আধুনিক বিশ্বের একটি বিখ্যাত প্রবাদ হলো, “যদি তুমি গরীব হয়ে জন্ম নাও, তবে তাতে তোমার কোনো দোষ নেই। তবে তুমি যদি গরীব হয়ে মৃত্যুবরণ করো, তবে এটা তোমার ভুল।” কথাটির সাথে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা এবং একসময়ের বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটসের নাম জুড়ে দেওয়া হলেও, তিনিই যে এটি বলেছেন তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যা-ই হোক, জন্ম-মৃত্যুর সাথে অর্থের সম্পর্ক আছে কিনা কিংবা গরীবরা কেন গরীব এবং ধনীরা কেন ধনী, তা নিয়ে গবেষণা হয়ে বিস্তর।
গরীবরা কেন গরীব, তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গবেষক, সমাজতাত্ত্বিক আর নৃতত্ত্ববিদরা মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। প্রথম দলের মতে, সারা বিশ্বে এত গরীব কারণ তাদের গরীব হতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা সমাজের কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ। তাদেরকে শোষণ করে ধনীরা আরও ফুলেফেঁপে উঠছে। তাদের সেই গরীব অবস্থা থেকে উত্তরণের সুযোগ সমাজকাঠামোতে রাখা হয়নি। শিক্ষা, চিকিৎসা, সুস্থ পরিবেশ, নিরাপদ খাবার থেকে শুরু করে যাবতীয় মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত গরীবরা শুরু থেকেই শিকার হয় বৈষম্যের, ধনীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে, যার প্রভাব পড়ে ভবিষ্যৎ জীবনেও। ভালো শিক্ষার অভাবে সৃষ্টি হয় বেকারত্ব কিংবা কম বেতনের চাকরি, ফলে তাদের সেই দারিদ্র্যের চক্করেই ঘুরপাক খেতে হয়।
দ্বিতীয় দলের মতে, গরীব হওয়ার পেছনে এসব কারণ তো রয়েছেই, সাথে রয়েছে গরীব হয়ে থাকার মানসিকতা। অর্থাৎ, তাদের মতে, গরীবরা গরীব হয়ে থাকে কারণ তাদের মধ্যে গরীব হয়ে থেকে থাকার সংস্কৃতি-মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে, আর এই ধারার নাম দারিদ্র্যের সংস্কৃতি বা Culture of Poverty। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও শুরুতে জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই তত্ত্বের উদ্ভব হলো, আর কী-ই বা এর মূলকথা।
দারিদ্র্যের সংস্কৃতি
Culture of Poverty শব্দটি প্রথম উল্লেখ করেন মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ অস্কার লুইস তার Five Families: Mexican Case Studies in the Culture of Poverty বইটিতে। তার মতে, গরীব হওয়ার সাথে সমাজকাঠামোর সংযোগ এমনভাবে রয়েছে যে, এই দারিদ্র্যের বোঝা গরীবদের মধ্যে ছোটোবেলা থেকেই চেপে বসে এবং তাদের আচার-আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে এই গরীব থাকার প্রবণতা চিরদিনের জন্য ছাপ ফেলে যায়, যার ফলে তারা এই দারিদ্র্য থেকে আর মুক্ত হতে পারে না।
অর্থাৎ, যাদের জন্ম গরীব পরিবারে এবং যারা দারিদ্র্যের মধ্যেই বেড়ে ওঠে, তাদের মনের মধ্যে গরীবী মনোভাবের ছাপ লেগে যায়, আর এই ছাপ এতটাই প্রকট এবং তাদের মনের মধ্যে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে, তারা আর এই দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না বা চায় না। তারা নিজেদের মধ্যেই একটি উপ-সংস্কৃতি (Sub-Culture) তৈরি করে নেয়, অস্কার লুইস যাকে অভিহিত করেছেন দারিদ্র্যের সংস্কৃতি হিসেবে।
অস্কার লুইস মেক্সিকোর বস্তি নিয়ে গবেষণা করে মোট ৭০টি বৈশিষ্ট্য বের করেছেন, যা এই দারিদ্র্যের সংস্কৃতির নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো: মূল সমাজের সাথে এই উপ-সংস্কৃতির সম্পর্ক, বস্তি তথা গরীবদের নিজস্ব এলাকা এবং গোষ্ঠীর চারিত্রিক অবস্থা, পরিবারের অবস্থা এবং ব্যক্তির নিজস্ব চারিত্রিক অবস্থা।
মূল সমাজের সাথে এই বস্তিবাসীদের সংযোগহীনতা দারিদ্র্যের এক মূল কারণ হিসেবে ধরেছেন অস্কার লুইস। এর ফলে মূল সমাজ এই বস্তিবাসীদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে, তাদের ভয় পায়, ঘেন্না করে, সন্দেহের চোখে দেখে এবং একইসাথে করুণার দৃষ্টিতে দেখে। এই দরিদ্ররা কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন বা রাজনৈতিক দলের সাথেও জড়িত থাকে না, এমনকি ব্যাংক-হাসপাতাল থেকে শুরু করে বড় বড় দোকান বা জাদুঘর-পাবলিক পার্কের মতো জায়গাতেও সাধারণত পা মাড়ায় না। তারা নিজেদের এলাকাতেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ফলে তাদের অবস্থা উন্নতির সুযোগ কমে আসে।
দারিদ্র্যের সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা লোকেরা সাধারণত খুবই অল্প রোজগার করে, এবং প্রায়ই বেকারত্ব কিংবা সামান্য মজুরিতে কাজ করে থাকে। দীর্ঘসময় ধরে চলা এই আয়ের বৈষম্য, বেকারত্ব, সঞ্চয় না থাকা, নগদ টাকার অভাব কিংবা খাবারের অভাবের মধ্যেই তাদের সমগ্র জীবন কেটে যায়। এছাড়াও নিজেদের সামান্য জিনিসপত্র বন্ধক রাখা, চড়া সুদে ধার নেওয়া, প্রতিবেশীদের মধ্যে কোনো রকম লিখিত চুক্তি ছাড়াই মুখে মুখে টাকা ধার নেওয়া, দোকান থেকে বাকিতে কেনা কিংবা অন্যের ব্যবহার করা বা ফেলে দেওয়া পোশাক আর আসবাবপত্র পুনরায় ব্যবহার করাকে অস্কার লুইস উল্লেখ করেছেন দারিদ্র্যের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হিসেবে। মূল সমাজের সাথে সংযোগহীনতা ছাড়াও সমাজের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের একধরনের বৈরিতা চোখে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুলিশকে ঘৃণা করা কিংবা সরকারকে বিশ্বাস না করার মতো বৈশিষ্ট্য।
গরীব বস্তিবাসীদের মধ্যে আলাদা কোনো একতাও চোখে পড়েনি অস্কার লুইসের কাছে। গ্যাং কালচার বা মাস্তানির মতো কাজে কিছুটা একতা দেখা গেলেও সমাজ হিসেবে যে একতা থাকা উচিত ছিল, তা নেই এর মধ্যে। তবে যেসব বস্তি সাধারণত দেওয়াল দিয়ে আলাদা করা থাকে, যেসব বস্তির মানুষের মধ্যে বিশেষ জাতিগত, বর্ণগত কিংবা ভাষার মিল থাকে, যারা মূল সমাজ থেকে আলাদা, তাদের ক্ষেত্রে আবার দারিদ্র্যের সংস্কৃতি খাটে না। অস্কার লুইসের কাছে, এই বস্তিগুলো একটি গ্রাম হিসেবে আবির্ভূত হয়। ষাটের দশকের দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের এভাবে আলাদা করে রাখা হতো, ফলে তাদের মধ্যে আলাদা একতা ছিল, যা মেক্সিকো বা পুয়ের্তো রিকোতে দেখা যায় না।
এই দারিদ্র্যের সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা পরিবারগুলোর মধ্যেও লুইস বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেছেন। তার গবেষণানুযায়ী, পরিবারগুলোর সন্তানদের সাথে তার মায়ের দিকের পরিবারের সাথে গভীর সম্পর্ক থাকে এবং পরিবারের ওপর মায়ের বেশ কর্তৃত্ব দেখা যায়। তাছাড়া অভাবের সংসার থাকায় ভাই-বোনদের মধ্যেও খাবার-অর্থ বা অন্যান্য পণ্য-দ্রব্য নিয়ে রেষারেষি দেখা যায়।
ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব নিয়েও অস্কার লুইসের মত হলো, এই দারিদ্র্যের সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা অন্যের প্রতি নির্ভরশীল হওয়া, সবসময় সাহায্য্যের পথ চেয়ে বসে থাকা কিংবা হীনম্মন্যতায় ভোগার পরিমাণ বেশি। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদের শিকার হওয়া কৃষ্ণাঙ্গরাই নয়, বরং মেক্সিকো এবং পুয়ের্তো রিকোর সাধারণ বস্তিবাসীদের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। অর্থাৎ, এর সাথে বর্ণবাদ বা অন্য কোনো বৈষম্যের সম্পর্ক দেখা যায় না।
এছাড়াও নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে উদাসীনতা, পারিপার্শ্বিক বিষয় নিয়ে উদাসীনতা, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে বর্তমান সময় নিয়ে পড়ে থাকা কিংবা বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও তাদের মতো অনেকেই যে আছে, তার সাথে নিজেদেরকে না মেলাতে পারা বা তাদের সম্পর্কে জানতে সামান্য আগ্রহ না দেখানোও Culture of Poverty-র বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন লুইস।
তবে অস্কার লুইস দারিদ্র্য আর দারিদ্র্যের সংস্কৃতিকে গুলিয়ে যেন না ফেলা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন। দরিদ্র বলতেই যে দারিদ্র্যের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য কোনো ব্যক্তি বা সেই অঞ্চলের গোষ্ঠীর মধ্যে থাকবে এমন নয়। লুইস নিজেই এর অনেকগুলো ব্যতিক্রম উদাহরণ দেখিয়েছেন, এবং কেন এই ব্যতিক্রম তার কারণও উল্লেখ করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের নিম্নবর্ণ, যেমন: চামার কিংবা মেথরদের কথা। এই গোষ্ঠীদের নিজস্ব পঞ্চায়েত বা সালিশ ব্যবস্থা থাকে এবং তাদের সমাজের বন্ধনও বেশ দৃঢ় হয়। যে কারণে নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ শক্ত একতা তৈরি হয়, যা তাদেরকে নিজস্ব পরিচয় দেয়। যে কারণে তাদের মধ্যে দারিদ্র্যের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় না। এছাড়াও পূর্ব ইউরোপের ঘেটো (ইহুদিদের জন্য তৈরি আলাদা বস্তি)-তে থাকা ইহুদিদের মধ্যেও এগুলো চোখে পড়ে না। কারণ তাদের মধ্যে শিক্ষার চর্চা প্রবল এবং শিক্ষা-দীক্ষা অর্জনকে তারা বেশ গুরুত্ব দেয়। এছাড়াও তারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের নির্বাচিত গোষ্ঠী হিসেবে মনে করে, ফলে অকারণে ভাগ্যকে দোষারোপ কিংবা হীনম্মন্যতায় ভোগে না।
প্রভাব
অস্কার লুইস যখন তার এই তত্ত্ব প্রদান করেন, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের গরীব জনগোষ্ঠীর পেছনে বাৎসরিক কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করত শুধু এই গরীবদেরকে স্বাবলম্বী করার জন্য। বিশেষ করে বৈষম্যের শিকার কৃষ্ণাঙ্গরাই ছিল মূল সাহায্যপ্রার্থী। তৎকালীন হিসেব অনুযায়ী, বার্ষিক ৩ হাজার ডলারের চেয়ে (Poverty Line; এর চেয়ে কম আয় করলে গরীব হিসেবে বিবেচিত হবে) কম আয়ের মানুষ ছিল প্রায় ৫ কোটি (মোট জনসংখ্যা ১৯ কোটি)। লুইসের এই গবেষণার পর পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বেশ চাঞ্চল্য পড়ে যায়। বিশেষ করে ধনী শ্বেতাঙ্গরা এই কৃষ্ণাঙ্গদের সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ এই প্রতিবেদন পড়ার পর তারা মনে করতে থাকে তাদের এই দান অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। ‘গরীবরা তাদের স্বভাবের জন্যেই গরীব, তাদেরকে সাহায্য করা হলেও তারা এই অর্থ উড়িয়ে গরীবই থেকে যাবে,’ এই ধারণা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নীতিতেও এই তত্ত্ব প্রভাব বিস্তার করে। তবে এই তত্ত্বের সমালোচনাও কম নয়।
সমালোচনা
অস্কার লুইস তার দারিদ্র্যের সংস্কৃতি তত্ত্বের মাধ্যমে প্রচলিত দারিদ্র্যের ধারণাকে বেশ বড় একটা ধাক্কা দেন। বিশেষ করে যেসব গবেষক সমাজের কাঠামোকেই দারিদ্র্যের মূল কারণ মনে করেন, তারা অস্কার লুইসকে বেশ কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন এই দাবি করে যে, এই তত্ত্বের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। ১৯৭৪ সালে নৃতিত্ত্ববিদ ক্যারল স্ট্যাক লেখেন, লুইস তার বইয়ে যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন, বাস্তব দরিদ্রদের সাথে সেই বৈশিষ্ট্যগুলোর মিল কম এবং এই তত্ত্ব মূলত ধনীদের উদ্দেশ্যকে ন্যায্যতা দেয়।
আরেক সমালোচক হায়ান লুইস দেখান, এই তত্ত্বের পেছনে আসলেই একটি গূঢ় রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। এই তত্ত্বের ফলে আমেরিকার মূল সমাজের সাথে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা নিজেদেরকে এক করতে পারেনি, এ দোষ কেবল তাদেরই বলে প্রতীয়মান হয়। এর ফলে ধনীদের মনে বদ্ধমূল হয় যে, তাদের অর্থ শুধু শুধু অপচয় হচ্ছে। গবেষক থেকে শুরু করে ভোট দেওয়া মার্কিন জনসাধারণ কিংবা জন-উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সবার ওপরেই এই তত্ত্ব একটি বাজে প্রভাব ফেলে, যা রাষ্ট্রীয় নীতিতেও পরিবর্তন আনে, যে কারণে [কৃষ্ণাঙ্গদের] জাতিগত হীনম্মন্যতা আজ চোখের সামনে। নৃতত্ত্ববিদ এবং সমাজতাত্ত্বিকরাও একে তুলনা করেছেন ‘ভিক্টিম-ব্লেমিং’-এর সাথে।
নব্বইয়ের দশক থেকে পুনরায় সামাজিক বিজ্ঞানের শাখাগুলোর গবেষণায় দারিদ্র্যের সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ঘুরেফিরে আসলেও বর্তমানে বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন, দারিদ্র্যের পেছনে গরীবদের আদর্শ-মূল্যবোধের চেয়ে কাঠামোগত সমস্যার হাতই বেশি রয়েছে।