বিশ্বায়নের ফলে পৃথিবী হয়ে যাচ্ছে এক বিশ্ব গ্রাম। আর বিশ্বায়নের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, উন্নত প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার বা সহজ ভাষায় যেটাকে আমরা বলতে পারি ডিজিটালাইজেশন। ডিজিটাল শব্দটি থেকে ডিজিটালাইজেশন শব্দটির উৎপত্তি। এই ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। সেসব দেশ ডিজিটালাইজেশনকেই পুঁজি করে ডিজিটাল অর্থনীতিতে মনোনিবেশ করছে এবং নিজেদের ভবিষ্যতকে ডিজিটাল অর্থনীতিনির্ভর করতে তুলতে চাইছে।
ডিজিটাল অর্থনীতি বলতে এমন একটা অর্থনীতি বোঝানো হয়, যেটা মূলত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে থাকে। ডিজিটাল অর্থনীতিকে ইন্টারনেট অর্থনীতি, ওয়েব অর্থনীতি অথবা নতুন/আধুনিক অর্থনীতি নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
দ্রুতগতিসম্পন্ন এই ডিজিটালাইজেশনের আবির্ভাব, উন্নয়নশীল দেশসমূহকে ডিজিটাল অর্থনীতিতে মনোনিবেশ করতে আগ্রহী করে তুলছে, যাকে বলা যায় ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের এক বৈশ্বিক বাজার। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতিতে যে কেবল সেবা-শিল্পের রাতারাতি উন্নতি ঘটে তা কিন্তু নয়; বরং এটি দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সহায়ক।
স্বল্প খরচ এবং ঝুঁকি হ্রাসের সন্ধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ অর্থনীতিতে পরিপূর্ণ দেশসমূহ বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাছ থেকে আউটসোর্সিংয়ের সেবা নিয়ে থাকে, যা সাম্প্রতিককালে ফ্রিল্যান্সিংকে চাঙ্গা করে তুলেছে।
ফ্রিল্যান্সিং কাজের মধ্যে প্রোগ্রামিং থেকে ওয়েব ডিজাইন, ট্যাক্স প্রিপারেশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনসহ অসংখ্য কাজ আছে। পেশাদারি কাজের এই মার্কেটপ্লেসটি হাজারো বেকারের কর্মসংস্থান করে দিয়েছে। এই বিশাল মার্কেটপ্লেসে নিত্যনতুন হাজারো মানুষ সুযোগ পাচ্ছে যেটা এর আগে কখনোই সম্ভব ছিল না। আর সে সুবাদে পুরো বিশ্বের মধ্যে এশিয়া মহাদেশই হচ্ছে একমাত্র অঞ্চলে পরিণত হয়েছে যারা পুরো বিশ্বকে আউটসোর্সিংয়ের সেবা প্রদান করা।
ফ্রিল্যান্সিং প্রচুর সুবিধা দিয়ে থাকে ফ্রিল্যান্সারকে, কেননা ফ্রিল্যান্সার নিজের পছন্দমতো খদ্দের বা কাজ বেছে নিতে পারেন, পুরো বিশ্ববাজারে তাদের প্রভাব বিস্তার হয়, এবং যেকোনো জায়গায় বসেই তারা এই কাজগুলো করতে পারে। তাই, বাংলাদেশের তথা ঢাকার প্রেক্ষিতে বলা হয়ে থাকে, ফ্রিল্যান্সিংয়ের সবচেয়ে বড় আর প্রধান সুযোগ সুবিধা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা লাগে না।
দ্রুতগতিতে বাংলাদেশের যে আধুনিকায়ন হচ্ছে, যেমন বলা যায়, সর্বক্ষেত্রে এমনকি গ্রামাঞ্চলসমূহেও ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে যাওয়া, সরকারি এবং এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ফ্রিল্যান্সিং করার বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো, এসবই বাংলাদেশকে ফ্রিল্যান্সিং নির্ভর এক বিশাল জনগোষ্ঠী তৈরিতে সাহায্য করছে।
অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনের দেওয়া জরিপভিত্তিক এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশ হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের অনলাইন শ্রম দেওয়াতে দ্বিতীয় অবস্থানের জায়গা দখল করে আছে। পুরো দেশের ৬,৫০,০০০ নিবন্ধনকৃত ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে গড়পড়তা প্রতিদিনই প্রায় ৫,০০,০০০ ফ্রিল্যান্সার কাজ করে থাকেন অনলাইনের বিভিন্ন প্লাটফর্মে। বাংলাদেশের আইসিটি ডিভিশন থেকে আরো জানা যায়, এই ফ্রিল্যান্সারদের মাধ্যমে বার্ষিক গড় আয় হয়ে থাকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
পুরো বিশ্বের মার্কেটপ্লেসে ভারত অনলাইন শ্রমিক নিয়োগে প্রথম অবস্থানে আছে, যা প্রায় ২৪%, বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে ১৬% নিয়ে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আছে তৃতীয় অবস্থানে ১২% জায়গা দখল করে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্র আসলে কর্মক্ষেত্রের ভিন্নতায় বিভিন্ন দেশের আওতাধীন হয়ে গেছে। যেমন, টেকনোলজি এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের সমস্ত কাজে ইন্ডিয়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি, আবার অন্যদিকে সেলস, মার্কেটিং সেলস সার্ভিস এবং ক্রিয়েটিভ কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চাহিদা বেশি।
ফ্রিল্যান্সিং: বেকার সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায়
বর্তমান বাংলাদেশের হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন নামীদামী পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেও বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেননা চাকরির বাজারে পছন্দসই চাকরি খুঁজে পাচ্ছে না।
আর এ সমস্ত কারণেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে দিনকে দিন। তবে, এই শিক্ষিত যুবক শ্রেণীর বেকাররা কিন্তু চাইলেই কোনো আইটি প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করে বেকারত্বের বোঝা কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলতে পারে। আর ফ্রিল্যান্সিং করে যে শুধু নিজেই উপার্জন করছে এমন কিন্তু নয়; কেননা তার উপার্জিত অর্থটা দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যাপক হারে।
নারীদের জন্য সুযোগ
বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীই, এমনকি উচ্চশিক্ষিত নারীরাও নিজেদের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেয় শুধুমাত্র সংসার সামলানোর জন্য। ফ্রিল্যান্সিংই একমাত্র জায়গা হতে পারে যেখানে নারীরা কাজ করে একইসাথে ক্লায়েন্ট এবং ঘর দুটোই সামলাতে পারবে, তা-ও খুব আরামে; কেননা এই সেক্টরে তাকে বাসায় বসেই কাজ করার সুযোগ সুবিধা মিলবে।
বাংলাদেশি যে সমস্ত নারী সামাজিক রীতিনীতি আর ঐতিহ্যগত প্রথা ভেঙে কর্মদক্ষতায় নিজেকে উন্নত করতে চায়, তাদের কাছে ফ্রিল্যান্সিং হতে পারে এক সুবর্ণ সুযোগ আর বিশাল প্লাটফর্ম। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে যে, পুরুষ ফ্রিল্যান্সারদের তুলনায় নারী ফ্রিল্যান্সিংগণ অত্যধিক দক্ষতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন। নারীদের আগমনের পথ সুনিশ্চিত করা সম্ভব হলে এই কর্মক্ষেত্রেও নারীরা নিজেদের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে।
চ্যালেঞ্জসমূহ
সরকার আইসিটি খাতে উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে প্রত্যেক জেলায় হাই-টেক ডিজিটাল পার্ক নির্মাণ, স্বল্প সময়ে দক্ষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাসহ আরো নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যেন আউটসোর্সিংয়ের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান চাহিদা হিসেবে তৈরি হয়।
তা সত্ত্বেও, পারিপার্শ্বিকতাসহ বিভিন্ন কারণে এই খাতের বিকাশের পথ খানিকটা বাঁধাগ্রস্ত অবস্থায় আছে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুপস্থিতি। ফ্রিল্যান্সিংয়ের যেকোনো কাজই বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তাছাড়া যিনি কাজ দিচ্ছেন তিনিও যথেষ্ঠ পেশাদারী মনোভাবসম্পন্ন। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে নিয়োগদাতা ক্ষুব্ধ হন এবং ফ্রিল্যান্সারের রেটিং কমে আসে। আর সেটা অবশ্যই সরাসরি ডিজিটাল অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে।
বর্তমানে জেলা, উপজেলা, গ্রাম, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা যুবকেরাও ফ্রিল্যান্সিং করে জীবিকা নির্বাহের চিন্তা করছে কিংবা অনেকে হয়তো জীবিকা নির্বাহও করছে। কিন্তু তাদের জন্য এবং তাদের কাছে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে উন্নতমানের ইন্টারনেট সেবা এবং এর অতিরিক্ত মূল্য। কিছু কিছু জায়গায় অবশ্যই মডেম দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ চালানো হলেও সেটা অতিরিক্ত ব্যয়বহুল এবং নিরবচ্ছিন্ন নয় বলেই ব্রডব্যান্ডে ভরসা করেন ফ্রিল্যান্সাররা। তবে অতিরিক্ত মূল্য দিয়েও উন্নতমানের ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন না বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে জড়িত সকলের কাছে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে নিজের অর্জিত টাকার উত্তোলনজনিত সমস্যা। বিশ্বব্যাপী চলমান টাকা আদান-প্রদানের যে পদ্ধতি বা সেবা গ্রহণ করা হয়ে থাকে তা আমাদের দেশে এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। যার ফলে নিজের উপার্জিত টাকা তুলতেও বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয় ফ্রিল্যান্সারদের।
আর এর সাথে যোগ করা যেতে পারে, ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীশক্তির পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও তা যথেষ্ঠ নয়। সামাজিক রীতিনীতি, বাঁধা-বিপত্তি কাটিয়ে নারীদের অবাধ সুযোগের ব্যবস্থা করা বাঞ্চনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা
এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশই হচ্ছে যুবসমাজ। বাংলাদেশের প্রায় বিশ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশী অর্থাৎ প্রায় ৬৫% লোকই ২৫ বছরের কম বয়সী। তবে এই বিশাল, তরুণ আর শক্তিশালী মানবসম্পদের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে।
অবশ্য সাম্প্রতিককালে পেশা হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, হাজার হাজার বাঙালি তরুণ বর্তমানে এই পেশাকেই বেছে নিয়ে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি দেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখছে সর্বদা। তবে আরো যে হাজারো তরুণ বেকারত্বের ঘানি টানছে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং সরকারের তরফ থেকে সু্যোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ডিজিটাল অর্থনীতিতে সরকারের সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।
সরকারের উচিত বেকার যুবকদের প্রযুক্তি নির্ভর দক্ষ শ্রমিকে রূপান্তরিত করা এবং আইটি ভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিংয়ে তাদের জড়িত করায় মনোনিবেশ করা। কেবলমাত্র এই বেকার যুবসমাজকে দক্ষ আর পেশাদার কর্মী বানানোর মধ্য দিয়েই বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ডিজিটাল অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি অর্জন করে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্পকে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব।
ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে আরো জানতে পড়ুন এই বইগুলো