এমন একজন মানুষের কথা কল্পনা করুন যিনি সর্বদা সততা ধরে রাখেন, যিনি সাহসী কিন্তু আগ্রাসী নন, যিনি জানেন কখন কী করতে হবে, কোথায় কী বলতে হবে, যিনি আত্মবিশ্বাসী কিন্তু অহংকারী নন, যিনি উদার কিন্তু অমিতব্যয়ী নন। এতগুলো গুণাবলী একজন ব্যক্তির মাঝে কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছে, তাই না? আমাদের যদিও মনে হবে এরকম মানুষের অস্তিত্ব আসলে সমাজে নেই। কিন্তু অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, সংখ্যায় কম হলেও সমাজে অবশ্যই এমন মানুষ রয়েছেন যাদের মাঝে এই সকল গুণাবলীর সমাহার ঘটেছে।
এই মানুষদেরকে তিনি ‘ভার্চুয়াস’ বা পুণ্যাত্মা বলে অভিহিত করেছেন। তাদের নিয়ে লিখে গেছেন নীতিশাস্ত্রের এক নতুন দর্শন ‘ভার্চু থিওরি’। নীতিশাস্ত্রের অন্যান্য দর্শনের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে এই যে, ভার্চু থিওরি বা পূণ্য তত্ত্ব মানুষকে একগাদা নিয়ম কানুনের কথা না শুনিয়ে বরং মানুষের চরিত্রের উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে। কঠোরভাবে নিয়মনীতি অনুসরণ করার চেষ্টা না করে কেবল ভালো মানুষ হবার চেষ্টা করতে হবে। ভালো কাজগুলো তাহলে আপনা থেকেই হতে থাকবে। কিন্তু ভালো মানুষ কীভাবে হতে হবে? কেনই বা পূণ্যবান মানুষ হতে হবে আমাদের? অ্যারিস্টটলের উত্তর ‘ইউডাইমোনিয়া’।
ইউডাইমোনিয়ার আলোচনায় পরে আসছি। প্রথমেই জানা দরকার ভালো কাজ বলতে কী বোঝায়। অ্যারিস্টটলের মতে, যা কিছু যথাযথভাবে চলে তা-ই ভালো কাজ। অর্থাৎ, জীব বা জড়ের যে নিজস্বতা রয়েছে, সেটি যথার্থভাবে পূরণ করতে পারলেই সেটি ভালো। একটি ছুরি যদি যথাযথভাবে কাটতে না পারে, তাহলে সেটি ভালো না। গাছের যে ফলটি খেলে সন্তুষ্ট হওয়া যায় না বা তৃপ্তি মেটে না, তা ভালো নয়। তেমনিভাবে মানুষ যেহেতু একটি প্রাণী, সে সঠিকভাবে বেড়ে উঠলে, চলতে ফিরতে শিখলে তবেই সে ভালো মানুষ। তবে মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। মানুষ একই সাথে বুদ্ধিমান এবং সামাজিক প্রাণী। তাই ভালো মানুষ হতে হলে যৌক্তিকতা এবং সামাজিকতার কোটাও পূরণ করতে হবে।
অ্যারিস্টটলের মৃত্যুর বহু বছর পর ইতালিয়ান দার্শনিক অ্যাকুইনাস নৈতিকতার ‘ন্যাচারাল ল থিওরি’ দাঁড় করান। তার মতে, পৃথিবীতে ‘ভালো’ আর ‘মন্দ’ এ দুটি ব্যাপারই পরম। সৃষ্টিকর্তা মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময়ই ভালো আর মন্দ এ ব্যাপার দুটি মানুষের মনে মগজে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। অনেকে এই তত্ত্বের সাথে অ্যারিস্টটলের পূণ্য তত্ত্বের মিল খুঁজে পান। আসলে অ্যাকুইনাস অ্যারিস্টটলের দর্শন দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু তাই বলে উভয়ের দর্শন একইরূপ ছিল না। অ্যারিস্টটল ভালো আর মন্দের মতো ব্যাপারগুলো পরম বলে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতিই এমনভাবে সজ্জিত হয়েছে যে আমাদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে পাপ বা পূণ্যময় কাজ করার আকাঙ্ক্ষা জাগে কিংবা আমরা বাধ্য হই। এখানে প্রশ্ন থাকতে পারে- পূণ্য আসলে কী? অ্যারিস্টটলের জুতসই উত্তরটাই শোনা যাক।
“পূণ্য বলতে বোঝায় সঠিক জিনিসটি সঠিক সময়ে, সঠিক উপায়ে, সঠিক পরিমাণে, উপযুক্ত মানুষের সাথে করা।”
তাহলে পাপ? পূণ্যের বিপরীতই তো পাপ। সে আর ভাবতে হবে কেন? কিন্তু পূণ্য তত্ত্বের সমালোচকরা ঠিকই ভেবেছেন এবং তাদের মতে পূণ্যের এই সংজ্ঞা খুবই অস্পষ্ট এবং অপর্যাপ্ত। সঠিক কাজ করাই পূণ্য, এ কথা যে কেউই বলতে পারেন। এই সঠিক কাজ আসলে কী তা-ও তো সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন আছে। অ্যারিস্টটল তা করেছেনও, তবে একটু ভিন্ন উপায়ে। তার মতে, সঠিক কাজটা সঠিক পরিমাণে হলেই তা পূণ্য, বেশি হলেও হবে না, কম হলেও না। নিচের ছবিটির মতো অ্যারিস্টটল একটি সরলরেখা কল্পনা করেছেন, যার দুই প্রান্তে রয়েছে ‘ভাইস’ বা পাপ এবং মধ্যবিন্দুতে আছে পূণ্য। একপ্রান্তে সঠিক কাজ অপর্যাপ্ত আর অন্য প্রান্তে অতিরিক্ত। কিন্তু মধ্যবিন্দুতে সঠিক পরিমাণে সঠিক কাজটি হয়েছে বলে সেটি পূণ্য। ‘সাহস’ হচ্ছে একটি সদগুণ। চলুন অ্যারিস্টটলের চোখে সাহসের একটি দৃশ্যকল্প কল্পনা করা যাক।
মনে করুন, আপনি রাস্তায় বের হয়েই দেখতে পেলেন যে এক ছিনতাইকারী একজন বৃদ্ধ মহিলার হাতের ব্যাগটি ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় আপনার কী করা উচিৎ? কিছু না ভেবেই বলে দেয়া যায় যে, সাহসী ব্যক্তি ছিনতাইকারীর সাথে মারামারি করে হলেও বৃদ্ধ মহিলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু অ্যারিস্টটলের পূণ্য তত্ত্ব ভিন্ন কিছুই বলে। একজন সাহসী ব্যক্তি প্রথমে কিছু না করে বরং পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিচার করবেন কী করা উচিৎ। যদি দেখতে পান যে ছিনতাইকারী আপনার চেয়ে অধিক শক্তিশালী, যার হাতে অস্ত্রও রয়েছে এবং এমতাবস্থায় আপনি যদি কিছু করতে যান তাহলে আপনার এবং ঐ বৃদ্ধ মহিলার, উভয়েরই ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে আপনার নিজে থেকে কিছু না করে সাহায্যের ব্যবস্থা করাই হবে যথার্থ কাজ।
এ অবস্থায় আপনি অতিরিক্ত সাহস দেখিয়ে চরমপন্থা অবলম্বন করলে তা হবে নিছক অদূরদর্শিতা। আর পরিস্থিতি অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও আপনি কিছু না করে পালিয়ে গেলে সেটা হবে ভীরুতা। অ্যারিস্টটলের মতে সাহস হচ্ছে ভীরুতা এবং চরমপন্থার মধ্যবর্তী। অতিরিক্ত সাহস সাহস নয়। একদিকে, সাহসের অভাব হচ্ছে ভীরুতা। অন্যদিকে মাত্রারিক্ত সাহস অদূরদর্শিতারই নামান্তর। এ দুয়ের মধ্যবিন্দুটিই হচ্ছে প্রকৃত সাহসী চরিত্রের পরিচায়ক। অ্যারিস্টটলের মতে, “সাহস হচ্ছে সঠিক কাজটি সঠিক উপায়ে সম্পন্ন করার ‘সাহস’!” মাত্রাতিরিক্ত সাহস দেখানো, কিংবা একেবারেই লেজ গুটিয়ে পালানো, দুটোই মন্দ। বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করতে পারাই সাহসিকতার পরিচায়ক।
এই দৃশ্যকল্পটির মতো আরো হাজারটা দৃশ্যকল্প কল্পনা করা যেতে পারে। অ্যারিস্টটলের মতে সকল ক্ষেত্রেই পূণ্য তত্ত্ব একইভাবে কাজ করে। যেমন- সততা একটি সদগুণ। সততার ক্ষেত্রে একটি সরলরেখা কল্পনা করুন একপ্রান্তে সততার অভাবে সঠিক কথাটি বলতে না পারা হচ্ছে অসততা। অন্য প্রান্তে অতিমাত্রায় সততা দেখাতে গিয়ে সততার বর্বর রূপ উন্মোচন করাও অসততা। অসততার উদাহরণ আমরা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত পেয়ে থাকি। তবে বর্বর সততার উদাহরণ খুব কম। যেমন ধরুন, একজন খুনী এসে আপনার বন্ধুর ঠিকানা জানতে চাইলে আপনি তাকে ‘সততা’র সাথে ঠিকানা দিয়ে দিলে সেটি হবে বর্বর সততা, যা কখনোই কাম্য নয়। তার মানে সততা হচ্ছে কখন কী বলতে হবে এবং কোথায় কোন পরিস্থিতিতে চুপ থাকতে হবে তা বুঝতে পারা।
একই তত্ত্ব বদান্যতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেও একই ফলাফল পাওয়া যাবে। দানশীলতা মানে নিজের খাবারের টাকা পুরোটা দিয়ে কাউকে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেয়া নয়, উদারতা মানে একজন নেশাগ্রস্তকে মাদক দ্রব্য কিনে দেয়া নয়, কিংবা মহত্ব মানে একজন খুনীকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা নয়। বরং দানশীলতা হচ্ছে প্রকৃত অভাবীকে নিজের সাধ্যের মধ্যে সহায়তা করা। এক্ষেত্রে নিজের খাবারের টাকার একাংশ (নিজে কম খেতে হলেও) কোনো ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার কেনার জন্য দেয়াটাই হবে প্রকৃত দানশীলতা। একজন নেশাগ্রস্তকে মাদকদ্রব্য কিনে না দিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করে দেয়াই হবে প্রকৃত উদারতা। একজন খুনীকে মমতা ভরে পালিয়ে যেতে সহায়তা না করে বরং আইনের হাতে তুলে দেয়াই হবে প্রকৃত মহত্ব।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই অ্যারিস্টটলের ‘সঠিক সময়’ আর ‘সঠিক কাজে’র সংজ্ঞা পেয়ে গেছেন। পূণ্য কখনোই একটি পরম বিষয় নয়, বরং তা আপেক্ষিক। আর এখানেই পুনরায় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারতো অ্যারিস্টটলের পূণ্য তত্ত্ব। কারণ, পূণ্য যদি সর্বদাই আপেক্ষিক হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন রকম হয়, তাহলে মানুষ পূণ্যাত্মা হয়ে উঠবে কী করে? তবে অ্যারিস্টটল এর উত্তরও দিয়ে রেখেছেন। তার মতে, মানুষ বই পড়ে পাপ-পূণ্য সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানবে, কিন্তু পাপ-পূণ্যের প্রকৃত শিক্ষাটা পাবে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা থেকে। তার মতে পূণ্য একপ্রকার দক্ষতা, যা কর্মের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সঞ্চিত হয়। অর্থাৎ, পূণ্য হচ্ছে একটি ব্যবহারিক জ্ঞান। আর এরূপ ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন একজন পূণ্যবান ব্যক্তিকে অনুসরণ করাও হতে পারে পূণ্যাত্মা হবার আরেকটি উপায়। এক্ষেত্রে পূণ্যের শিক্ষা প্রথমে দেখে তারপর নিজে করে লাভ করা যাবে।
সবশেষে ইউডাইমোনিয়া আলোচনার পালা। পূণ্য তত্ত্বের উপর সব ধরনের প্রশ্ন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যদি কোনো ব্যক্তি বলেন যে তিনি পূণ্যাত্মা কেন হবেন কিংবা পূণ্যাত্মা হবার আদৌ প্রয়োজনীয়তা কী, তার উত্তর হবে ইউডাইমোনিয়া। গ্রিক শব্দ ইউডাইমোনিয়ার অর্থ বাংলায় একশব্দে প্রকাশ করা যায় না। তবে এককথায় বললে, ইউডাইমোনিয়া বলতে বাঁচার মতো বাঁচাকে বোঝায়। ইউডাইমোনিয়া হচ্ছে নিজেকে যাচাই করে বাঁচা, নিজের সীমাবদ্ধতাকে পরীক্ষায় ফেলে বাঁচা, প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বাঁচা। ইউডাইমোনিস্টিক জীবন হবে কানায় কানায় সুখ দ্বারা পরিপূর্ণ, তবে তা কারো দয়ায় বা অনুগ্রহে পাওয়া সুখ নয়। ইউডাইমোনিস্টিক সুখ হবে নিজের চেষ্টার দ্বারা পাওয়া সুখ ও সমৃদ্ধি।
নিজেকে উজাড় করে দিয়ে, নিজের সর্বোচ্চ সীমার পরিধিটাকে আরো প্রসারিত করে সাফল্য লাভে যে সুখ পাওয়া যায়, অনৈতিক উপায়ে কিংবা কারো অনুগ্রহে সহজেই সমান সাফল্য পেলে কী সে সুখ আসে? ইউডাইমোনিস্টিক জীবন মানে কখনোই সর্বোচ্চ সাফল্য না পাওয়া। কারণ, ইউডাইমোনিস্টিক ব্যক্তি কোনো সাফল্যেই পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হন না এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লক্ষ্য ঠিক করেন। ইউডাইমোনিয়া মানে জীবন পুষ্পশয্যা নয় এ বিশ্বাস এবং জীবনের কঠিন অধ্যায়গুলো স্বীয় চেষ্টায় অতিক্রম করার মধুর সুখানুভূতি। আর একজন ইউডাইমোনিস্টিক ব্যক্তিই অ্যারিস্টটলের জন্য প্রকৃত পূণ্যাত্মা। অ্যারিস্টটলের পূণ্য তত্ত্বের ইতি টানবো মহান দার্শনিক সক্রেটিসের একটি প্রাসঙ্গিক উক্তি দিয়ে।
“অপরীক্ষিত জীবন অর্থহীন!”
ফিচার ছবি: youtube.com