যুক্তি দিয়ে মুক্তি মেলে কি মেলে না, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে বিতর্ক শিখে উপকার বৈ অপকার হয়েছে এমনটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিতর্ক কেন শিখব, কেনই বা করব, সে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এখানের আয়োজন।
স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনেকে বিতর্কের সাথে সম্পৃক্ত হয়। যারা বিতর্ক ভালোবাসে, তাদের মনে হয়তো ‘বিতর্ক কেন করব’ সে প্রশ্নের উদ্রেক হয় না। কিন্তু যারা এখনো বিতর্ক শুরু করেননি অথচ বিতর্কে আগ্রহী, তাদের অবশ্যই জানা দরকার বিতর্ক একজন মানুষকে কী দিতে পারে।
বিতর্ক কি শুধুই কিছু সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ, নাকি তা একজন মানুষকে আরো বেশি কিছু দিতে সক্ষম? বছরকে বছর বিতর্ক করে বেশকিছু ট্রফি অর্জন বাদে একজন মানুষ আর কী শিখতে পারে? খোঁজা যাক প্রশ্নগুলোর উত্তর।
যুক্তিবাদী চিন্তাধারা
বিতর্ক ব্যাপারটা পুরোপুরিই যুক্তির খেলা। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন ও উদাহরণ দিয়ে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে বিতর্কের মূল লক্ষ্য। বিতর্ক করে একজন মানুষ নিজেকে সর্বপ্রথম যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।
কোনো বিষয় নিয়ে কতভাবে কত আঙ্গিকে চিন্তা করা যায়, তা শেখায় বিতর্ক। আর সে চিন্তাগুলো পরিপূর্ণতা পায় তখনই, যখন তাতে থাকে যথাযথ যুক্তির মিশেল। সুতরাং, আর দশজন মানুষের চিন্তাধারা থেকে নিজের চিন্তাধারাকে একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রা দিতে বিতর্কের চেয়ে ভালো বিকল্প আর হয় না।
বাগ্মীতা চর্চা
ক্লাসের প্রেজেন্টেশন বা কোনো অনুষ্ঠানের উপস্থাপনার দায়িত্ব কাঁধে পড়েছে কখনো? পঞ্চাশ-একশ’জনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়েছে? এ পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যান না, এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম।
পাবলিক স্পিকিং নিয়ে আমাদের অনেকের মাঝেই আড়ষ্টতা কাজ করে। এ আড়ষ্টতা কাটানোর জন্যে বিতর্ক চর্চা বেশ সাহায্য করতে পারে। নিয়মিত কথা বলার চর্চা করলে ধীরে ধীরে জড়তা কেটে যায়, একটা সময় জনাপঞ্চাশ মানুষের সামনেও সাবলীলভাবে কথা বলা যায়। কথা বলতে পারাটাও একটি বড় গুণ। আর এ গুণ আয়ত্ত্বে বিতর্ক বড় সহায়ক ভূমিকা পালনে করতে পারে।
সময়জ্ঞান
বিতর্ক আয়োজনে ব্যক্তিবিশেষের বক্তব্যের সময়গত দৈর্ঘ্য সাধারণত কতক্ষণ হয়? বিতর্কের বিষয় বা ধরনভেদে হয়তো চার থেকে সাত মিনিট। এদিকে একজন ব্যক্তি যখন নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট সময়ে বক্তব্য দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, তখন তার মধ্যে যে সময়জ্ঞানের জন্ম নেবে, তা তাকে সাহায্য করবে যেকোনো জায়গায়।
অনেকেই কথা বলতে গেলে গুছিয়ে শেষ করে উঠতে পারে না। ভূমিকায় কতক্ষণ কথা বলতে হবে বা কতক্ষণ সময় নিয়ে কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করতে হবে, প্রায়ই এসব তালগোল পাকিয়ে ফেলে। দেখা যায়, ক্লাসরুমে দশ মিনিটের একটি প্রেজেন্টেশনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতেই পাঁচ মিনিট লেগে যায়, আবার কখনো বা সাত মিনিটেই প্রেজেন্টেশন দেওয়া শেষ। সময় ব্যবস্থাপনার এ ব্যাপারগুলো বেশ দৃষ্টিকটু।
একজন বিতার্কিক যখন ছকে বাঁধা সময় ধরে সবসময় কথা বলে অভ্যস্ত হন, তখন তিনি বিতর্কের বাইরেও কথা বলার সময় সেভাবেই খুব কম বা বেশি সময় নিয়ে কথা বলেন না। যেটুকু কথা কাউকে বোঝাতে যতটুকু সময় প্রয়োজন, ততটুকুই নিয়ে থাকেন। এই সময়জ্ঞানটি তৈরি করে দেওয়ার জন্যে নিয়মিত বিতর্ক চর্চা নিঃসন্দেহে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
প্রমিত ভাষাচর্চা
আমাদের অনেকের মাঝে ভাষাগত বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। অনেকে কথা বলতে গেলে হয়তো কথা মুখে জড়িয়ে যায়, কেউ হয়তো আঞ্চলিকতার টান ছাড়া কথা বলতে পারেন না। অনেকে রয়েছেন যারা ইংরেজিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এক্ষেত্রে বিতর্ক চর্চা ভালো একটি সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় নিজেকে ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্যে। নিয়মিত প্রমিত ভাষায় বিতর্ক চর্চা করলে ভাষায় আঞ্চলিকতার সমস্যাটি হ্রাস পায়। পাশাপাশি যারা ইংরেজি বিতর্ক করে থাকেন, তাদের ভাষাগত পারদর্শিতাও বৃদ্ধি পায়।
চিন্তার প্রসার
বিতর্ক একজন মানুষকে বহুবিধ উপায়ে চিন্তা করতে শেখায়। একই বিষয় কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবা যায়, তা একজন বিতার্কিক খুব ভালো করে জানেন। বিতার্কিকদেরকে প্রায়সময় এক লাইনের একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে দশ পনেরো মিনিট কথা বলতে হয়। সুতরাং, কত আঙ্গিকে বা কতভাবে একটি বিষয়ের দুই দিক বিশ্লেষণ করা যায়, তা চর্চার জন্যে বিতর্কের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একজন বিতার্কিক যখন নিয়মিত বিতর্ক চর্চার বাইরে তার ব্যক্তিগত জীবন বা কর্মজীবনে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যান, তখন আর এই প্রসারিত চিন্তার ক্ষেত্রটি আশু সিদ্ধান্তের বিভিন্ন জটিলতা, প্রতিবন্ধকতা, সমাধান ইত্যাদি সম্পর্কে চিন্তা করতে সাহায্য করে।
ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মর্যাদা
বর্তমান যুগে বিতর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক এটি। বর্তমান সময়ে মানুষ একে অন্যের মতামতকে সম্মান করতে ভুলে যাচ্ছে, ভুল হলেও যেকোনো উপায়ে নিজের মতামতকে চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেরকম একটি সময়ে এখনো বিতার্কিকরা প্রতিপক্ষের যুক্তি শুনছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানছে।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ভিন্ন ভিন্ন সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে আসা বাইরের দেশের প্রতিযোগীরা একই বিষয় নিয়ে বিভিন্নভাবে যুক্তি দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিতার্কিকরা শিখছে সব ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামতের প্রতি কীভাবে সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হয়।
সোশ্যাল নেটওয়ার্ক
আপনি যখন একটি সংগঠন বা ক্লাবের বিতার্কিক হবেন, তখন আপনি সমমনা বা ভিন্নমনা আরো অনেক বিতার্কিকের সাথে পরিচিত হবেন। পাশাপাশি, বাইরের বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে বিতর্ক সমাজের অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের যোগাযোগের মাধ্যমে বিতার্কিকদের মাঝে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা ভবিষ্যত কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রেও নানাভাবে উপকার করে থাকে।
জ্ঞানের প্রসার
বিতর্ক সাধারণত সাহিত্য, রাজনীতি, আইন, নৈতিকতা, অর্থনীতি, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। সুতরাং একজন বিতার্কিককে এ সকল ব্যাপারে সবসময় জানাশোনা রাখতে হয়। বিতর্ক করতে হলে প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা আর সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে নিয়মিত আপডেটেড থাকা। সুতরাং, জ্ঞানের বিকাশগত জায়গা থেকে বিতর্কের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ব্যক্তিগত অর্জন
বলা হয়ে থাকে, একজন সফল বিতার্কিকের বাসার ড্রয়িং রুমে শুধু তার ট্রফিগুলি রাখার জন্যই আলাদা একটি শো-কেস তৈরি করতে হয়। কারণ একজন বিতার্কিক শুধু বিতর্কেই ট্রফি জেতে না, বরং বিতর্কের পাশাপাশি সে বিভিন্ন বক্তব্য প্রতিযোগিতা, আইডিয়া কম্পিটিশনসহ আরো অনেক জায়গাতেই অংশ নিয়ে সাফল্য পেতে পারে!
সুদূরপ্রসারী ও যৌক্তিক, পর্যাপ্ত সময়জ্ঞান আর নিজেকে উপস্থাপনের চমৎকার কৌশল যার আয়ত্তে থাকে, তাকে হারিয়ে দেওয়া যেকোনো প্রতিযোগীর জন্যে বেশ কঠিন। তবে, হেরে গেলে মন খারাপ করবেন না। খোঁজ নিয়ে দেখুন, যার কাছে হেরেছেন, তিনিও হয়তো একজন বিতার্কিক, হয়তো আপনার চেয়ে খানিকটা বেশিই খেটেছিলেন তিনি।
সৃষ্টির সূচনা থেকেই বিতর্ক চর্চা চলে আসছে, কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বা কখনো অনানুষ্ঠানিকভাবে। একুশ শতকের জীবন দক্ষতাগুলো বৃদ্ধির জন্যে বর্তমানে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক আর শখের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই, বরং বর্তমানে এটি একটি প্রয়োজন হিসেবেই দেখা দিচ্ছে। নিজের ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন ও জ্ঞানের বিকাশের জন্যেই বিতর্ক চর্চার বিকল্প নেই।