ভাবতে অবাকই লাগে, বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় নিজেকে সমৃদ্ধ করলেও পুরোপুরি অন্ধকারমুক্ত হতে পারেনি মানুষ। অনেক প্রাচীন রীতিনীতি, ঐতিহ্য এখনো সে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। এমনই কিছু ঐতিহ্য ও প্রথা নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
চিঠি নিয়ে উড়ে যায় পুলিশের পায়রা
প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতার যুগে প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে বিস্মৃত হননি ভারতের উড়িষ্যা অঞ্চলের পুলিশ কর্মীরা। ইন্টারনেটের এই যুগেও তারা এখনও হাতে লেখা চিঠি পাঠানোর প্রচলন রেখে দিয়েছেন। তবে এই চিঠি কোনো ডাকযোগে প্রেরিত হয় না। তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ চিঠি নিয়ে যাচ্ছে তাদের পোষ মানানো পায়রারা।
প্রাচীনকালে এই পায়রার মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানের চিঠি আদান প্রদান করা হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এই রেওয়াজ হারিয়ে যেতে থাকে। একসময় পোস্ট বক্সের মাধ্যমে, পরবতীর্তে টেলিগ্রাম, ফ্যাক্স এবং সর্বশেষে ইমেইল আসার পর হাতে লেখা চিঠি পাঠানোর রেওয়াজই হারিয়ে যায় আমাদের মধ্য থেকে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম উড়িষ্যার পুলিশ কর্মীরা। শতাব্দী পেরিয়ে ভুলতে বসা রেওয়াজকে তারা ধরে রেখেছেন বছরের পর বছর। প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখার তাগিদ থেকেই পুলিশকর্মীরা এই উদ্যোগ নিয়েছেন বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
উড়িষ্যার পুলিশ ৫০টি পায়রা নিয়ে একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিল। প্রত্যেক পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে কটক থেকে ভুবনেশ্বর পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই ২৫ কি.মি পথ অতিক্রম করে সেসব পায়রারা পৌঁছে যায় ভুবনেশ্বরে। পুরো কার্যক্রমটি আয়োজনের মূল দায়িত্ব পালন করে উড়িষ্যা পুলিশ পিজিয়ন সার্ভিস। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই পরিষেবা।
১৯৭০ সালে ২০০টি পায়রা নিয়ে শুরু হয়েছিল উড়িষ্যার এই পুলিশ পিজিয়ন সার্ভিস। ১৯৯৯ সালে সুপার সাইক্লোনে উড়িষ্যায় সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকী সেই সময় রেডিও ব্যবস্থাও পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এ সময় সকলকে তাক লাগিয়েছিল এই পায়রা পরিষেবা। সেই সময়ের দুর্যোগ মুহূর্তগুলোতে পায়রার মাধ্যমেই চলতো জরুরি বার্তা আদান-প্রদানের ব্যবস্থা। উড়িষ্যার পুলিশকর্মীরা পায়রা দিয়ে চিঠি আদান প্রদানের এই ধারা আজও বজায় রাখতে চান।
নববধুকে কাধে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লার ওপর হাঁটা
চীনের বেশ কিছু প্রদেশে এই আজব প্রথাটি চালু রয়েছে। নববধুকে নিয়ে নিজ গৃহে প্রবেশের সময় স্বামীকে একটি প্রথা অনুসরণ করতে হয়। এই প্রথানুসারে, স্বামী তার নববধুকে কাঁধে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লার উপর হেঁটে যান। এই প্রথার পিছনে স্থানীয়দের মধ্যে এক প্রাচীন বিশ্বাস কাজ করে থাকে।
একজন গর্ভবতী মহিলাকে তার প্রসবকালীন সময়ে যে পরিমাণ প্রসব যাতনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা স্বামীকে অনুধাবন করানোর জন্য এই অদ্ভুত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। স্বামীর সফলভাবে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আরো দৃঢ় এবং দীর্ঘ হয় বলে এখানকার স্থানীয়দের বিশ্বাস।
রং দেখে নাগরিকত্ব
টনি হেজ, বার্ধক্যে পদার্পন করা একজন ব্যক্তি। পিতৃপুরুষের দেশ ছিল লেবানন। সেখান থেকে চলে এসেছিলেন লাইবেরিয়ায়।এখানেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশোরের চমৎকার মুহূর্তগুলো। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নিয়েছেন উচ্চশিক্ষা। এখানেই তার প্রথম প্রেম এবং পরবর্তীতে তাকেই স্ত্রী হিসেবে পাওয়া।
ছোট একটা ব্যবসা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। এখন তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। এখানেই জীবনের পঞ্চাশটি বসন্ত কাটিয়ে দিয়েছেন। আরো এভাবেই জীবনের শেষ দিনগুলো এই মাটিতেই কাটাতে চান। এ দেশটিকে বড়ই আপন করে নিয়েছেন তিনি।
লাইবেরিয়া যখন যুদ্ধে আক্রান্ত হয়েছিল, যুদ্ধের সংহিংসতায় লাইবেরিয়ার মানুষজন যখন দিশেহারা, একটুখানি আশ্রয়ের জন্য, নিজের জীবনকে বাঁচানোর জন্য সেদেশেরই অনেক নাগরিক যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, আশ্রয় নিচ্ছিল পাশ্ববর্তী দেশগুলোয়, টনি একবারও ভাবেননি এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। যুদ্ধের দামামার মধ্যেও থেকে গিয়েছিলেন লাইবেরিয়াতেই।
অথচ এতকিছুর পরও অর্জন করতে পারেননি দেশটির নাগরিকত্ব। রয়ে গেছেন দেশটির দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই। তার এই নাগরিকত্ব না পাওয়ার পেছনের প্রধান কারণ তার গায়ের রঙ। গায়ের রং কালো হলেই তবেই দেশটির নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। টনি হেজের গায়ের রঙ কালো নয় বলে তিনি এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশটির সংবিধানেও রঙ বিবেচনা করে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টিকে মান্যতা দেয়া হয়েছে।
অবশ্য এর পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক কারণও। উনবিংশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ক্রীতদাসদের স্বাধীন ভূমি হিসেবে পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ হিসেবে লাইবেরিয়ার জন্ম হয়। আর সেই ঐতিহাসিক কারণে দেশটিতে যখন প্রথম সংবিধান রচিত হয়, তখন সেই সংবিধানে নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যাপারে গায়ের রঙ কালো হওয়ার বিষয়টিকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়।
পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত হওয়া দেশটির প্রধানমন্ত্রীরা চেয়েছিলেন সংবিধান থেকে ধারাটি বিলুপ্ত করার জন্য। কিন্তু বিভিন্ন সংগঠন ও জনগণের প্রবল চাপে সেই ধারা বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি।
মৃতদের বিয়ে
চীনের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের শাংক্সি প্রদেশে মৃত মানুষদের বিয়ে দেয়ার এক অদ্ভুত রীতির প্রচলন রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, এই প্রথাটি প্রায় ৩,০০০ বছরের পুরনো। এই প্রথানুসারে, যেসব পিতা-মাতার পুত্রসন্তান বা কন্যাসন্তান অবিবাহিত অবস্থায় মারা গিয়েছে, সেই মৃত সন্তানের কঙ্কালের সাথে আরেকটি পরিবারের অবিবাহিত অবস্থায় মারা যাওয়া কন্যা বা পুত্র সন্তানের কঙ্কালের বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই অঞ্চলের স্থানীয়রা বিশ্বাস করে যে, কোনো পরিবারে অবিবাহিত অবস্থায় কোনো সন্তান মারা গেলে সেই মৃত্যুর কারণে পুরো পরিবারে অভিশাপের কালো ছায়া নেমে আসে।
তবে, শুধুমাত্র দুই পরিবারের মৃত দুই সন্তানের কঙ্কালের সাথে বিয়ে দিয়েই শেষ হয় না এই অনুষ্ঠান। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে মৃত মেয়েটির পরিবারকে যৌতুক দিতে হয়। যৌতুকের অংশ হিসেবে থাকে অর্থ, সোনাদানা, গৃহস্থালীর নানা সামগ্রী। বেশ কয়েক বছর আগে এরকমই একটি বিয়েতে মৃত পুত্রের বাবা-মা মৃত কন্যাটির পরিবারের কাছ থেকে ২৭ হাজার মার্কিন ডলার যৌতুক হিসেবে নেয়। কিন্তু দুই পরিবারের কেউ এই কারণে অসন্তুষ্ট নয়। নিজেদের অভিশাপমুক্ত রাখতে এই টাকা মেয়েটির পরিবারের কাছে কিছুই না।
তবে বর্তমানে এই প্রথার আড়ালে কিছু অসাধু লোক নানা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। ২০১৫ সালে এই প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু মানুষের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে কঙ্কাল চুরির ঘটনাও ঘটেছে।
মাছ ধরে সঙ্গী নির্বাচন
ব্রাজিলের মাহিনাকু একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামটির অধিকাংশ লোকই মাছ ধরে জীবনধারণ করে থাকে। তাদের জীবিকার প্রধান উৎসও এই মাছ ধরা। এই গ্রামে বিয়ে নিয়ে চালু রয়েছে আজব এক রীতি।
গ্রামের অবিবাহিত ছেলেদের মধ্যে থেকে কোনো পরিবারের অবিবাহিত মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য আয়োজন করা হয়ে থাকে নদীতে মাছ ধরার এক প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় অবিবাহিত পুরুষদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় মাছটি ধরতে পারবে, তার সাথেই ওই অবিবাহিত কন্যার বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
ফিচার ইমেজ- pinterest.com