বিশ্বজুড়ে অনেক বড় ব্যবসার ক্ষেত্র এয়ারলাইন্স। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, আরামে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, নানা ধরনের খাবার ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে এয়ারলাইন্সগুলো যেন একেকটি টাকার খনি। তবে সম্প্রতি করোনা মহামারী যেমন তাবৎ পৃথিবীর সবকিছুকেই বিশাল ধাক্কা দিয়ে গেছে তাতে বাদ যায়নি বিলিয়ন ডলারের এই শিল্পও। মহামারী যখন এর সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে তখন বিশ্বের সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে পর্যটন, যোগাযোগ, যাতায়াত, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদির চেয়ে জনস্বাস্থ্য সমস্যাই অধিক প্রাধান্য পায়। স্বাভাবিকভাবেই এত বৃহদাকার একটি শিল্পখাত একেবারেই স্থবির হয়ে যায়। চলমান মহামারী ঠিক কীভাবে এয়ারলাইন্সগুলোকে বদলে দেবে?
সংক্রমণের প্রকোপ ঠেকাতে ভারত, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরও কিছু দেশ সম্পূর্ণভাবে পর্যটন বন্ধ ঘোষণা করে দেয়। বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে শুধু পর্যটকদের স্বপ্নই ভেঙে যায়নি বরং অসংখ্য বিমানকে আক্ষরিক অর্থেই অলস হয়ে বসে থাকতে হয়।
করোনা পূর্ববর্তী সময়ে যাত্রীদের বিশেষত প্রিমিয়াম বা বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণকারীদের জন্য বিমান ভ্রমণ ছিল বিলাসের আরেক নাম। বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণরত যাত্রীদের জন্য এয়ারলাইন্সগুলো শব্দ নিরোধক হেডফোন, ঢোলা পায়জামা, অ্যামেনিটি কিটস (ঈষদুষ্ণ রুমাল, সুগন্ধি, ফেইস ওয়াশ, পেস্ট ইত্যাদি) সরবরাহ করত। এমনকি টার্কিশ এয়ারলাইন্স তাদের প্রথম শ্রেণিতে ভ্রমণরত যাত্রীদের জন্য অন বোর্ড শেফের ব্যবস্থা রাখত। বিমানে তৈরি করা খাবার ছাড়াও যাত্রীর নিজস্ব চাহিদা মোতাবেক তারা তাৎক্ষণিকভাবে খাবার পরিবেশন করবেন।
মহামারী এসব আভিজাত্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিমানে বহুল প্রচলিত ট্রলি দিয়ে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থাও বন্ধ করে দিয়েছে কিছু এয়ারলাইন্স। যাত্রার শুরুতেই তারা ভ্রমণরত ব্যক্তিদের সাথে খাবারের একটি ব্যাগ সরবরাহ করছে যাতে পারস্পরিক সংস্পর্শ কম হয়। বেশ কিছু এয়ারলাইন্স যাত্রীদের বালিশ, ম্যাগাজিন ইত্যাদি দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে অথচ এগুলো একসময় বিমান ভ্রমণের অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে বিবেচিত হতো।
যাত্রীদের অনেকেই সমালোচনা করছেন এসব পদক্ষেপের। তাদের বক্তব্য, এয়ারলাইন্সগুলো এসব কাজ করছে খরচ কমানোর জন্য। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে মহামারীর কারণে বিমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় ধরনের লোকসানের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আর যদিও বা ফ্লাইট পরিচালনা হয়ে থাকে, ভ্রমণরত যাত্রীদের সংখ্যা বিচারে সেটা খুব একটা লাভ এনে দিচ্ছে না। কারণ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানুষের মাঝেও ভ্রমণের ইচ্ছা কমে এসেছে।
এয়ারলাইন্সগুলোর এসব পদক্ষেপ গ্রহণের সবচেয়ে বড় কারণ বলা যায় পারস্পরিক সংস্পর্শ কমিয়ে আনা। বিমানের মতো একটি বদ্ধ জায়গায় খাবার, পানীয় পরিবেশন ইত্যাদি কাজে যাত্রী এবং বিমানবালাদের না চাইলেও যথেষ্ট কাছাকাছি আসতে হয়। যেকোনো ধরনের সেবায় বিমানবালারা যাত্রীদের সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন না। আরেকটি বিষয় হলো টাচপয়েন্ট হ্রাস করা। অর্থাৎ যত বেশি ভোগ বিলাসের বস্তু সরবরাহ করা হবে তত বেশি ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। যেকোনো সমতলই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য ভূমিকা রাখতে পারে।
এককালে বিমান ভ্রমণ শুধু ভ্রমণই ছিল না বরং যাত্রীদের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করতে সদা প্রস্তুত ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির দাবিতে ভ্রমণকে আক্ষরিক অর্থেই ভ্রমণ হিসেবে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কাতার এয়ারওয়েজ যাত্রীদের জন্য মাস্ক ও ফেইস শিল্ড পরিধান বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে।
করোনা পরবর্তী সময়ে ভ্রমণ ঠিক কতটা পাল্টাবে বা কীভাবে পাল্টে যাবে সে সম্পর্কে এখনই কোনো সুস্পষ্ট মন্তব্য করা কঠিন। তবে ধারণা করা যাচ্ছে, ভ্রমণের মৌলিক ধারণাটি আমূল বদলে যাবে। ভ্রমণের উদ্দেশ্য, ভ্রমণের রকমফের অর্থাৎ ভ্রমণ বলতে আমাদের মনে যেসব ধারণা সামষ্টিকভাবে গড়ে উঠেছে সেসবের মৌলিক ভিত্তিটি অনেকটাই পরিবর্তিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে বিশ্বের ধনকুবেরদের মাঝে ব্যক্তিগত বিমান বা হেলিকপ্টার ব্যবহারের হার বৃদ্ধি পাবে। ঠিক এর সাথে তাল মিলিয়ে বসবাসের ক্ষেত্রে হোটেলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক রুম বুক না করে বরং পুরো হোটেলটাই হয়তো বুক করবেন তারা। সংখ্যার হিসেবে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এয়ারলাইন্স শিল্পের সাম্প্রতিক অবস্থা।
- আন্ত দেশীয় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আগামী মার্চ পর্যন্ত বহাল থাকলে বিমান পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো মোট ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
- চলতি বছরের জুলাই মাসের ১ থেকে ২৭ তারিখ অবধি যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরগুলোতে যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৬৪৮,০৪২ যেটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৫% কম।
- করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসার পরও ৮৬% যাত্রীই বিমান ভ্রমণে আগ্রহী হবেন না খুব শীঘ্রই।
বিমান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের লোকসানের পরিমাণ সামাল দিতে যাত্রীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে স্বাভাবিকভাবেই। ইতোমধ্যেই তারা ইকোনমি ক্লাসে পাশাপাশি তিনটি আসনের মাঝেরটি ফাঁকা রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। এই কৌশলটিকে তারা যাত্রীদের কাছে সুরক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে দেখিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করবে। কারণ ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে প্রতি সারিতে একটি করে আসন ফাঁকা রাখা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ।
এয়ারলাইন্স শিল্পে একটি বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে ইকোনমি আর বিজনেস ক্লাসের মধ্যকার বৈষম্য। বলা বাহুল্য যে, করোনা মহামারী এই বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছে। যাত্রী ধরে রাখার জন্য এয়ারলাইন্সগুলো বিজনেস ক্লাসের বিভিন্ন উন্নয়ন ঘটালেও সেসব থেকে আক্ষরিক অর্থেই বঞ্চিত হবে ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীরা।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে বিমানে মাঝখানের আসন ফাঁকা রাখা, বিমানবালা এবং বিমানবন্দরে কর্মরতদের জন্য কিছু নিয়ম চালু করা হয়েছে। কোরিয়ান এয়ারলাইন্স বিমানবালাদের জন্য গগলস, মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা গাউন পরিধান বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে।
বিভিন্ন এয়ারলাইন্স যাত্রীদের জন্য মেডিক্যাল সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করেছে। টিকেট কাটার পূর্বেই করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট এখন অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাত্রীদের সুরক্ষা এবং মহামারীর প্রকোপ কমানোর কথা ভেবে এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করা হলেও এটি প্রকারান্তরে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করছে অনেক যাত্রীকেই। পাসপোর্ট, ভিসা, টিকেট, ইমিগ্রেশন সব মিলিয়ে বিমান ভ্রমণ এমনিতেই বেশ ঝক্কি ঝামেলার। তার উপর মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, তাপমাত্রা পরীক্ষা ইত্যাদি বিষয়গুলো যাত্রীদের বিরক্তি উৎপাদনে ঢের ভূমিকা রাখছে।
যাত্রীদের প্রেক্ষাপট থেকে ভাবলে বিষয়টিতে একটি নতুনত্ব পাওয়া যায়। বিমান ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় অনেকেই ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। কূটনীতিক, পর্যটক, ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণির যাত্রীদের মাঝে একটি প্রশ্ন জেগেছে যে ভ্রমণটা সত্যিই দরকারি? দরকারি যদি হয়েও থাকে তবে বিমান ভ্রমণই কি একমাত্র উপায়? এরই ফলাফল হিসেবে অনেকের মাঝেই নিতান্ত প্রয়োজনীয় বিমান ভ্রমণকেই শুধু গুরুত্ব দেওয়ার চর্চা গড়ে উঠেছে।
বিভিন্ন বিমান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই আসন বিন্যাসের উপর নজর দিচ্ছে। মাঝের আসনটিকে দুই পাশের আসনের বিপরীতে রাখা, ডাবল ডেকার আসন বিন্যাস, আসনের মাঝে অতিবেগুনি রশ্মি এবং হিট ক্লিনিং এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ইত্যাদি বেশ কিছু আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।
এয়ারলাইন্সগুলো প্রাণপণে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি ডলারের এই শিল্প খাতকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তবে বাস্তবতা অনুযায়ী যতটা পূর্বানুমান করা যাচ্ছে তাতে করে কিছু নেতিবাচক ফলাফল প্রায় অবশ্যম্ভাবী। এদের মাঝে সবার আগেই এসে যায় এয়ারলাইন্সের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি। এছাড়াও বহু সংখ্যক লোক চাকরি হারাবে, ব্যবসায়িক ভ্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো পর্যটন খাতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ যে পরিমাণ অবদান রাখত তা হয়তোবা আগামী কয়েক বছর লেগে যাবে ঠিকঠাক হতে।