পঞ্জি স্কিম অর্থনীতির এক বহুল পরিচিত শব্দ। যারা অর্থনীতি জগতের খোঁজখবর রাখেন, তারা এ শব্দ দুটোর সাথে বেশ পরিচিত। স্বল্প সময়ে কোনো পরিশ্রম ছাড়াই দ্রুত অর্থ উপার্জনের প্রায় সকল প্রতারণামূলক কাজকেই পঞ্জি স্কিম হিসেবে অভিহিত করা হয়। পঞ্জি স্কিমগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করার মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগের সর্বস্ব আত্মসাত করা। এ ধরনের স্কিম থেকে মূল পরিকল্পনাকারীই কেবল লাভবান হয়ে থাকেন। সঙ্গতভাবেই এ ধরনের ব্যবসার আইনি বৈধতা থাকে না।
পঞ্জি স্কিমগুলোতে কোনো প্রকৃত পণ্য, সেবা বা ব্যবসায়িক কাঠামো থাকে না। থাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা কিছু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি অথবা প্রস্তাবনা। সহজে অর্থ আয় করার লোভ থেকে বিনিয়োগকারীরা এর ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারান। সাধারণ মানুষের লোভকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি বিশেষের লাভবান হওয়ার এমন পঞ্জি স্কিমের ইতিহাস বেশ পুরনো।
পঞ্জি স্কিমগুলো মূলত পিরামিড আকৃতির কাঠামোর হয়ে থাকে, যার একেবারে চূড়ায় থাকে মূল পরিকল্পনাকারীরা, যারা স্কিমটি শুরু করেন। এরপর থাকে প্রাথমিক সদস্যরা। প্রাথমিক সদস্যরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করেন, যারা তাদের নিচের ধাপে থাকে এবং এভাবে সদস্য দ্বারা সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার মাধ্যমে উপর থেকে নিচের দিকে ছড়ানো একটি পিরামিড আকারের গ্রাহক অবস্থান তৈরি হয়। এই পিরামিডের যতই নিচের দিকে যাওয়া যাবে, ততই এর আকৃতিটি ছড়ানো হয়। অর্থাৎ সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরো পরিকল্পনা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রাথমিক সদস্যরাই কেবল লাভবান হতে পারেন। স্বল্পমেয়াদে মুনাফা সহ বিনিয়োগ ফেরৎ পাবার টোপ দেখিয়ে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি করা হয়। নতুন গ্রাহকরা মনে করেন, তারা যদি আরও কিছু গ্রাহককে ঘোষিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন তবে তার মুনাফা আরো বাড়বে। তবে পঞ্জি স্কিমগুলো থেকে গ্রাহকরা শেষপর্যন্ত ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন।
এ ধরনের প্রতারণাগুলোকে পঞ্জি স্কিম কেন বলা হয় ? এর উত্তর জানার জন্য ইতিহাসের দিকে নজর ঘোরাতে হয়।
পঞ্জি স্কিমের ইতিহাস
পঞ্জি স্কিম নামটি মূলত চার্লস পঞ্জি নামের এক প্রতারকের নামানুসারে প্রদান করা হয়েছে। চার্লস পঞ্জি এ ধরনের প্রতারণামূলক স্কিমের মাধ্যমে ১৯২০ সালের দিকে বোস্টনে বেশ হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তার স্কিমটি ছিল তৎকালীন ডাক ব্যবস্থাকে ঘিরে।
সে সময় বিভিন্ন দেশের ডাক বিভাগ নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক কুপন ব্যবহার করতো চিঠিপত্র বিনিময়ের জন্য। এই কুপনগুলোর স্থানীয় মুদ্রামান একই থাকলেও দেশ ভেদে মুদ্রার বিনিময় মূল্যের ওঠা-নামার কারণে অন্য কোনো দেশে তখন এই মান বেড়ে বা কমে যেত। চার্লস পঞ্জি ঠিক এ সুযোগটাই গ্রহণ করেন। এদিকে আরো একটি সুযোগ ছিল, এসব কুপনকে ডাকটিকিটের সাথে পরিবর্তন করার। পরবর্তীতে এসব ডাকটিকিটেরও দাম উঠানামা করতে শুরু করে। একেক দেশে দাম একেক রকম হয়।
চার্লস পঞ্জি ইউরোপে কিছু এজেন্ট নিয়োগ করলেন যাতে আন্তর্জাতিকভাবে এসব কুপন কম মূল্যমানের মুদ্রায় কিনতে পারেন। পঞ্জি এসব সস্তায় ক্রয় করা কুপন, ব্যয়বহুল ডাক টিকেটের সাথে বিনিময় করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই দুই মূল্যের ব্যবধানে বেশ মোটা একটা মুনাফা তিনি পকেটস্থ করলেন। এখান পর্যন্ত ব্যাপারটা তাও ঠিক ছিল। অন্তত আইনত কোন সমস্যা তৈরি হয় নাই। কিন্তু এরপর তিনি আরও বড় পরিকল্পনা কষলেন।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চার্লস পঞ্জি ‘সিকিউরিটি একচেঞ্জ কোম্পানি’ নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানির কার্যক্রম এমনভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করা হলো, যাতে দেখানো হলো এ কোম্পানিটি স্বল্প সময়ের মধ্যে বিস্ময়কর মুনাফা প্রদান করতে সক্ষম। তিনি অবিশ্বাস্য রকমের মুনফার প্রস্তাব দিলেন, যেমন- ৪৫ দিনে ৫০% অথবা ৯০ দিনে ১০০% মুনাফা। পঞ্জি ষ্ট্যাম্প বিক্রির মাধ্যমে যথেষ্ট মুনাফা করায় বাজারে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল এবং বিনিয়োগকারীরা তার উপর আস্থা রাখলেন।
তবে নিজের কোম্পানিতে পঞ্জির খুব কমই বিনিয়োগ ছিল। পঞ্জি বিনিয়োগকারীদেরকে তাদের জমা দেওয়া অর্থই এমনভাবে পুনঃবন্টন করে দিতে শুরু করেন, যাতে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করলো স্কিমটি সত্যিই ভালো মুনাফা করতে সক্ষম। পঞ্জির স্কিমে বিনিয়োগ করার জন্য মানুষের মাঝে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে। তার এই স্কিমটি প্রায় এক বছর চলার পর মার্কিন এস.ই.সি স্কিমটি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। এই ধরনের স্কিমের জনক অবশ্য পঞ্জিকে বলা যাবে না। এই ধারণাটি অনেক আগে থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে আসছিল। ১৮৪০-১৮৬০ সালের চার্লস ডিকেন্সের কয়েকটি উপন্যাসে এরকম স্কিমের উল্লেখ আছে।
পঞ্জি স্কিম কীভাব কাজ করে?
প্রশ্ন হচ্ছে, পঞ্জি স্কিম কীভাবে কাজ করে? সহজভাবে বললে, এটা হচ্ছে একধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রম, যেখানে বিনিয়োগকারীদেরকে সামান্য বিনিয়োগের বিপরীতে বিশাল অংকের একটি লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নতুন বিনিয়োগকারীদের থেকে জমাকৃত টাকা দ্বারাই পুরনো বিনিয়োগকারীদের টাকা প্রদান করা হয়।
স্কিমের আকার যত বড় হতে থাকে নতুন বিনিয়োগকারীদের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। ফলে স্কিমে বিনিয়োগকৃত টাকার পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখানে তারাই টাকা উপার্জন করতে পারে যারা পিরামিডটির একদম উপরের দিকে অবস্থান করে। প্রতিটি সদস্য আরো নতুন নতুন সদস্য যোগ করার মাধ্যমে পঞ্জির পিরামিডকে আরও বড় করে তোলে। এ ধরনের ব্যবসা শুধুমাত্র মানুষের লোভের উপর ভিত্তি করে টিকে থাকে। ব্যবসার স্থায়িত্ব নির্ভর করে নতুন সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির উপর। একটা সময় সদস্য বৃদ্ধির হার কমে যায় এবং নতুন সদস্য আর পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে পঞ্জি স্কিম ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং উদ্যোক্তারা পালিয়ে যেতে শুরু করেন। স্কিমের প্রতিষ্ঠাতা পালিয়ে গেলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ফেরত পাবার কোনো সুযোগ থাকে না। বেশিরভাগ সময় নিম্ন আয়ের মানুষরাই এসব পঞ্জি স্কিমের প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে, কারণ তারা খুব দ্রুত ধনী হতে চায়।
কেন পঞ্জি স্কিমে মানুষ বিশ্বাস করে?
পঞ্জি স্কিমের সফলতার পেছনে দুটি বিষয় কাজ করে। প্রথমত, মানুষের লোভ, এবং দ্বিতীয়ত, সহজে অর্থ উপার্জনের তীব্র আকাঙ্খা। পঞ্জি স্কিম খুব দ্রুত বিশাল অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, যেখানে টাকা উপার্জন করতে বিনিয়োগকারীদের কিছুই করতে হয় না। তারা কেবল বিনিয়োগ করবেন আর মুনাফা গুনবেন। আর এই লোভের কারণেই তারা ফেঁসে যায়। পঞ্জি স্কিমের তথ্যগুলোতেও অস্পষ্টতা থাকে। বেশিরভাগ সময় বিনিয়োগকারীরা তথ্যগুলো খতিয়ে দেখেন না। কম সময়ে অপ্রত্যাশিত মুনাফার লোভ তাদেরকে অসর্তক করে রাখে। তারা কখনোই তলিয়ে দেখেন না কীভাবে স্কিমটি উপার্জনের মাধ্যমে তাদের মুনাফা প্রদান করবে।
আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো পঞ্জি স্কিমগুলো অবাস্তব ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সামনে হাজির হয়। বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী কেবল মাত্র লোভের কারণে অবাস্তব হওয়ার পরও এসব বিনিয়োগে আগ্রহী হন। বিনিয়োগকারীরা সব সময়ই জানেন, কোনো কিছুই বিনামূল্যে, বিনা পরিশ্রমে পাওয়া যায় না। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা কেবল লোভের কারণে এই কঠিন সত্যটা ভুলে যান।
পঞ্জি স্কিমের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
প্রতিটি পঞ্জি স্কিমেরই কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন-
- প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসেবে নির্দিষ্ট টাকা নির্ধারণ ক…
- বিশাল অংকের অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি।
- আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ পরিকল্পনার অস্পষ্ট বর্ণনা।
- বিনিয়োগকারীদের স্বল্প জ্ঞানের সুবিধা নেওয়া।
- মাঝে মাঝে গোপন বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ আয় করে তা প্রচার করা।
- স্কিমের সম্পর্কে যেকোনো ধরনের তথ্য প্রদান এড়িয়ে চলা।
- প্রাথমিক বিনিয়োগকারীদের বিশাল মুনাফাসহ মূল অর্থ ফেরত প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে আরো বিনিয়োগের প্রলুব্ধ করা। এরাই আরও নতুন গ্রাহক নিয়ে আসেন।
ম্যাডফ পঞ্জি স্কিম
পঞ্জি স্কিমের কথা উঠলে যে নামটি না বললেই নয় তা হলো বার্নাড ম্যাডফ, যিনি সাম্প্রতিক সময়ের শেয়ার বাজারের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ছিলেন। ২০০৮ সালে ম্যাডফের পুত্র বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পরে এই কেলেঙ্কারির পর্দা ফাঁস হয়। ম্যাডফ নাসদাকের একজন চেয়ারম্যান ছিলেন, যিনি পঞ্জি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই জালিয়াতি প্রতিষ্ঠান ১৯৬০ সালে চালু হয় এবং ৪০ বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তিনি জনগণকে এমন অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন, যার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। অবশেষে যখন পঞ্জি কেলেঙ্কারির বিষয়টি উন্মোচিত হলো, তাকে ১১টি ফেডারেল অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারে তাকে ১৫০ বছর কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়। তার প্রতিষ্ঠানের দেনার পরিমাণ ছিল ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং তার জালিয়াতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৪.৮ বিলিয়ন ডলার। ২০০৮ এর শেষভাগে যখন এই কেলেঙ্কারির পর্দা উন্মোচন হয় তখন তার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪,৮০০।
পঞ্জি স্কিমের বিপদ সংকেতগুলো কী কী?
কীভাবে পঞ্জি স্কিমকে শনাক্ত করবেন? এজন্য ব্যবসার মডেল খুঁজে বের করতে হবে। ব্যবসার আয়ের উৎস কী তা শনাক্ত করতে হবে। সবসময় প্রশ্ন করতে হবে এত অধিক আয়ের উৎস কী। কোনো ব্যবসার মডেল না জেনে তাতে বিনিয়োগ করা যাবে না। স্কিমের বিশাল আয়ের দাবির সত্যতা মূল্যায়ন করা গেলে সহজেই বোঝা যাবে স্কিমে বিনিয়োগ করলে কতটুকু মুনাফা পাওয়া সম্ভব।
স্কিমের প্রচারকদের প্রশ্ন করতে হবে, স্কিমের আয় কি সবসময় স্থিতিশীল থাকবে? থাকলে কীভাবে? কারণ বিনিয়োগ কৌশল যতই অভিনব হোক না কেন, সবসময় একই ধরনের স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কেউ এমন দাবী করলে সে সর্ম্পকে সতর্কতা আবশ্যক। খেয়াল রাখতে হবে, বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেতে একজন বিনিয়োগকারীর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। সেই সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, উত্তোলিত অর্থ কি কোনো না কোনো অজুহাতে পুনরায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে কি না। যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে আপনার সতর্ক হতে হবে।
কীভাবে পঞ্জি স্কিম উন্মোচিত হয়
বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভেতরের কোনো লোক স্কিম সর্ম্পকে অবহিত করার পরই কেবল এই পঞ্জি স্কিমগুলোর পর্দা ফাঁস হয়। আর গোপনীয়তা সত্ত্বেও পঞ্জি স্কিম একসময় ঠিকই মুখ থুবড়ে পড়ে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে, যার ভেতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণটি হচ্ছে, পিরামিড একটি প্রান্তিক পর্যায়ে এসে থামতে বাধ্য হয়। যার মানে হচ্ছে, কোনো নতুন বিনিয়োগকারী এতে আর অর্থ বিনিয়োগ করেন না। তাই অর্থের উৎস বা তারল্য কমে যাওয়ায় স্কিমটি সমাপ্তিতে পৌঁছাতে বাধ্য হয়। এ সময় যখন অনেক লোক একসাথে তাদের মূল অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে, তখন বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায় এবং পঞ্জি স্কিমের গোমড় ফাঁস হয়ে যায়। এছাড়াও বিশ্ব অর্থনীতি এবং বাজার পরিস্থিতির ওঠা-নামাও পঞ্জি স্কিমসমূহ অবসান ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নিচের ছবিতে পঞ্জি স্কিম সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।