২৫ জানুয়ারি চীন জুড়ে জাঁকজমকভাবে লুনার নিউ ইয়ার পালন করার কথা ছিল। চীনের এই উৎসবকে পশ্চিমা বিশ্বের থ্যাংকস গিভিং ডে এবং বড়দিনের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। এই উৎসবের সময় চীনের সাধারণ মানুষ তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হন। একইসাথে তারা প্রচুর কেনাকাটা ও সিনেমা দেখার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন।
লুনার নিউ ইয়ারকে সামনে রেখে ২৪ জানুয়ারি থেকে চীনে ছুটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে উহানে সৃষ্ট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে চীন সরকার ১৪টি প্রদেশে ছুটি এক সপ্তাহ বৃদ্ধি করে। এর মধ্যে চীনের রপ্তানির শক্তিঘর হিসেবে পরিচিত গুয়াংডং প্রদেশও রয়েছে। যেখানে চীনের টেক সিটি শেনজেন অবস্থিত। এছাড়া বন্দর নগরী সাংহাই ও জিয়াংসু শহরও অতিরিক্ত ছুটির কবলে পড়েছে।
চীনের মোট জিডিপির প্রায় ৬৯ শতাংশ আসে এই তিনটি স্থান থেকে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে চীন জুড়ে উৎপাদন ব্যবস্থা প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। জেনারেল মটরস ও টয়োটার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে জনবহুল স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে এ বছর লুনার নিউ ইয়ারের কেনাবেচায় বড় এক ধাক্কা লেগেছে। ম্যাকডোনাল্ড ও স্টারবাকসের মতো ফুড চেইনশপ তাদের অধিকাংশ শাখা বন্ধ রেখেছে। পাশাপাশি আমেরিকান, ডেল্টা ও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ চীনের ফ্লাইটগুলো বাতিল করে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় যে স্থবিরতা নেমে এসেছে তার প্রভাব কতদূর পর্যন্ত পড়বে? করোনা ভাইরাস কী শুধু চীনের অর্থনীতির জন্য হুমকি নাকি পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে এটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে?
চীনের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত
২০০২ সালে চীনে যখন সার্স ভাইরাস ছড়ায় তখন টি-শার্ট ও স্নিকার্সের মতো কম মূল্যের পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় পথে বসেছিল। এর ১৭ বছর পর আবারো চীনে আরেকটি ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করেছে। এবং এবারও এই ভাইরাসটি চীনের উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। তবে সার্স ভাইরাসের সময়কার চীন ও বর্তমান চীনের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো তাদের অর্থনীতি। তখন চীনের জিডিপি ছিল ১.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে দেশটির জিডিপি ১৩.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
এত বিশাল অর্থনীতির দেশে এক সপ্তাহের বেশি সময় স্থবির হয়ে থাকার প্রভাব বেশ সুদূরপ্রসারী। করোনা ভাইরাসের কারণে এ বছর চীনের আর্থিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াতে পারে ৫.৬ শতাংশে। যা গত বছর ছিল ৬.১ শতাংশ। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ০.২ শতাংশ কমে গিয়ে ২.৩ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। যা সর্বশেষ বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার পর সবচেয়ে কম।
লুনার নিউ ইয়ার চীনের পর্যটন ও সেবা খাতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম। কিন্তু এ বছর হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো প্রায় জনশূন্য ছিল। অধিকাংশ কনসার্ট ও স্পোর্টিং ইভেন্ট বাতিল করা হয়েছে। একাধিক সিনেমা মুক্তি দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সেগুলো স্থগিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। যা শুধুমাত্র বছরের প্রথম কোয়ার্টারের আনুমানিক হিসাব।
করোনা ভাইরাসের কারণে চীনে বেকারত্বের হারও বৃদ্ধি পেতে পারে। চলতি বছর চীনের চাকরির বাজার এমনিতেই চাপে ছিল। চীনের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রযুক্তি খাতে কাজের সুযোগ আগের চেয়ে কমেছে। এর মধ্যে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।
এছাড়া প্রতিবছর চীনের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ গ্রাম থেকে শহরে কাজের সন্ধানে আসেন। তারা খুবই কম মূল্যে নির্মাণ ও উৎপাদন খাতে কাজ করে থাকেন। কিন্তু এ বছর অনেক কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে তাদের কাজ পাওয়া বেশ কঠিন হবে। বিশেষ করে হুবেই প্রদেশের ১০ লাখ কর্মজীবী মানুষকে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হবে। কারণ সেখানেই করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্যে দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তা নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে চীনের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে এ বছর জীবনের সাথে সংগ্রাম করতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো যেসব বিদেশী কোম্পানি চীনের উপর নির্ভরশীল তারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যদি এরপরও তারা যদি তাদের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ চীন থেকে না পায়, তাহলে তারা বিকল্প চিন্তাভাবনা করবে। এক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব ইউরোপিয়ান কোম্পানি চীন থেকে তৈরি পোশাক কিনে থাকেন, তারা বাংলাদেশ কিংবা ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।
চীনকে আরো যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুতে দুই দেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি মোতাবেক আগামী দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে হবে চীনকে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যের উপর আরোপিত শুল্কের কিছু অংশ কমাবে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন বিশেষ কিছু প্রযুক্তিগত পণ্য আমদানি করে থাকে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তাদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুধুমাত্র ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য ক্রয় করতে হবে। যা চীনের জন্য বলা যায় অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু চীন যদি চুক্তি না মানে তাহলে তাদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে কর আরোপ করার সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে যদি চীনের সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়, তাহলে তাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০০ বিলিয়ন মার্কিস ডলার অর্থমূল্যের পণ্য কেনা সম্ভব হবে না। ফলে চীনকে এই বিষয়টি নিয়েও চাপে থাকতে হবে।
বিদেশী কোম্পানিগুলো যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে
করোনা ভাইরাস যে শুধু চীনের অর্থনীতিকে সমস্যায় ফেলেছে তা কিন্তু নয়। বরং চীনের সাথে যেসব দেশের ব্যবসায়ীক লেনদেন বেশি তারাও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের বড় কিছু কোম্পানি একদিকে চীন থেকে পণ্য ক্রয় করে। আবার একইসাথে চীনেই তারা বিক্রি করে। ফলে এখানে উভয় সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে তারা চাহিদা মোতাবেক পণ্য পাচ্ছে না। যা তারা চাইলে কোনো দেশে বিক্রি করতে পারে। আরেকদিকে চীনের ক্রেতাদের তারা সাময়িকভাবে হারাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট অ্যাপল তাদের অধিকাংশ পণ্যই চীনে সংযোজন করে থাকে। কিন্তু করোনা ভাইরাসে ছড়িয়ে পড়ার পর অ্যাপল তাদের কর্মীদের চীন ভ্রমণের উপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। কোম্পানিটি বর্তমানে দুই ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, তারা তাদের পণ্যের সরবরাহ সঠিক সময়ে পাবে কি না। আর দ্বিতীয়ত, তারা বছরের প্রথম কোয়ার্টারে চীনে কেমন ব্যবসা করতে পারবে। কারণ চীন অ্যাপলের জন্য বড় একটি বাজার। গত বছর তারা ছয় ভাগের এক ভাগ পণ্য চীনে বিক্রি করেছে। কিন্তু ভাইরাসের কারণে তাদের ৪২টি শাখা বন্ধ করতে হয়েছে।
বাচ্চাদের খেলনা নির্মাণে শীর্ষে রয়েছে চীন। কিন্তু চীন-মার্কিন বাণিজ্যের যুদ্ধের কারণে এই খাতটি অনেকদিন ধরে বেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প অতিরিক্ত কর বসানোর হুমকি দেওয়ার পর চীনের অনেক কোম্পানি দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্রেতাদের চাহিদা মোতাবেক খেলনা তৈরি করেছিল। পাশাপাশি অধিকাংশ খেলনা তারা থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে মজুদ করে রেখেছিল।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি হওয়ার পর এখন আর সে ধরনের হুমকি নেই। কিন্তু বর্তমানে তারা করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করছে। সামনেই জার্মানির নুরেমবার্গে আন্তর্জাতিক খেলনা মেলা হবে। সেখানে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করে থাকে। পাশাপাশি তাদের থেকে বিভিন্ন কোম্পানি খেলনা ক্রয় করে থাকে। কিন্তু এই সময়ে চীনের অনেক খেলনা তৈরির কারখানা বন্ধ রয়েছে। ফলে তাদের উপর নির্ভরশীল অনেক কোম্পানিও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
তবে করোনা ভাইরাস সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে পর্যটন খাতে। গতবছর চীন থেকে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন পর্যটক বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছে৷ চীনের পর্যটকদের উপর ম্যারিয়ট হোটেল অনেকটাই নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে চীনই তাদের সর্ববৃহৎ বাজার। ২০১৮ সালে তারা আলিবাবার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। আলিবাবার মাধ্যমে চীনের পর্যটকরা চীন, হংকং, ম্যাকাও, তাইওয়ানসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশে হোটেলের কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন।
কিন্তু এবার করোনা ভাইরাসের কারণে ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ পর্যন্ত চীনের নাগরিকদের বুকিং বাতিল করেছে ম্যারিয়ট। এতে করে শুধু ম্যারিয়টই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সেই সাথে চীনের নাগরিকদের যেসব দেশে ভ্রমণের কথা ছিল তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ একজন চীনা পর্যটক কোথাও ভ্রমণে গেলে কেনাকাটার জন্য গড়ে ৭৬২ মার্কিন ডলার ব্যয় করে। যেখানে অন্যরা একই কাজে ব্যয় করে গড়ে ৪৮৬ মার্কিন ডলার।
মূল বিষয় হচ্ছে চীন বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। একইসাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চীনের পণ্যের উপর নির্ভরশীল। আবার অনেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বড় বাজারও চীন। এখন সেখানে যদি করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে মানবিক ও অর্থনৈতিক দুই ধরনের বিপর্যয়ই ঘটবে। চীনের অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব সারাবিশ্বেই পড়বে। বাংলাদেশের সাথে চীনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বেশ গভীর। ফলে আমাদেরও এর সম্মুখীন হতে হবে।
তবে আশার কথা হলো ২০০৩ সালে চীনে যখন সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তখনও চীনের অর্থনীতি একটা ধাক্কা খেয়েছিল। কিন্তু সে ধাক্কায় তারা ভেঙে পড়েনি। বরং তারা বিস্ময়করভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেই সময় চীনে একজনও বিলিওনিয়ার ছিল না। কিন্তু বর্তমানে চীনে ৩২৪ জনের মতো বিলিওনিয়ার।
করোনা ভাইরাস চীন ও বিশ্ব অর্থনীতির অবশ্যই বড় ধরনের হুমকি। তবে এর সবকিছুই নির্ভর করছে করোনা ভাইরাসের স্থায়িত্বের উপর। এই ভাইরাস নির্মূল করতে যত সময় অতিবাহিত হবে, বিশ্ব অর্থনীতি তত বেশি চাপের মধ্যে পড়বে।