কখনো কি মনে হয়েছে, সমাজের কিছু মানুষ কেন যেকোনো কাজে স্বভাবতই বাকিদের চেয়ে বেশি সক্ষম? কেন সমান সুযোগ-সুবিধা লাভের পরও গুটিকতক মানুষ অন্যদের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়? কেন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে একটি বিশেষ পরিবার থেকেই একাধিক নেতার জন্ম হচ্ছে, যারা সমসাময়িক অন্য সকলের থেকে বহুগুণে এগিয়ে যাচ্ছে?
বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এসব প্রশ্নের উত্তর আজো এক অজানা রহস্য। কিন্তু কেউ কেউ আবার দাবি করে থাকেন, এই সকল প্রশ্নের উত্তরই দেয়া হয়েছে ‘দ্য গ্রেট ম্যান’ তত্ত্বে।
‘দ্য গ্রেট ম্যান’ তত্ত্ব কী?
“Great leaders are born, not made.” অর্থাৎ মহান নেতারা জন্মান, তৈরি হন না। মূলত এই বহুল প্রচলিত প্রবাদের মাঝেই নিহিত রয়েছে দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বের সারকথা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে মহান নেতা হিসেবে তৈরি করা যায় না। মহান নেতারা জন্মগতভাবেই নেতৃত্বের গুণাবলি সঙ্গে করে নিয়ে পৃথিবীতে আসেন।
প্রতিটি ব্যক্তিবিশেষই কিছু নির্দিষ্ট স্বভাব বা বৈশিষ্ট্য সাথে নিয়ে জন্মায়। কিন্তু যারা স্বভাবজাত নেতা, অর্থাৎ জন্মগতভাবেই নেতৃত্বের গুণাবলি লাভ করেছেন, তাদের ভেতরকার বৈশিষ্ট্যগুলো কিছুটা ভিন্ন, অথবা তাদের মাঝে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকে যা শুধু তাদের মাঝেই বিদ্যমান। আর এসব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের বলে বলীয়ান হয়েই তারা যুগে যুগে পৃথিবীর ইতিহাসকে নতুন করে রচনা করেন।
মূল কৃতিত্ব টমাস কার্লাইলের
দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বটি উদ্ভাবনের মূল কৃতিত্ব দেয়া হয়ে থাকে স্কটিশ দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, ঐতিহাসিক ও ব্যাঙ্গাত্মক লেখক টমাস কার্লাইলকে। তিনি ১৮৪০ সালে বীর ও বীরত্ব বিষয়ে বেশ কিছু লেকচার প্রদান করেন, এবং পরবর্তীতে বেশ কিছু বইও প্রকাশ করেন। সেসব বইয়ের মধ্যে ১৮৪১ সালে প্রকাশিত On Heroes, Hero-Worship, and The Heroic in History বইটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই বইয়ে তিনি ইতিহাসের মহামানব কিংবা বীরপুঙ্গবদের বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। তার মতে, একজন নেতা হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি সেইসব স্বতন্ত্র গুণাবলির আশীর্বাদধন্য, যা গণমানুষের কল্পনাকে ধারণ করতে পারে।
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, মহান নেতা বা বীরদের সংজ্ঞায়িত করতে ‘গ্রেট ম্যান’ শব্দযুগলই কেন ব্যবহৃত হলো। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শুধু পুরুষদের কথাই কেন বলা হলো। এর পেছনে কারণ হলো, উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যায়ে যখন এই তত্ত্বটি বিকাশ লাভ করতে থাকে, তখনো নেতৃত্বকে প্রাথমিকভাবে একটি পুরুষালি বৈশিষ্ট্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। বিশেষত নেতাদের দেখা পাওয়া যেত বিভিন্ন সামরিক বাহিনীতে, এবং সেইসব নেতারা সাধারণত পুরুষই হয়ে থাকতেন।
এ তত্ত্বের ভিত্তি কী?
কী থেকে কার্লাইল ও তার পরবর্তী সময়ের অনেক বিশেষজ্ঞের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হলো যে মহান নেতারা জন্মান, তৈরি হন না? এ ধারণাকে পাকাপোক্ত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে আব্রাহাম লিঙ্কন, জুলিয়ান সিজার, মহাত্মা গান্ধী, আলেক্সান্ডার দি গ্রেট, নেপোলিয়ন, রানী এলিজাবেথের মতো মহান নেতাদের উদাহরণ।
অধিকাংশ উদাহরণেই দেখা যায় যে, কোনো কাজের জন্য সঠিক ব্যক্তিটির আগমন প্রায় যেন আকস্মিকভাবেই ঘটে যায়। তারা কোনো এক জাদুমন্ত্রবলেই যেন যেকোনো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেন, এবং নিজ গোষ্ঠীকে নিরাপত্তা বা সাফল্যের পথে নেতৃত্ব দেন।
কার্লাইলের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মানবসভ্যতার ইতিহাস মূলত মহামানব বা মহান নেতাদেরই ইতিহাস। তাই এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, “এই পৃথিবীর ইতিহাস মূলত মহামানবদের জীবনী বৈ আর কিছুই নয়।” কার্লাইল মনে করতেন, কার্যকরী নেতা হলেন তারাই, যারা ঈশ্বর কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা ও সঠিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা।
নেতৃত্ব বিষয়ক গবেষণার শুরুর দিকে সেইসব মহান নেতাদের উপর বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছিল, যারা ইতিমধ্যেই নেতা হিসেবে সফল ছিলেন। এবং এইসব ব্যক্তিবিশেষদের মাঝে অনেক সময়ই থাকতেন অনেক রাজবংশীয় নেতা, যারা তাদের ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন জন্মসূত্রে। অর্থাৎ অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণই নির্ধারণ করে দিয়েছিল নেতা হিসেবে তাদের নিয়তি। অপরদিকে তখনকার দিনে নিম্ন সামাজিক মর্যাদার মানুষের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের এবং পরবর্তীতে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ কম ছিল। এই বিষয়গুলোও দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বটিকে আরো পাকাপোক্ত করেছিল যে নেতৃত্ব আসলেই একটি জন্মগত ও অন্তর্নিহিত শক্তি।
এমনকি আজকের দিনেও সফল ও কার্যকরী নেতাদেরকে অভিহিত করা হয় born leader বা জাত নেতা হিসেবে, এবং দাবি করা হয় যে অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যসমূহই এই মানুষগুলোকে সফল নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছে।
এ তত্ত্ব থেকে প্রাপ্ত ধারণাসমূহ
সার্বিকভাবে দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বের মাধ্যমে দুইটি ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়।
- মহান নেতারা জন্মগতভাবেই সেইসব নির্দিষ্ট স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের মালিক, যেগুলো তাদেরকে সাহায্য করে ব্যক্তি হিসেবে উত্থান ও নেতৃত্ব প্রদানে।
- মহান নেতাদের উত্থান ঠিক সেই সময়েই ঘটে, যখন নিজ সমাজ বা রাষ্ট্রে তাদের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়।
এই তত্ত্বের সমর্থকরা বলেন যে প্রকৃত নেতারা সেইসব প্রয়োজনীয় লক্ষণ সঙ্গে করে নিয়ে জন্মান, যেগুলো তাদেরকে আশেপাশের অন্য সকলের চেয়ে আলাদা করে ফেলে, এবং একই সাথে তাদেরকে প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতাশালী ভূমিকা অর্জনের পথে প্রণোদনা যোগায়। এই তত্ত্ব আরো বলে যে মহান নেতারাই হলেন সেই বীর, যারা তাদের সমর্থক বা অনুসারীদের পক্ষে সকল বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে যেকোনো বড় সাফল্য বয়ে আনতে সক্ষম।
এবং এই তত্ত্ব কার্যত এটিই বলতে চায় যে যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদেরই উচিৎ সমাজ বা রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব প্রদান করা, কেননা নিজেদের মাঝে সেইসব প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যাবলী থাকার কারণেই তো তারা ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।
দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বের সর্বশেষ অনুমান হলো, মহান নেতাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ দেশ-কাল-সমাজ নির্বিশেষে সর্বদা স্থিতিশীল থাকে, ফলে সব যুগের সকল মহান নেতারাই একই ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন, এবং তাই মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবসময় মহান নেতাদের সংজ্ঞা অপরিবর্তিতই থাকে।
প্রাচীন যুগে এ তত্ত্বের উপস্থিতি
দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বের বিকাশ উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যায়ে হলে কী হবে, এই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের সময়কাল থেকেই।
গ্রেট ম্যান তত্ত্বে বিশাস করা হয়, মহান নেতারা হলেন ঈশ্বর কর্তৃক মানবজাতির প্রতি পুরস্কার। কোনো মানুষের পক্ষেই মহান নেতা হওয়া সম্ভব হতো না, যদি না তাদের মাঝে নেতৃত্বের ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা থাকত। অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিক ও রোমানরা বিশ্বাস করত, নেতাদের মাঝে ঈশ্বরপ্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা ফুটে ওঠে তাদের ব্যতিক্রমী ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। যেমন কোনো ব্যক্তির দৃশ্যমান বিশেষ শারীরিক, কিংবা অন্তঃস্থিত মানসিক বা ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে এখানে ঐশ্বরিক বলে চিহ্নিত করা হতো, এবং যেসব মানুষ সমাজের আর দশজনের চেয়ে আলাদা, তাদেরকেই নেতৃত্বের গুণসম্পন্ন হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
এ তত্ত্বের সমালোচনা
দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বটি মোটেই সর্বজনগ্রাহ্য, কিংবা সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। যেমন ইংরেজ দার্শনিক, জীববিজ্ঞানী, নৃতাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী এবং ধ্রুপদী উদারতাবাদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান চিন্তাবিদ, হার্বার্ট স্পেন্সার এই তত্ত্বটিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তার মতে এই তত্ত্বটি খুবই ছেলেমানুষি, সেকেলে, এবং কোনোভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়।
স্পেন্সার বিশ্বাস করতেন, নেতারা হলেন তাদের নিজ নিজ পরিবেশের সন্তান, এবং তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে নিজস্ব সমাজ ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মাধ্যমেই। The Study of Sociology-এ তিনি লিখেছিলেন, “কোনো মহান ব্যক্তিত্বের গঠন নির্ভর করে কোনো জটিল প্রভাবের লম্বা ধারাবাহিকতার উপর।”
এই তত্ত্বটির সাথে সাংঘর্ষিক আরেকটি বিষয় হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক মহান নেতার দেখাও কিন্তু মিলেছে, যাদের মাঝে জাত নেতার তথাকথিত বৈশিষ্ট্যসমূহ উপস্থিত ছিল না। আবার জাত নেতার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অনেক মানুষের পক্ষেও সমাজে ক্ষমতার চূড়ায় আরোহণ করা সম্ভব হয়নি। নেতৃত্ব যদি কেবল সহজাত ও অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের উপরই নির্ভরশীল হতো, তাহলে ওইসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সকলেই নেতৃত্বের অবস্থানে পৌঁছে যেত, এবং ওইসব বৈশিষ্ট্যহীন ব্যক্তিরা কোনোদিনই নেতা হতে পারত না।
শেষ কথা
বস্তুত, নেতৃত্ব এমনই জটিল একটি বিষয় যে, আজ পর্যন্ত কোনো গবেষণার মাধ্যমেই শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যায়নি যে নেতা হওয়ার পথে সফলতা লাভে ঠিক কোন কোন জিনিস প্রভাব বিস্তার করে। তাছাড়া দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক বা প্রমাণসাধ্য ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়নি, যা থেকে বোঝা সম্ভব যে মহান নেতাদের উত্থান কখন ও কীভাবে ঘটছে, এবং কোন কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা সফলতা লাভ করছেন।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে দ্য গ্রেট ম্যান তত্ত্বটির এমন কোনো প্রতিপাদ্য ভিত নেই, যার বদৌলতে এটিকে অভ্রান্ত হিসেবে দাবি করা যাবে। এটি এমন একটি তত্ত্ব যার পক্ষে যেমন কথা বলা সম্ভব, তেমনই বিপক্ষেও কথা বলা সম্ভব। তাই নেতা ও নেতৃত্বের বিকাশ সম্পর্কিত আলোচনায় এটি শতভাগ গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কিন্তু তারপরও, প্রায় ১৮০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এই তত্ত্বের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। আজো এই তত্ত্ব নিয়ে শিক্ষিত মানুষেরা চর্চা করে, এবং এই তত্ত্বই তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে নেতৃত্ব বিষয়ে চিন্তাভাবনা অব্যহত রাখতে। তাই দ্য গ্রেট ম্যান এমনই একটি তত্ত্ব, যাকে সাদরে গ্রহণ করা না গেলেও, একেবারে ছুঁড়ে ফেলাও অসম্ভব।
টমাস কার্লাইল রচিত বই পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে
১) On Heroes, Hero-Worship, and the Heroic in History
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/