সিলিকন ভ্যালির কথা কে না জানে! যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত এই এলাকার অবস্থান স্যান ফ্রান্সিসকো ও স্যান হোসে শহর দুইটির মাঝখানে। এটি হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সবচেয়ে বড় আস্তানা। তাই প্রযুক্তি ও অর্থনীতিবিদদের কাছে বিশ্বের অন্য অধিকাংশ জায়গার চেয়ে সম্মান ও মর্যাদায় যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে সিলিকন ভ্যালিই।
কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এটি যদি নিছকই একটি এলাকা না হয়ে, পরিপূর্ণ একটি দেশ হতো? বিষয়টাকে অবাস্তব কল্পনা বলে মনে করার কোনো কারণই নেই। কেননা পৃথিবীতে এর চেয়েও কম আয়তনের অনেক দেশ যেমন আছে, তেমনই এক দেশের ভেতর অন্য আরেক দেশের দৃষ্টান্তও বিরল নয়। তাই আমরা তর্কের খাতিরে ধরে নিতেই পারি, সিলিকন ভ্যালির পক্ষেও সম্ভব ছিল স্বতন্ত্র একটি দেশ হয়ে ওঠার। কিন্তু কী হতো সেক্ষেত্রে? সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো, এটি পরিণত হতো বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশগুলোর একটিতে।
ফেডারাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক অ্যানালাইসিস জানাচ্ছে, সিলিকন ভ্যালির মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) ১,২৮,৩০৮ মার্কিন ডলার, যা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের চেয়েই বেশি। এছাড়া এই ভ্যালির মোট উৎপাদন মূল্যমান এই মুহূর্তে ২৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা এমনকি ফিনল্যান্ডের মতো দেশের চেয়েও বেশি।
২০১৭ সালে বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, মাথাপিছু জিডিপি অনুসারে বিশ্বের শীর্ষ দেশ হলো কাতার। দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ১,২৮,৬৪৭ ডলার। অর্থাৎ, কাতারের থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই সিলিকন ভ্যালি। এবং চীনের ক্যাসিনো পেনিনসুলা ম্যাকাউ (১,১৫,৩৬৭ ডলার) ও লুক্সেমবার্গের (১,০৭,৬৪১ ডলার) চেয়ে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে ঢের এগিয়ে আছে এটি।
স্যান হোসের এই মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষের বাস, যাদের মধ্যে রয়েছে নতুন মিলিয়নিয়ার হওয়া অনেক উদ্যোক্তা, এবং বিশ্বের প্রথম সারির অনেক বিলিয়নিয়ারও। এখানকার কুপারটিনোতে রয়েছে অ্যাপলের স্পেসশিপ হেডকোয়ার্টার, পালো আল্টোতে রয়েছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি। এছাড়াও এখানে রয়েছে ফেসবুকের মেনলো পার্ক কমপ্লেক্স। আর মাউন্টেন ভিউতে গুগলের ক্রমবর্ধমান গুগলপ্লেক্স, কম্পিউটার হিস্টোরি মিউজিয়াম এবং নাসার এমস রিসার্চ সেন্টার। আরো উত্তরে, স্যান ফ্রান্সিসকোর উপকূলবর্তীতে রয়েছে টুইটার, উবার, লিফট, ফেসবুকসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সব প্রযুক্তি কোম্পানির অফিস।
স্যান ফ্রান্সিসকো, ওকল্যান্ড এবং তাদের শহরতলীগুলো মিলে গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল মেট্রোপলিটন এলাকা। এখানকার সম্মিলিত মাথাপিছু জিডিপি ৮৯,৯৭৮ ডলার, যা একে রেখেছে সিঙ্গাপুর ও ব্রুনেইয়ের সাথে এক কাতারে।
কেবলমাত্র টেক্সাসের তেল কেন্দ্র মিডল্যান্ডের থেকেই পিছিয়ে রয়েছে সিলিকন ভ্যালি এবং বে এরিয়া। এই মিডল্যান্ডের ১,৬৫,০০০ অধিবাসীর মাথাপিছু জিডিপি ১,৭৪,৭৪৯ ডলার।
সিলিকন ভ্যালির স্থানীয় সংবাদপত্র মারকিউরি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বে এরিয়া কাউন্সিল ইকোনমিক ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট মিকাহ ওয়েইনবার্গ বলেন, সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলের জিডিপি আরো বেশি হতে পারেনি, কেননা ক্যালিফর্নিয়া বাদে অন্যান্য এলাকাগুলোর মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ খুব একটা ভালো নয়।
তবে বিপুল পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হতে সিলিকন ভ্যালিকে কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য উচ্চ জিডিপি সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো, যেমন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কানেকটিকাট, সিয়াটল ও বস্টনের মতো, বে এরিয়া ও সিলিকন ভ্যালিতেও বাসস্থানের জন্য অধিবাসীদেরকে গুনতে হয় প্রচুর পরিমাণ অর্থ। এখানে মাঝারি আকৃতির একটি বাড়ি কিনতে গেলেই খরচ হয় এক মিলিয়ন ডলার। এছাড়া সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সমস্যা আর নিয়মিত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সাথে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান অসাম্য, যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল অবস্থায় রেখেছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এমন অসাধারণ জিডিপিও কখনো কখনো কোনো অঞ্চলের উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি হতে পারে না। অর্থাৎ সিলিকন ভ্যালি যদি একটি স্বতন্ত্র দেশ হতো, তবু সেটি সেখানকার অধিবাসীদের জন্য কোনো স্বর্গরাজ্য হতো না, বরং সেখানে হানাহানি ও বিবাদ লেগে থাকার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
“জিডিপি হলো পরিমাপের একটি একক, যা থেকে আমরা ধারণা পাই কোনো অঞ্চলে মোট উৎপাদনের পরিমাণ ঠিক কতটা। কিন্তু সেই আউটপুট থেকে মানুষ আসলেই কতটা আয় করতে পারছে এবং স্বাচ্ছন্যে জীবনধারণ করতে পারছে, তা জিডিপি নির্ধারণ করে না। অথচ ব্যক্তিগত আয় ও জীবনযাত্রার মানই যেকোনো সম্প্রদায়ের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
এভাবেই সিনিয়র পলিসি অ্যানালিস্ট, লিউ ডেলি ব্যাখ্যা করেন যে, কেন জিডিপির মাধ্যমে সিলিকন ভ্যালির সামগ্রিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটছে না। তিনি আরো বলেন, “জিডিপি আপনাকে একটি সম্প্রদায়ের বৃদ্ধি সম্পর্কে কিছুই বলে না। যদি অর্থনীতি বাড়তে থাকে, তবে কখনো কখনো সেটি একটি নেতিবাচক বিষয়ও হতে পারে, যদি সেই বৃদ্ধি হয় অন্যায্য ও অটেকসইভাবে। জিডিপির আপনাকে এসব নির্ধারক প্রশ্নের সদুত্তরও দিতে পারে না।”
এত উচ্চ জিডিপির পরও সিলিকন ভ্যালির স্থানীয় ও অপেক্ষাকৃত কম সম্পদশালী অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মানের খুব বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন না হওয়ার নেপথ্যে আরেকটি বড় কারণ হলো বিনিয়োগের উৎস। এখানে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন ঘটছে বটে, কিন্তু সেসব উৎপাদনের মূলধন কোথা থেকে আসছে? বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সিলিকন ভ্যালির অধিকাংশ উদ্যোগের বিনিয়োগকারীই এখানকার স্থানীয় কেউ তো নয়ই, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কেউও নয়।
তাহলে সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারী কারা? উত্তরটি হলো: চীন ও সৌদি আরব।
হ্যাঁ পাঠক, সিলিকন ভ্যালিতে যে অর্থের ঝনঝনানি, সেসব অর্থের মালিকানা মূলত চীন ও সৌদি আরবের। সিলিকন ভ্যালিতে প্রতি বছর যেসব নতুন নতুন স্টার্ট-আপ হচ্ছে, কিংবা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোতে আরো বেশি অর্থায়ন ঘটছে, সেগুলোতে অর্থ ঢালছে চীন ও সৌদি আরবের ধনকুবেররাই। প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার তারা বিনিয়োগ করছে সিলিকন ভ্যালিতে। এবং বলাই বাহুল্য, দিনশেষে লাভের গুড়ও সবচেয়ে বেশি খেয়ে যাচ্ছে তারাই। যে পরিমাণ অর্থ তারা বিনিয়োগ করছে, প্রতি অর্থ বছর শেষে সেই অর্থের কয়েকগুণ তারা ফেরত পাচ্ছে। আর সেই ফেরত পাওয়া অর্থে সমৃদ্ধ হচ্ছে চীন ও সৌদি আরবের অর্থনীতি।
২০১৮ সালের এপ্রিলে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তার রাজ্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে বড় চার সেলেব্রিটি বিনিয়োগকারী — স্যাম অ্যাল্টম্যান, মার্ক আন্ড্রিসেন, পিটার থিয়েল এবং বিনোদ খোসলাকে। তাদের সাথে তিনি আলোচনা করেছিলেন সিলিকন ভ্যালিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের মাঝে জুটি বাঁধার ব্যাপারে, যাতে করে সংশ্লিষ্ট সকলেরই থাকবে আরো বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ। এভাবে সিলিকন ভ্যালিতে সৌদি বিনিয়োগের রাস্তা আরো প্রশস্ত করেন ক্রাউন প্রিন্স, যে রাস্তা পরবর্তীতে জামাল খাশোগি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব সম্পর্কের টানাপোড়েনেও সংকুচিত হয়নি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সিলিকন ভ্যালি একদমই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং এটি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি ক্রীড়াক্ষেত্র, যেখানে অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা নিজেদের সম্পদ আরো বাড়িয়ে নেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে। এটি যদি স্বতন্ত্র একটি দেশও হতো, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেই দেশটিকে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বের দ্বিতীয় সম্পদশালী দেশ মনে হতো বটে, কিন্তু সেটি আদতে কতটা স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব লাভ করতে পারত, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। তাই তো, এই এলাকাটি যত সম্পদশালীই হোক না কেন, দেশ-সম্পর্কিত কল্পনায় সিলিকন ভ্যালি নিয়ে অতটাও উচ্চধারণা পোষণের কিছু নেই।
অর্থনীতির চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/