“অতঃপর তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকলো।” এই বাক্যটি আমাদের খুব পরিচিত। প্রায় সব রূপকথার গল্পের শেষ হয় এই বাক্য দিয়ে। সুখে-শান্তিতে বাস করার পর রূপকথায় কী হয় সেটা আমাদের জানা নেই। তবে বাস্তব জীবনে কী হতে পারে সেটার ছোট্ট একটা উদাহরণ হিসেবে ত্রিশের দশকে ঘটে যাওয়া ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ এর কথা বলা যেতেই পারে।
১৯২০ এর দশককে রূপকথার সেই ‘সুখে শান্তিতে বসবাস করার’ সময় বলা যেতে পারে। কারণ তখন অর্থনীতি ছিল বেশ স্থিতিশীল। ছিল পর্যাপ্ত চাকরি, আয় এবং স্থির মূল্যস্তর (Stable price level)। ১৯২০-২৮ সাল পর্যন্ত সবাই একরকম সুখে-শান্তিতে বাস করলেও বাস্তব যেহেতু রূপকথার মতো না, তাই ১৯২৯ সালের অক্টোবর মাসে ঘটে যাওয়া আমেরিকার স্টক মার্কেটে ধস থেকেই আমরা দেখতে শুরু করি বাস্তব জীবনে ‘সুখে শান্তিতে বসবাস করা’র পর কী হতে পারে। এই স্টক মার্কেট ধসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন, যেটা চলতে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। যে মন্দাটা হয়ে ওঠে আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ আর ভয়ংকর অর্থনৈতিক মন্দা। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদেরা যাকে আখ্যা দিয়েছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক ঘটনা বলে।
এই মহামন্দার ফলে বেকারত্ব বেড়ে যায়, প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের চাকরি হারায়। প্রাইস লেভেলের সাথে প্রোডাকশন লেভেলেও একটা ধস নামে। আর এই সবগুলো মিলে ঘটে ভয়ানক অর্থনৈতিক পতন। অর্থনীতিবিদরা ক্লাসিক ইনভিজিবল হ্যান্ড (Invisible hand) তত্ত্ব প্রয়োগ করে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করেছিলেন, তবে কোনো লাভ হয়নি তাতে।
কেন ক্লাসিক্যাল মডেল কাজ করলো না?
যেহেতু প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ চাকরিহারা হয়েছেন, তাই অর্থনীতিবিদেরা ভাবলেন, শ্রমবাজারে (Labor market) একটা উদ্বৃত্ত তৈরী হবে। কারণ হঠাৎ করে এত বেকার তৈরি হওয়ায় চাহিদার চেয়ে যোগান বেড়ে গিয়েছে। ফলে কম মজুরিতে ফার্মগুলো তাদের কাজে নিতে পারবে। এতে ফার্মগুলো বেশি মানুষ নিয়ে তাদের উৎপাদন বাড়াতে পারবে এবং সেগুলো বিক্রি করে তাদের ক্ষতিও কিছু পুষিয়ে নিতে পারবে।
কিন্তু সে আশায় বালি দিয়ে একটা প্রশ্ন তৈরি হলো, “উৎপাদিত পণ্যগুলো কিনবে কারা?” যেহেতু ফার্মগুলো কম মজুরিতে মানুষকে চাকরি দেবে, তাই চাকরি পাওয়ার পরেও তাদের রোজগার তেমন বাড়বে না। ফলে বেশি উৎপাদন করেও লাভ হবে না, কারণ মানুষের হাতে অর্থ নেই। আর তাই ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির এই আইডিয়া একদমই কাজে লাগলো না। ওদিকে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে লাগল।
ঠিক পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৩০ সালে বেকারত্বের হার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেল। সে বছর দেড় মিলিয়ন থেকে প্রায় ১৩ মিলিয়ন মানুষ তাদের চাকরি হারায়। অবস্থা যখন দিন দিন খারাপ হচ্ছে, ১৯৩৬ সালে জন মেনার্ড কেইনস নামে এক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ, যাকে পরবর্তীতে বলা হবে ম্যাক্রোইকোনমিকসের জনক, একটি বই প্রকাশ করেন যার নাম ‘The General Theory of Employment, Interest and Money’। কেইনস এই বইয়ে ক্লাসিক ইকোনমিক মডেলকে চ্যালেঞ্জ করলেন। শুধু তা-ই না, নিজেও কিছু পরামর্শ দিলেন এই ক্রান্তিকাল থেকে উত্তরণের জন্য। বললেন, যেহেতু পুরো অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে আছে, তাই মূল্য এবং মজুরির চেয়ে সামষ্টিক চাহিদা বাড়ানোর ব্যাপারটি আমলে নেয়া উচিত এবং ক্লাসিক ইকোনমিক থিওরি ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের উচিত হস্তক্ষেপ করা।
সরকার কীভাবে সামষ্টিক চাহিদা বৃদ্ধি করবে?
যেহেতু মানুষের কাছে অর্থ ছিল না তাই বড় একটা প্রশ্ন ছিল, পণ্যগুলো কারা কিনবে। কেইনস এই সমস্যা সমাধানের জন্য বাড়িয়ে দিতে বললেন সামষ্টিক চাহিদা।
সাধারণত মানুষের কাছে যখন অর্থ, ভোগ করার উদ্দেশ্য এবং কিছু কেনার ইচ্ছা থাকে, তখন তার কোনো পণ্য বা সেবার প্রতি চাহিদা তৈরি হয়। যদি তার কাছে অর্থ না থাকে, স্বাভাবিকভাবেই সে কিছু কিনবে না। এই অবস্থায় সরকার চাকরির সুযোগ তৈরি করে মানুষকে অর্থোপার্জনের ব্যবস্থা করে দিতে পারে যেন পণ্য বা সেবার চাহিদা সৃষ্টি হয়। সরকার কীভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে? উত্তর হতে পারে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান করে, ট্যাক্স কমিয়ে কিংবা উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা করে।
কেইনসের অবদান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর, বিশেষ করে ‘৫০-এর দশকে কেইনসিয়ান ভিউ অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। সরকার বিশ্বাস করতে শুরু করে- কর্মসংস্থান এবং উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা হস্তক্ষেপ করতে পারে। এ কারণে এবং আরেকটা মহামন্দার আশঙ্কায় আমেরিকার কংগ্রেসে ১৯৪৬ সালে ‘The Employment Act of 1946’ গঠিত হয়। এই আইনটি ধারণ করেছে ম্যাক্রোইকোনমিকসের মূল তিনটি প্রশ্নকে:
১) কেন উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান কখনও কখনও হ্রাস পায় এবং কীভাবে বেকারত্ব হ্রাস করা যায়?
২) মূল্যস্ফীতির উৎস কী কী এবং কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়?
৩) কোনো দেশ কীভাবে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে পারে?
এই প্রশ্নগুলোর ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করা হয়েছে ম্যাক্রোইকোনমিকসের লক্ষ্য:
১) উৎপাদন বৃদ্ধি,
২) স্থিতিশীল মূল্যস্তর, এবং
৩) উচ্চ কর্মসংস্থান এবং নিম্ন বেকারত্ব বজায় রাখা।
শেষ কথা
রূপকথার গল্পের শেষে সবাই সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে বলেই এরপর আর গল্প নেই। এর আগে নানা রকম সমস্যা আছে বলেই সেগুলো আমরা আগ্রহ নিয়ে শুনি। বাস্তব জীবনে এরকম হ্যাপি এন্ডিং নেই বলে কিছুকাল সুখের পর ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ এর মতো নতুন কোনো সমস্যা হাজির হয়। সেই সমস্যাগুলো যতটা আমাদের ঝামেলায় ফেলে, তারচেয়েও বেশি এনে দেয় নতুন কোনো সম্ভাবনা। দিনশেষে আমরা পাই নতুন পথের সন্ধান। আর এভাবেই চলেছে আমাদের জীবন, আমাদের সভ্যতা।