বর্তমান পৃথিবীর দিকে নজর বুলালেই সম্পদের প্রকট বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের সামনে। এ বৈষম্য প্রধানত দুই প্রকার। বিভিন্ন জাতির মধ্যে বৈষম্য আর একই জাতির বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে বৈষম্য। প্রথম প্রকার বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করা হবে এখানে। এ বৈষম্য একদিনে বা কোনো একটি-দুটি কারণে সৃষ্টি হয়নি। অনেকগুলো প্রভাবক কাজ করে এর পেছনে। তার মাঝে একটি প্রভাবক, প্রাকৃতিক প্রভাবক নিয়ে আলোচনা করব। এর ফলেই এটি শুরু হয়েছিল।
আমরা উপনিবেশবাদের ইতিহাস জানি। পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে ইউরোপীয়রা তাদের উপনিবেশের বিস্তার করেছিল। কখনো প্রশ্ন জাগে কি, ব্রিটিশ বা ইউরেশিয়ার হাতে গোনা কয়েকটি দেশই কেন পরাশক্তি হয়ে উঠল? কেন আফ্রিকা বা পৃথিবীর অন্য প্রান্তের কোনো দেশ হল না? চিত্রটা তো অন্যরকমও হতে পারত। হয়ত অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ইংল্যান্ড আক্রমণ করে তাদের পদানত করতে পারত। কিন্তু এমনটি হয়নি। কেন হয়নি?
তেমন বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই একটা উত্তর আসে অনেকের মনে, ইউরোপীয়রা অন্যদের তুলনায় বেশি চতুর ও বুদ্ধিমান কিংবা বেশি আক্রমণাত্বক ছিল। তারাও নিজেদের সম্পর্কে এরকমই ভাবত। কেউ কেউ বলে, অন্য অঞ্চলের মানুষজন আসলে শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিল তাই তারা ইউরোপীয়দের আক্রমণ করেনি বা তাদের সাথে পেরে ওঠেনি।
এ দু’টি উত্তরে আসলে একই কথা বলা হচ্ছে। এ দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য ছিল যার কারণে এটি ঘটেছে। এটি আসলে একধরনের মনগড়া জবাব। এখানে বিচার বিশ্লেষণ না করে বলে দিতে চাচ্ছে যে, তারা শিকারে পরিণত হয়েছে কারণ তারা যথেষ্ট চতুর বা বুদ্ধিমান ছিল না। এ মনগড়া জবাবে আঁটকে না থেকে চলুন দেখে নিই এ বৈষম্যের শুরু হল কীভাবে।
মানবজাতির ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব, জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তারা প্রাণী শিকার করত, ফলফলাদি আহরণ করত আর তা দিয়েই চলত তাদের বেঁচে থাকা। এক্ষেত্রে মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন আসে মোটামুটি বারো হাজার বছর পূর্বে যখন কৃষি বিপ্লব ঘটে। এটি সত্যিকার অর্থেই বৈপ্লবিক সময় কারণ এরপর আর মানুষকে সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির দয়ার ওপর নির্ভর করতে হত না।
মানুষ জানতে পারে কীভাবে প্রকৃতির কাছ থেকে আদায় করে নিতে হয়। কীভাবে নিজেদের চাহিদামতো শস্য উৎপাদন করতে হয়। মানুষ কি খুব আনন্দের সাথে এ আবিষ্কার করছিল? না। মানুকে কৃষির আবিষ্কার করতে হয়েছিল কারণ তারা প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে ভুগছিল। শিকারযুগে একটা পর্যায়ে এসে মানুষ বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় উপনীত হয় যে, তাদের প্রয়োজনীয় শিকারযোগ্য প্রাণীর সংখ্যা কমে যায়। জীবন ধারণের জন্য পর্যাপ্ত ফলমূলও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই এর বিকল্প খুঁজতে গিয়েই একটা সময় কৃষির আবিষ্কার হয়।
অন্যান্য প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মতোই কৃষিও সকল অঞ্চলে একই রূপে বিকশিত হয়নি। যেসব অঞ্চলের প্রকৃতিতে তখনো মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ফলমূল কিংবা শিকারযোগ্য প্রাণী ছিল সেখানে কৃষির বিকাশের প্রয়োজন হয়নি। কৃষির বিকাশ ঘটেছে সেসকল অঞ্চলে যেখানে অন্যথায় মানুষকে খাদ্যাভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে হতো। এখান থেকেই শুরু হয় বৈষম্যের। পৃথিবীর এক অংশে কৃষি বিপ্লব ঘটে, অন্য অঞ্চল তখনো পড়ে থাকে সেই শিকার যুগে। কৃষি বিপ্লব যেসকল অঞ্চলে ঘটে সেখানের সমাজ-কাঠামোতে এটি অভাবনীয় পরিবর্তন নিয়ে আসে।
এ পরিবর্তনের সূচনা হয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে। সেটি হল ‘সারপ্লাস’ বা উদ্বৃত্ত। কৃষিযুগে এসে প্রথম মানুষ তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়, যা ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখা সম্ভব। শিকারযুগে তা সম্ভব ছিল না, কারণ ফলমূল, মাছ বা মাংস এগুলোর প্রায় সবই পচনশীল। সে তুলনায় গম, যব, ভুট্টা ইত্যাদি শস্যকণা জমা করে রাখা যেত কোনো দুর্দিনের জন্য অথবা সামনের বছরগুলোতে আবার চাষ করার জন্য। এই উদ্বৃত্তের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে সমাজে প্রচলন হয় লেখন পদ্ধতি, ঋণ, অর্থ, রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী ইত্যাদির। বদলে যায় সম্পূর্ণ সমাজ কাঠামোই। কীভাবে হল এটি?
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রথম লেখালেখির প্রচলন শুরু হয় মেসোপটেমিয়ায়। বর্তমানে ইরাক ও সিরিয়া যেখানে অবস্থিত সে অঞ্চলে। একজন কৃষক শস্যভাণ্ডারে কী পরিমাণ উদ্বৃত্ত শস্য দিয়েছে তার রশিদ লিখে রাখতেন তারা। এটা স্বাভবিকভাবেই বোঝা যায় সকল কৃষকের পক্ষে নিজস্ব শস্যভাণ্ডার তৈরি করা সম্ভব ছিল না। তাই সাধারণের জন্য একটি সংগ্রহশালা বা ভাণ্ডার তৈরি করা হতো। সেখানে কোনো কৃষক কী পরিমাণ শস্য দিয়েছে সে তথ্য রাখাটাও প্রয়োজনীয় ছিল, সেখান থেকেই উদ্ভব হয় লেখার ধারণার।
এ উদ্বৃত্ত জমা রাখার পদ্ধতির হাত ধরে ঋণ, অর্থ ও মূদ্রার প্রচলনও শুরু হয়। কোনো কৃষক তার শাসকের জন্য যে পরিমাণ শ্রম দিয়েছে তার প্রাপ্য অনুসারে তাকে সংখ্যা খোদাই করা ঝিনুক বা এরকম কিছু দেয়া হতো। যে শস্য দিয়ে এ দায় মেটানো হবে তা হয়তো তখনো উৎপন্নই হয়নি। তাই এটি কৃষকের কাছে শাসকের ঋণ হিসেবে থেকে যেত। পরবর্তীতে এটি ব্যবহার করে একজন কৃষক অন্যজনের উৎপাদিত পণ্যও নিতে পারত। তাই এটি মূদ্রা হিসেবে কাজ করতে শুরু করে।
এই অর্থব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল বিশ্বাস। একজন কৃষককে বিশ্বাস করতে হবে যে, তার হাতে সংখ্যা লেখা যে ঝিনুকটি আছে তার বিনিময়ে তিনি শস্য পাবেন শস্যভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে। অন্যরা যখন তাকে এটির বিনিময়ে অন্য কোনো পণ্য দেবে তাদেরও এ বিশ্বাস থাকতে হবে।
এ বিশ্বাস কীভাবে জন্মাবে? শক্তিশালী কেউ একজন অথবা অন্য কোনো কতৃপক্ষের কাছে এ দায়িত্ব থাকতে হবে, যারা তাদের নিশ্চয়তা দিতে পারবেন। এ কারণেই জন্ম নেয় বর্তমানের সরকারের মতো প্রতিষ্ঠান। কর্তৃত্ব পান রাজা-রাজড়ারা। জন্ম নেয় রাষ্ট্র। জনগণের সার্বজনীন বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণের জন্য আমলাতন্ত্রের জন্ম হয়। অভ্যন্তরীণ শত্রু ও বহিঃশত্রু থেকে জনগণ ও মালামালের নিরাপত্তার জন্য আসে পুলিশ ও সেনাবাহিনী।
উদ্বৃত্ত পণ্য থেকে সমাজে এভাবেই একটি জটিল ব্যবস্থার তৈরি হয়ে গেল। উদ্বৃত্ত পণ্যের ব্যবস্থাপনার জন্য আসলো ঋণ, ঋণের হাত ধরে আসলো অর্থ। এ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য প্রয়োজন হল রাষ্ট্র নামক একটি প্রতিষ্ঠানের। আসলো শাসক, পুলিশ, সেনাবাহিনী ইত্যাদি। এসবই কিন্তু এসেছে কৃষিযুগে, উদ্বৃত্ত পণ্যের বদৌলতে। যেসব অঞ্চল তখনো কৃষিযুগে পদার্পণ করেনি, তারা কিন্তু তখনো সেই সরল শিকারযুগেই রয়ে গেছে।
কৃষিযুগে এসে শিকারযুগের তুলনায় আরো একটি দিকে অসাধারণ উন্নতি হয়েছে। সেটি হল প্রযুক্তি। আর বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য উন্নতি হয়েছে অস্ত্রশস্ত্রেরও। তবে তাদের সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে কিছু অণুজীব; ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি। তখন শস্যভাণ্ডারগুলোতে টনের পর টন শস্যদানা একত্রে থাকত। পাশাপাশি মানুষও বড় বড় জনপদ গঠন করে একত্রে থাকা শুরু করেছিল। আবর্জনার ব্যবস্থাপনা সেখানে ছিল না বললেই চলে। ফলস্বরূপ ব্যাপক হারে জন্ম নিতে থাকে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ইত্যাদি। ছড়িয়ে পড়ে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে। এর ফলে মহামারীতে বহু মানুষ মারা যেতে থাকে। তবে সময়ের সাথে সাথে এসব সমাজের মানুষ এসব রোগের সাথে অনেকটা মানিয়ে নিতে শেখে। কলেরা, টাইফাস, ফ্লু তাদের শরীরে অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য হয়ে ওঠে।
এই কৃষিযুগের মানুষদের যখন বিভিন্ন উপজাতির সাথে স্বাক্ষাৎ হয়, যারা তখনো কৃষিযুগে প্রবেশ করেনি। তখন তাদের সংস্পর্শে ছড়ানো এসব ভাইরাসই উপজাতিদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠছিল। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা জেনেশুনেও এ ভাইরাস বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে ছড়িয়েছিল। একবার ইউরোপিয়ান এক দূত জেনেশুনে এক আমেরিকান আদিবাসী গোত্রকে একটি কম্বল উপহার দেয়, যেটিতে গুটিবসন্তের ভাইরাস ছিল। সেই একটি কম্বলই ঐ আধিবাসীর ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছিল।
কৃষি কীভাবে সমাজকে বদলে দিয়েছিল সে সম্পর্কে তো জানা গেল, এবার তাহলে সেই পুরনো প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক। কেন কেবল অল্প কিছু দেশই পরাশক্তি হয়ে উঠল? তারা কি তবে অন্যদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ছিল? না, উত্তরটা লুকিয়ে আছে তাদের ভৌগলিক অবস্থানে, প্রকৃতিতে। ইউরেশিয়ার দেশগুলোর প্রকৃতিতে তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ফলমূল বা শিকারযোগ্য প্রাণীর অভাব পড়েছিল। এটি তাদের বাধ্য করেছিল কৃষিযুগে প্রবেশ করতে। কৃষিযুগ তাদের দিয়েছে জটিল সমাজব্যবস্থা, প্রযুক্তি, অস্ত্রশস্ত্র ও ভয়ংকর সব অণীজীব ও তাদের প্রতি সহনশীলতা। কিন্তু বিস্তৃত পৃথিবীর অন্যান্য অনেক অঞ্চল যেমন অষ্ট্রেলিয়ায় প্রকৃতি অনেক উদার ছিল যার ফলে মানুষ রয়ে গিয়েছিল শিকারযুগেই। আবার আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে কৃষি আবিষ্কার হলেও ভৌগলিক বৈচিত্রের কারণে তারা ততটা বিস্তার ঘটাতে পারেনি এর, যেমনটা পেরেছিল ইউরোপীয়রা। তাই আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার মতো অঞ্চলগুলোতে সমাজ কাঠামো, প্রযুক্তি বা সেনাবাহিনী কোনো ক্ষেত্রেই তেমন উন্নত হতে পারেনি।
ফলে পরবর্তীতে ইউরোপের পরাশক্তিরা গিয়ে তাদের সহজেই অধীনস্থ করতে পেরেছিল। তাই ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ইউরোপীয়দের বুদ্ধিমত্তা নয় বরং পৃথিবীর ভৌগলিক বৈচিত্র্যই ঠিক করে দিয়েছিল যে আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এসব অঞ্চল তাদের অধীনে আসবে।
তথ্যসূত্র
Talking to My Daughter About the Economy: A Brief History of Capitalism by Yanis Varoufakis (পৃষ্ঠা: ১-২১)
ফিচার ইমেজ- strategic-culture.org