগুলো উন্নত দেশের তুলনায় উচ্চমূল্য নির্ধারণ করতে পারে না।
চাহিদা
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম নির্ধারণে পণ্যের চাহিদা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা অনেকগুলো উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়, যা দেশীয় বাজার থেকে ভিন্ন। বিদেশী গ্রাহকদের অভ্যাস, রুচি ও পছন্দ দেশীয় বাজার থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন হতে পারে। চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা আরেকটি কারণ যা মূল্যকে প্রভাবিত করে। পণ্যের চাহিদা স্থিতিস্থাপক হলে (অর্থাৎ দামের সামান্য পরিবর্তনে চাহিদার ব্যাপক পরিবর্তন হওয়া), সে পণ্যের দাম হ্রাস করলে বিক্রয়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, চাহিদা অস্থিতিস্থাপক থাকলে এবং সরবরাহ সীমিত হলে, উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা
বৈদেশিক বাজারে প্রতিযোগিতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই প্রতিযোগিতা এতটাই তীব্র হতে পারে যে রপ্তানিকারকের কাছে বাজার দামেই পণ্য বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু একচেটিয়া বাজারে (যেখানে বিক্রেতা মাত্র একজন থাকে) একজন রপ্তানিকারক তার পণ্যের উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করতে পারে। অপরদিকে, বৃহত্তর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণের স্বাধীনতা থাকে না। এজন্য প্রতিযোগীদের কৌশল বিবেচনা না করে মূল্য নির্ধারণ করা যায় না।
বাজারের বৈশিষ্ট্য
বাজারে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি আরো কিছু কারণ রয়েছে যা দামকে প্রভাবিত করে: চাহিদার প্রবণতা, ভোক্তার আয়, ভোক্তার কাছে পণ্যের গুরুত্ব এবং লাভ। এছাড়া দেশীয় সংস্কৃতি ভেদেও বাজার ভিন্ন হতে পারে।
সরকারি কারণ
সরকারের নীতি ও আইন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য নির্ধারণকে প্রভাবিত করে। সরকার কর্তৃক কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
(i) সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন দাম: কিছু দেশ তাদের পণ্যের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করে দেয়। সরকার যখন দাম নিয়ন্ত্রণ করে, তখন এর মধ্যেই দাম রাখতে হয়। সাধারণত, জাতীয় উন্নয়ন, শিল্পের অবস্থান, পণ্যের মজুত এবং শিল্পের সুরক্ষার জন্য এই জাতীয় নীতি প্রয়োগ করা হয়।
(ii) মুনাফা নিয়ন্ত্রণ: কখনও কখনও সরকার উৎপাদনকারী বা রপ্তানিকারকদের জন্য লাভের শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। ফলস্বরূপ, উৎপাদনকারীরা মূল্য নির্ধারণের স্বাধীনতা হারায়।
(iii) কর: রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মূল্য নির্ধারণের সময়, শুল্ক এবং অন্যান্য কর বিবেচনা করতে হবে। যখন আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়, একজন রপ্তানিকারককে তার দাম কমাতে হয়। বিদেশী বাজারে এই ধরনের ট্যাক্সের কারণে পণ্যের দাম বেশি রাখতে হয়।
(iv) কর রেয়াত, ছাড় এবং ভর্তুকি: রপ্তানি বাড়াতে অনেক দেশ কর ছাড় বা স্বাধীনতা দেয়। সেক্ষেত্রে কম দামে পণ্য রপ্তানি করা যায়। আবার রপ্তানিকে উৎসাহিত করার জন্য, সরকার আর্থিক ভর্তুকিও দেয়। এই ধরনের ভর্তুকি রপ্তানি বাজারে মূল্য নির্ধারণকেও প্রভাবিত করে।
(v) অন্যান্য প্রণোদনা: রপ্তানি বাড়াতে সরকার অনেক প্রণোদনা দেয়। এর মধ্যে কাঁচামাল সরবরাহ, কম দামে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, বিক্রিতে সহায়তা ইত্যাদি প্রধান প্রণোদনা। রপ্তানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণের সময় এসব বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়।
(vi) সরকারি প্রতিযোগিতা: কখনো কখনো সরকার আন্তর্জাতিক মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে প্রবেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান সরকার আমেরিকান কোম্পানির কাছে একটি নির্দিষ্ট মূল্যে তার স্টক থেকে অ্যালুমিনিয়াম বিক্রি করে। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলো দাম বাড়াতে পারছে না। তাই মূল্য নির্ধারণের সময় সরকারি প্রতিযোগিতাও বিবেচনা করা উচিত।
(vii) আন্তর্জাতিক চুক্তি: কিছু পণ্যের দাম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি, যেমন: বাফার স্টক চুক্তি, দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ধরনের চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম নির্ধারণ করতে হয়।
ভূরাজনৈতিক অবস্থা
কোনো দেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থা ওই দেশের আমদানি এবং রপ্তানিতে ব্যাপক প্রভাব রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের তেল বাণিজ্যে সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈদেশিক রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
যেসব দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশি বা যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, সেসব দেশের পণ্যদ্রব্যের বাজারমূল্য তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। মূলত জনগণের আয়ের সীমা বেশি হওয়ায় দ্রব্যের উপর তার প্রভাব পড়ে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারেও সেটি পরিলক্ষিত হয়।
মূল্য নিয়ন্ত্রণ কৌশল
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ বা পণ্যের অবাধে আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ রোধে বেশ কিছু নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। চলুন জেনে নিই সেসব বিষয় সম্পর্কে।
১. শুল্ক বা ট্যারিফ এবং সংরক্ষণবাদ নীতি
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদ বলতে সাধারণত সরকারী নীতির কাজগুলোকে বোঝায়, যা দেশীয় শিল্পকে বিদেশী প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করতে ব্যবহার করা হয়। দেশীয় শিল্পকে রক্ষা ও সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিভিন্ন সরকারী নীতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে শিল্পগুলো বিদেশি আমদানিকারকদের সাথে প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে না হয়। সংরক্ষণবাদ অনুযায়ী চারটি প্রধান প্রতিরক্ষামূলক কাজ হলো দেশীয় উৎপাদকদের ভর্তুকি প্রধান, আমদানিকৃত পণ্যের উপর কর আরোপ, আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা এবং রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য। তবে আমদানির উপর কর আরোপ ঐতিহাসিকভাবে প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করে আসছে। এই করগুলোকে সাধারণত শুল্ক বলা হয়, যদিও কখনও কখনও অন্যান্য শর্তাবলী, যেমন: আমদানি সারচার্জ বা তদ্রুপ কোনো শুল্ক ব্যবহার করা হয়। এই শুল্ক প্রয়োগে দেশীয় রাজস্ব বৃদ্ধি পায়, দেশীয় উৎপাদন রক্ষা পায়, সুরক্ষিত পণ্যের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের আমদানি হ্রাস পায়। তবে দেশের নতুন বা শিশু শিল্পকে বাঁচাতে এই ধরনের শুল্ক অধিক হারে আরোপ করা হয়ে থাকে।
২. রপ্তানি ভর্তুকি এবং ডাম্পিং
রপ্তানির উপর ভর্তুকি দেয়া হলে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য অভ্যন্তরীণ মূল্যের চেয়ে কমে যায়। ফলে আমদানিকারকের দেশের জনগণ সেই পণ্য কম দামে কিনতে পারে। এতে রপ্তানিকৃত দেশের বাজারে সেই পণ্যের চাহিদা আমদানীকৃত দেশে বেড়ে যায়। কারণ অন্যান্য দেশের তুলনায় ঐ দেশে সেটি কম মূল্যে পাওয়া যায়। তবে সাধারণত নতুন কোনো শিল্পের জন্য এ ধরনের ভর্তুকি দেয়া হয়ে থাকে। বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট শিল্পের পণ্যকে অন্য দেশে পরিচিতি লাভের জন্যও এই ধরনের ভর্তুকি দেয়া হয়ে থাকে।
এর সাথে সম্পর্কিত কিন্তু আরো গভীর একটি শব্দ হলো ‘ডাম্পিং’। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডাম্পিং বলতে বোঝায় অভ্যন্তরীণ মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিদেশে পণ্য বিক্রয়। সাধারণত কোনো দেশের বাজার দখল করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে মূল্য কমিয়ে সেই দেশে ঐ পণ্য বিক্রি বা রপ্তানি করার কৌশল হলো ডাম্পিং। মূলত বাজার দখল করাই এর উদ্দেশ্য। যদিও এই ব্যবস্থায় স্বল্প সময়ের জন্য উৎপাদনকারীকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়, তবুও বাজার দখলের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এই ক্ষতিকে মেনে নিতে হয়।
৩. পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা এবং কোটা
দ্রব্যের পরিমাণগত নিষেধাজ্ঞাগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অর্থপ্রদানের সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন নীতির উপকরণগুলোর মধ্যে একটিকে তুলে ধরে। এছাড়া অন্যান্য উপকরণের মধ্যে রয়েছে রপ্তানি ও আমদানির উপর শুল্ক, বিনিময় হারের তারতম্য, এবং আর্থিক ও রাজস্ব নীতি।
নীতিগত বিধিনিষেধের মধ্যে দেশগুলোর বর্তমান এবং মূলধনী উভয় প্রকার লেনদেনের উপর সীমাবদ্ধতা স্থাপন করা যেতে পারে। বিধিনিষেধের একটি সাধারণ উদাহরণ হলো মূলধন স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণ করা। পরিমাণগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একটি দেশের বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য প্রবেশের পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা।
বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা একটি পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনুমতিযোগ্য আমদানি বা রপ্তানি পরিমাণগত বিধিনিষেধের মাধ্যমে এটি কার্যকর হয়। রপ্তানি ও আমদানি উভয় ক্ষেত্রেই পরিমাণগত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। তাই এই বিধিনিষেধগুলো শুল্ক থেকে পৃথক, যার লক্ষ্য পণ্যের দামের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলা। এছাড়া আমদানির উপর কোটা আরোপ করা হয়।
৪. বাণিজ্য চুক্তি
বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে দুটি দেশের মধ্যে আমদানি রপ্তানির বিভিন্ন চুক্তি করা হয়ে থাকে। এসব চুক্তিতে বিশেষ বিশেষ পণ্যের উপর মূল্যছাড় বা কম মূল্যে দেশে প্রবেশের ছাড়পত্র পেয়ে থাকে। এর ফলে দেশীয় বাজারে যেমন বিদেশি পণ্যের প্রসার লাভ হয়, ঠিক তেমনই বিদেশেও দেশের পণ্যের আধিক্য ঘটে।
এছাড়া এসব চুক্তির ফলে পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাস পায়, আর তা বিদেশে দেশীয় পণ্যের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। বাণিজ্য চুক্তি দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক হতে পারে। যা-ই হোক, পাঠককে সতর্ক করা উচিত যে ‘দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি’ শব্দটি প্রায়শই আমদানি কোটা চুক্তি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যা সাধারণত আমদানি ও রপ্তানি কোটার মাধ্যমে বাণিজ্যের দ্বিপাক্ষিক ভারসাম্য প্রদান করে।
৫. বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণ
বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এক্ষেত্রে একটি দেশের সরকার চাইলে সেটি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি দেশের সরকার যদি দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনে নেয়, তাহলে বাজারে ডলারের ঘাটতি সৃষ্টি হবে। ফলে ঐ দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হবে। এর কারণে রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে আর আমদানি হ্রাস পাবে। বিপরীতে, যদি ঐ দেশের সরকার রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে ছেড়ে দেয়, তাহলে বাজারে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে এবং ডলারের অবমূল্যায়ন ঘটবে। ফলে ডলারের বিপরীতে ঐ দেশের মুদ্রামান শক্তিশালী হবে। এতে করে রপ্তানি হ্রাস ও আমদানি বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া সরকার সুদের হারের পরিবর্তনের মাধ্যমেও এই বিনিময় হারের তারতম্য ঘটাতে পারে।
মূলত আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থায় প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সাথে অন্যান্য দেশের বিভিন্ন বিষয় একীভূত হয় বলে এই বাজারে মূল্য নির্ধারণ এবং সর্বোপরি তার নিয়ন্ত্রণ করাটা খুবই সংবেদশীল। এই বাজারের লেনদেনসমূহ প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতে তাই তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে।