আমার পরিচিত একজন সেকশান হেড তার সেকশানের পিপল ম্যানেজমেন্টে বেশ কয়েকবার ঝামেলায় জড়িয়েছেন। আমাকে গতকাল ফোন দিয়ে তাই তিনি বললেন, “তুষার ভাই, আপনার একটা সাজেশান লাগবে, ফ্রী আছেন?”
আমি বললাম, “বলেন, আপনার জন্য সবসময় ফ্রী!“
তিনি বললেন, “আপনি তো এইচআরে অনেক দিন আছেন। আপনি নিজেও এইচআরের চারজন অফিসারকে ম্যানেজ করছেন, আবার অন্য দুই সেকশানের অফিসার আর সুপারভাইজার লেভেল আপনাকে রিপোর্ট করে। এই যে পিপলগুলোকে আপনি দারুণ ম্যানেজ করছেন, এটা কীভাবে করেন?”
এটা শুনে বললাম, “ভাই, আপনার একটা শব্দ আমি কারেকশান দিতে চাই। আপনি যাকে ম্যানেজ বলছেন, আমি তাকে বলি ‘Lead’। আপনি বলতে পারেন, আমি এতগুলো মানুষকে কীভাবে Lead করছি?“
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “ভালো বলেছেন। ‘ম্যানেজ’ করা আর ‘লিড’ করার মধ্যে একটা পার্থক্য তো আছেই। তাহলে আপনি তাদেরকে কীভাবে লীড করছেন?”
“আমি বলবো, অন্যকে লিড করার আগে ‘Lead Yourself First’“- আমি এ কথা বলতেই তিনি লাফিয়ে উঠে বললেন, “বলেন কি? এটা আবার কেমন? উল্টো হয়ে গেল না? আপনি কি তা মেইন্টেইন করেন?”
আমি বললাল, ব্যাপরটা তা-ই, আসলেই উল্টা । আমি কীভাবে এটা করার চেষ্টা করি সেটাই বলছি এখন।
প্রথমেই আসে Prioritize, অর্থাৎ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করা। আমার লং টার্ম এবং শর্ট টার্ম ভিশন থাকে, আর সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করি। তারপরই কাজগুলোকে গুরুত্ব বুঝে ভাগ করে ফেলি। যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি নয়, এমন কাজগুলো নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাই না। কিন্তু যে কাজটা এখনই লাগবে ও অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্যপারে আমি খুবই সিরিয়াস থাকি। এ ব্যাপারটা আমার টিমমেটরা জানে। ওরাও এখন আমার এই স্টাইলের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
দুই, Time Management, অর্থাৎ সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। অসময়ে লাফালাফি, আড্ডা আনলিমিটেড। সাবমিশন ও ডেডলাইন- এই দুই ব্যাপারে খুব সিরিয়াস আমি। টিমমেটদের প্রথমে অসুবিধা হচ্ছিল। এখন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।
তিন, Emotion Control, অর্থাৎ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা। এখন অনেককেই ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্ট বলতে শুনি। ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও সোজা না। আবেগের সাথে প্রকাশের একটা সম্পর্ক আছে। আপনি বিষয়টাকে যত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারবেন ততই ভাল।
চার নম্বর হচ্ছে Accountable, Responsible ও Answerable, অর্থাৎ কী বলছি, কী করছি, কী সিদ্ধান্ত দিচ্ছি সেই কাজের জন্য আমাকে জবাবদিহিতা করতে হবে, উত্তর দিতে হবে। এই বিষয়টি যদি আপনি নিজে মানেন এবং টিমমেটদেরকে চর্চা করান, তাহলে দেখবেন আউটপুট ভাল আসছে।
পাঁচ হচ্ছে Listen, অর্থাৎ শোনা। প্রচুর শুনতে হবে। যে কয়টা কথা বলবেন তার ডাবলের ডাবল শুনতে হবে। আমি বলছি, আপনার সাব অর্ডিনেটরা যত কথা বলতে চায় সব আপনাকে শুনতে হবে। তা না হলে তো তাদের দাবি আর প্রত্যাশা বুঝতে পারবেন না। আর শোনার একটা উপকার হচ্ছে, এতে ফলোয়ার তৈরি হয়। আপনার অধীনস্থরা আস্থা রাখবে আপনার উপর এই ভেবে যে, আপনি তাদের কথা শোনেন। যেমন- আমি যখন বলি আমার টিমমেটরা সেটা মন দিয়ে শোনে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে।
ছয়ে আছে Accept Criticism, অর্থাৎ সমালোচনা গ্রহণ করতে শেখা। সমালোচনাকে ভয় পেয়েছেন তো মরছেন। গ্রহণ করার সাহস থাকতে হবে। কীভাবে করবেন সেটা আপনার ক্যারিশমা, কতটুকু সমালোচনা নিতে পারছেন আর কতটুকু পারছেন না সেটাও আপনার ক্যালিবার। আপনি যদি গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে দেখবেন কর্মক্ষেত্রে কেউ আর আপনার নামে গুজব ছড়াতে পারছে না। কারণ নিজের ভুল সবসময় নিজে বোঝা যায় না।
সাত নাম্বার বলেই শেষ করবো। Well Manners, অর্থাৎ ভালো আচার-আচরণের অধিকারী হতে হবে। যত নম্রতা আর ভদ্রতার সাথে থাকা যায় ততই ভাল। এতে সম্মান পাওয়া যায়। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা থাকে। আসল কথা হলো, ব্যক্তি হিসেবে আপনার একটা ওজন তৈরি করা, যেটা মানুষ পরিচালনার জন্য খুবই জরুরি।
আরও অনেক বিষয়ই আছে। খেয়াল করে দেখবেন, আমি আমার টিমমেটদেরকে লিড করার আগে নিজেকে লিড করেছি। নিজের মাঝে পরিবর্তন এনেছি। টিমমেটরা সামগ্রিক কাজগুলোকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। ব্যাস, তারপর আমি কাজের কমান্ড করছি, ফলোআপ করছি, সাজেশান দিয়ে দিচ্ছি, কোথাও আটকে গেলে নিজে করে দিচ্ছি। বাকি কাজ তো ওরাই করছে। আর এভাবেই আমার অধীনস্থ মানুষগুলোকে পরিচালনা করছি।
এতটা সময় ধরে ভদ্রলোক একটা কথাও বলেননি। শুধু শেষে বললেন, “এই জন্যই তো আপনি বস!” কথাটা শেষ না হতেই তিনি আবার বললেন, “তুষার ভাই, আপনি শুধু বস না, আসলেই রিয়েল বস!”
কথাটা কেন যেন শুনতে ভালই লাগলো!