Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য রিয়ারগার্ড অ্যাকশন হিরো বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল

আদিকালে প্রতিটি সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করা হতো; সামনের অংশকে ‘ভ্যান’ বা সম্মুখ ভাগ, মাঝের অংশকে ‘মিডল’ বা ‘মেইন বডি’, আর পেছনের অংশকে বলা হতো ‘রিয়ার’ বা পশ্চাৎ ভাগ। শক্তিশালী ‘গার্ড’ বা অশ্বারোহী সৈন্যরা থাকত এই ‘ভ্যান’, ‘মিডল’ আর ‘রিয়ার’ সামলাতে; তাই এদের বলা হতো ‘ভ্যানগার্ড’, ‘ফ্ল্যাঙ্কগার্ড’ আর ‘রিয়ারগার্ড’।

সে সময় যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু কখনো কখনো সুযোগ বুঝে পেছন থেকে আক্রমণ করে ফায়দা লুটতে চাইত, আবার পিছু হটার সময়ও শত্রু তক্কেতক্কে থাকত অতর্কিতে পিছু ধাওয়া করে সব এলোমেলো করে দিতে। তাই সব সেনাবাহিনীই শক্তিশালী রিয়ারগার্ড রাখত যেন বেকায়দায় পড়লেও অন্তত জানে বেঁচে সরে আসা যায়। কারণ, পিছু হটে সরে এলেও ফের আক্রমণ করার সুযোগ থাকে, কিন্তু মৃত সৈন্যরা তো কখনোই আর প্রাণ ফিরে পায় না!

‘রিয়ারগার্ড’ এর এই কাজটিকে বলে ‘রিয়ারগার্ড অ্যাকশন’। পিছু হটার সিদ্ধান্তটা পাকা হতেই রিয়ারগার্ড অ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। তাই সব রিয়ারগার্ডকে শুরু থেকেই বেশ নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে লড়তে হয়। একে তো অর্গানাইজড ফর্মেশনে[1] পিছু হটা যেকোনো আর্মির জন্যই বেশ কঠিন। কারণ, একবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেই সর্বনাশ, পিছু হটা মুহূর্তেই দিগ্বিদিক পলায়নে পরিণত হয়। তার ওপর রিয়ারগার্ড যদি কোনোভাবে ধ্বংস হয় অথবা আউটফ্ল্যাঙ্কড[2] হয়, তাহলে শত্রুর ভ্যানগার্ড হুড়মুড় করে পেছন থেকে হামলে পড়ে মুহূর্তেই সব তছনছ করে ফেলবে। তাই রিয়ারগার্ড অ্যাকশন মানেই নিজের জীবন দিয়ে অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে বদ্ধপরিকর একদল সৈন্যের যুদ্ধ। ব্যাপারটা অবশ্যই পার্ট অব ড্রিল[3], কিন্তু এই ‘রিয়ারগার্ড অ্যাকশন হিরো’দের মনোবল (Motivation) নিঃসন্দেহে অতুলনীয়।

চার বছরের চাকরির অভিজ্ঞতায় অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক[4] মোস্তফাকে অবশ্য কখনোই রিয়ারগার্ড অ্যাকশনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের ‘বেস্ট বক্সার’ হিসেবে যেকোনো কাজেই মোস্তফা ইউনিটের সেরাদেরই একজন, তাই সামনের সারিতে থেকেই লড়ে অভ্যস্ত তিনি। মোস্তফার অধিনায়ক মেজর শাফায়েত জামিলও তার প্রগাঢ় দেশপ্রেম, কমরেডশিপ আর উন্নত পেশাদারিত্বের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তাই তো অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হলেও তার কাঁধে সেকশন কমান্ডারের গুরুদায়িত্ব তুলে দিতে তিনি এতটুকু দ্বিধা করেননি।

অলংকরণ: রহমান আজাদ

১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে থাকা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে দুর্বল করে দিতে ভারতীয় নাশকতাবাদীদের দমানোর নাম করে এর কোম্পানিগুলোকে আলাদা করে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মেজর খালেদ মোশাররফ তখন তার কোম্পানি নিয়ে ছিলেন সিলেটের শমশেরনগরে, আর মেজর শাফায়েত জামিলের কোম্পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। যুদ্ধ শুরু হতেই ২৭ মার্চ সকালে মেজর শাফায়েত জামিল চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার (ইউনিটের অধিনায়ক) লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খান সহ সব পাকিস্তানি অফিসার আর সৈন্যদের বন্দী করে ফেললেন।

এপ্রিলের শুরু থেকেই চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সব কোম্পানি একত্রিত হয়ে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মেঘনা নদীর দক্ষিণ থেকে পশ্চিম পাশ বরাবর এক শক্তিশালী ডিফেন্স[5] গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের রেললাইন আর ব্রিজ ধরে সামনে এগিয়ে আসার সব পথ বন্ধ করে দেওয়ার। কিন্তু মরিয়া পাকবাহিনী যখন জঙ্গি বিমান সহ প্রবল আক্রমণ শুরু করল, তখন বাধ্য হয়েই চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিসেনারা আশুগঞ্জ, উজানিশ্বর আর ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার অ্যান্ডারসন খাল বরাবর নেয়া ডিফেন্স ছেড়ে আখাউড়া, গঙ্গা সাগর আর দরুইন গ্রামে নতুন করে ডিফেন্স নিল। দরুইন গ্রামে ডিফেন্স নিয়েছিল চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের ডি কোম্পানির ২নং প্লাটুন[6]। মোস্তফা ছিলেন এই প্লাটুনেরই একজন সেকশন কমান্ডার।

আখাউড়ায় মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সটা ছিল তিতাস নদী ধরে। আখাউড়া দখল করার উদ্দেশ্যে পাক সেনারা বেশ কয়েকবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসে আক্রমণ শানিয়েছিল; কিন্তু প্রত্যেকবারই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে যেতে বাধ্য হলো তারা। অগত্যা পাকিস্তানি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবার কুমিল্লার দিক থেকে এগিয়ে এল। প্রথমে তারা সায়েদাবাদ (সৈয়দাবাদ) দখল করে নিল। তারপর রেললাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে এপ্রিলের ১৩ তারিখে গঙ্গা সাগর ডিফেন্সে কনটাক্ট[7] করে ফেলল। অবশ্য গঙ্গা সাগরের দরুইন গ্রামে ডিফেন্স নেওয়া মোস্তফাদের ২নং প্লাটুনের সফল প্রতিরোধের মুখে পাক সেনারা হাওড়া নদীর দক্ষিণেই থেমে যেতে বাধ্য হলো।

দরুইন ডিফেন্সে বাধা পেয়েই পাকিস্তানিরা একটা কুইক অ্যাটাকের[8] মাধ্যমে মুক্তিসেনাদের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ৮ জন মুক্তিযোদ্ধার তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে মোস্তফারা সেই কুইক অ্যাটাক ফিরিয়ে দিল। ৩ জন অফিসার আর ৭০-৭৫ জন সৈন্য খুইয়ে পাক সেনারা লেজ গুটিয়ে ফিরে গেল।

তবে এক প্লাটুন নিয়মিত পদাতিক মুক্তিযোদ্ধা, এক প্লাটুন ইপিআর[9] আর গণযোদ্ধারা মিলে দরুইনে যে দুর্দান্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ লড়ল, তাতে পাকিস্তানি ব্রিগেড কমান্ডারের টনক নড়ে গেল। ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নটিকে দ্রুত পেছনে সরিয়ে নিয়ে নতুন একটা ব্যাটালিয়নকে দুই দিনের ভেতর দরুইন দখলের নির্দেশ দিলেন তিনি। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন তখন আখাউড়ায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের দায়িত্বে ছিলেন। আসন্ন ডেলিবারেট অ্যাটাকের[10] কথা ভেবে তিনি দরুইন চলে এলেন ইউনিটের সহযোদ্ধাদের উৎসাহ যোগাতে। আক্রান্ত হওয়ার পর শত্রুর যথাসম্ভব ক্ষয়ক্ষতি করে সবাইকে আখাউড়ায় পিছিয়ে আসার জন্য তিনি সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন।

১৬ এপ্রিল পাক সেনারা কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এবার তারা বেশ সাবধানী। প্রথমে উজানিশ্বর ব্রিজের ধারে বিনোতি আর বটমাথা গ্রামে ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের দুই কোম্পানি সৈন্য হেলি লিফট[11] করে নামানো হলো। এরপর শুরু হলো দরুইনের ওপর আর্টিলারি আর মেশিনগানের গোলা-গুলিবর্ষণ। এরই মধ্যে ১৭ এপ্রিল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের ডি কোম্পানির ১১নং প্লাটুন রিইনফোর্সমেন্ট[12] হিসেবে দরুইনে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিল।

১৮ এপ্রিল ভোর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল, সেই সাথে পাকিস্তান বিমানবাহিনী আর আর্টিলারি একযোগে গোলাবর্ষণ শুরু করল, যেন দরুইন গ্রামটাকে থেঁতলে মাটিতে মিশিয়ে ফেলতে চাইছে। বৃষ্টি আর গোলাবর্ষণের ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানিরা মোগড়া বাজার পর্যন্ত এগিয়ে এসে একটা দালানের ছাদে ভারী মেশিনগান স্থাপন করে ফেলল। এরপর এই মেশিনগানের ফায়ারের কাভারে তারা দরুইনের দিকে এগোতে লাগল।

মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিল, এই মুষলধারে বৃষ্টিতে পাকিস্তানিরা বোধ হয় বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত দূর থেকে গোলাগুলি করেই ক্ষান্ত থাকবে। কিন্তু পাকিস্তানি কমান্ডার সেই সুযোগটাই নিল আর অতর্কিতে হামলা করে মুক্তিসেনাদের হতভম্ব করে দিল। মুহূর্তেই মোস্তফারা ৯ জন মুক্তিসেনা হারাল, হতাহত হলো আরও অনেকে। অতএব পিছু হটা ছাড়া গত্যান্তর নেই।

পিছু হটা বা পশ্চাদপসরণ যুদ্ধেরই আরেক কলা, বড় বাহিনীর ক্ষেত্রে যেমন রিয়ারগার্ড পিছু হটার সময় মূল সেনাদলের নিরাপদে সরে আসা নিশ্চিত করে, ছোট বাহিনীর ক্ষেত্রে তেমনি একটা ‘রিয়ার পার্টি’ মাটি কামড়ে পড়ে থেকে বাকিদের পিছু হটতে সুযোগ করে দেয়। মোস্তফার প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার রেজাউল যখন তার প্লাটুনের সবাইকে নিয়ে রেললাইন অতিক্রমের চেষ্টা করছিলেন, তখন শত্রুর ছোঁড়া রকেট লাঞ্চারের আঘাতে তার রিয়ারপার্টির উভয় এলএমজি ম্যান ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। অগত্যা সুবেদার রেজাউল তাকালেন মোস্তফা কামালের দিকে।

যুদ্ধের ডামাডোলে আলাদা করে কিছু শুনতে পারা দায়। কিন্তু প্রশিক্ষিত সৈনিকেরা যুদ্ধের ভাষা বোঝেন, সহযোদ্ধাদের চোখের ভাষাও বোঝেন। কোম্পানির বাকিদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের একমাত্র উপায় এখন এগিয়ে আসা পাকিস্তানিদের কিছুক্ষণের জন্য ঠেকিয়ে রাখা। কালবিলম্ব না করে প্রায় ৮০০ রাউন্ড গুলি সহ মোস্তফা একটা এলএমজি নিয়ে তার ট্রেঞ্চে সেঁধিয়ে গেলেন।

মোস্তফা কামালের এলএমজি দিয়ে যেন বুলেট-বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল, এগিয়ে আসা পাকিস্তানিদের বিভ্রান্ত করতে অবস্থান বদলে তিন দিকেই ব্যতিব্যস্ত রাখলেন তিনি। এই সুযোগে সুবেদার রেজাউল তার প্লাটুন নিয়ে পিছিয়ে গেলেন। শত্রু যখন প্রায় ৭৫ গজ দূরে, তখন তার সাথের শেষ দুই সহযোদ্ধাও পিছু হটার প্রস্তুতি নিলেন। এরপর আসলে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই। শত্রু ইতোমধ্যে তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে তাদের, এবার বৃত্তটা ক্রমশ ছোট করে আনাটাই বাকি। কিন্তু রিয়ারগার্ড অ্যাকশন হিরো মোস্তফা শেষ দুজন সহযোদ্ধার নিরাপদে পিছু হটে যাওয়াটাও নিশ্চিত করতে চাইলেন।

কিছুক্ষণ পর দরুইন গ্রামের উপকণ্ঠে একলা একটা এলএমজি ক্ষয়কাশির রোগীর মতো খকখক করে কাশতে কাশতে থেমে গেল। হামাগুঁড়ি দিয়ে বৃত্তাকারে এগিয়ে আসা হায়েনার দল এবার ফের এগোতে শুরু করল, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শ্রেষ্ঠ বক্সার অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক মোস্তফা ফাঁকা এলএমজিটা সরিয়ে রেখে ঋজু পায়ে ট্রেঞ্চের মেঝেতে উঠে দাঁড়ালেন, তার শরীরটা সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ। জীবনের শেষ বাউটটা খেলবেন বলে এগিয়ে আসা পাকিস্তানি হায়েনাদের দিকে শ্যোন দৃষ্টিতে চোখ বোলালেন তিনি…

অলংকরণ: রহমান আজাদ

বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফার সংক্ষিপ্ত জীবনী

মোহাম্মদ মোস্তফা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান এবং মাতার নাম মোছাম্মৎ মালেকা বেগম। তার পিতা ছিলেন সেনাবাহিনীর হাবিলদার, এলাকার সবাই তাকে ‘হাফিজ মিলিটারি’ নামেই চিনত।

মোস্তফার শৈশব কাটে কুমিল্লা সেনানিবাসে পিতার সরকারি বাসায়। ডানপিটে কিশোর মোস্তফাকে সামরিক জীবন খুব টানত, কিন্তু তার পিতা চাইতেন মোস্তফা পড়াশোনা করে যেন আরও বড় কিছু হন। অগত্যা ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৮ সালের ২২ জুন তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন।

১৯৭০ সালে তিনি ১৬ বছরের কিশোরী পেয়ারা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন, তখন পেয়ারা বেগম ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। মোস্তফা তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, তার অনুপস্থিতিতেই যদি তাদের অনাগত সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তবে ছেলে হলে ‘বাচ্চু’ আর মেয়ে হলে ‘টুনি’ নাম রাখতে। তার মৃত্যুর সময় ছেলে বাচ্চুর বয়স ছিল মাত্র দেড় মাস।

মোস্তফা ছিলেন চৌকস মুষ্টিযোদ্ধা, একাধিকবার তিনি ইউনিটের সেরা বক্সার নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের বক্সিং রিং তার নামেই নামকরণ করা হয়। অনেকেরই দাবি, যুদ্ধ শুরুর আগেই শ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে ইউনিট অধিনায়ক তাকে অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক ঘোষণা করেন। অবশ্য অনেকের ভাষ্যমতে, তার সাহস, বুদ্ধি আর কর্মদক্ষতার কারণে মেজর শাফায়াত জামিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাকে মৌখিকভাবে ল্যান্স নায়েক পদমর্যাদা প্রদান করেছিলেন।

টানা দুই দিনের শেষ যুদ্ধে মোস্তফা একাই প্রায় দেড়শ’ পাকিস্তানি সেনা নিধন করে যান। মোস্তফা তার জীবন বিসর্জন দিয়ে সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। দরুইন গ্রামের আপামর জনগণ অতি সম্মান ও আন্তরিকতার সাথে দরুইন গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে তার ট্রেঞ্চের পাশেই তাকে সমাহিত করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের সমাধি। ছবি: সামহোয়্যার ইন ব্লগ

ফুটনোট

[১] ছোট ছোট ইউনিটে বিভক্ত হয়ে গুছিয়ে চলাচল।
[২] শত্রুর যেকোনো এক পাশ দিয়ে এড়িয়ে তার পেছনে চলে আসা।
[৩] কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট আচরণ প্রদর্শন, যেমন ‘ইনকামিং’ শোনামাত্র শক্ত কিছুর আড়ালে আশ্রয় নেয়া।
[৪] কোনো বিশেষ কৃতিত্বের জন্য যখন একজন সিপাহীকে ল্যান্স নায়েক র‍্যাঙ্ক পরিধানের অনুমতি দেওয়া হয়, যদিও তার বেতন সিপাহীর স্কেলেই দেওয়া হয় তখন তাকে অবৈতনিক ল্যান্সনায়েক বলে।
[৫] প্রতিরক্ষা ব্যুহ
[৬] একটি সেকশনে থাকে ৮-১০ জন সৈনিক। তিন সেকশন মিলে এক প্লাটুন, তিন প্লাটুনে এক কোম্পানি, চার কোম্পানিতে এক ব্যাটালিয়ন, তিন ব্যাটালিয়নে এক ব্রিগেড, ন্যূনতম তিন ব্রিগেড নিয়ে একটা ইনফেন্ট্রি ডিভিশন গড়ে ওঠে।
[7] প্রতিপক্ষের সংস্পর্শে আসা।
[8] বাধাগ্রস্ত হবার সাথে সাথে দ্রুত আক্রমণ করা।
[9] ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বাংলাদেশ রাইফেলস, বর্তমানে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ।
[10] যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে পরিকল্পিত আক্রমণ।
[11] হেলিকপ্টারে বহন করে সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে নামিয়ে দেওয়া।
[১২] সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে শক্তিবৃদ্ধি করা।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থাবলি

১।  হাসান হাফিজুর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, অষ্টম থেকে একাদশ খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্পাদিত, বিজি প্রেস, তেজগাঁও, ঢাকা, নভেম্বর, ১৯৮২।
২।  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংকলিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস, দশদিশা প্রিন্টার্স, ১২৪, আরামবাগ, ঢাকা-১০০০, মার্চ, ২০০৬।
৩।  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংকলিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, দশদিশা প্রিন্টার্স, ১২৪, আরামবাগ, ঢাকা-১০০০, মার্চ, ২০০৬।
৪।  মুহাম্মদ নূরুল কাদির, দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা, মুক্ত প্রকাশনী, ১২৯ দক্ষিণ কমলাপুর রোড, ঢাকা-১২১৭, ২৬ মার্চ, ১৯৯৭।
৫।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, বইমেলা ২০০৮।
৬।  মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, মে ২০১৫।
৭।  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, ১ম থেকে ৫ম খণ্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শিক্ষা পরিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত, এশিয়া পাবলিকেশনস, ৩৬/৭ বাংলাবাজার, ঢাকা, মে ২০১৫।
৮।  মিলি রহমান সম্পাদিত, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর স্মারকগ্রন্থ, আগামী প্রকাশনী, ৩৬ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।
৯।  লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতীক, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেশে ফেরা, শুধুই মুক্তিযুদ্ধ প্রকাশনী, ৭২ ইন্দিরা রোড, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
১০। চন্দন চৌধুরী, বীরশ্রেষ্ঠ, কথাপ্রকাশ, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা-১০০০, ফেব্রুয়ারি ২০০৮।
১১। সাইদ হাসান দারা, সাত বীরশ্রেষ্ঠ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সময় প্রকাশন, ৩৮/২ক বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১০।
১২। ডা. মোহাম্মদ সেলিম খান, বাংলার বীরশ্রেষ্ঠ, মুক্তপ্রকাশ, ৩৮ বাংলাবাজার, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১১।
১৩। History of Counter Insurgency Operations in Chittagong Hill Tracts (1976-1999), Vol-2, Chapter – 3, 4 and 5, Page – Appendix 4E1-1.

ফিচার ছবি- রহমান আজাদ

[বি: দ্র: ডেল এইচ খানের লেখা সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বের সবকটি গল্প পড়তে চাইলে দেখুন আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বীরগাথা‘ বইটি।]

Muhammad Mustafa, better known as Shaheed Sipahi Muhammad Mustafa was a sepoy in the Bangladesh Army during the Liberation War.

Related Articles