শেষ হতে চলেছে ২০১৮ সাল। একে বলা যায় বলিউডের ইতিহাসের যুগান্তকারী বছর। গত ২৫ বছর ধরে যে জিনিসটি আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি, এ বছর সেটিই বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। একইসাথে বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছেন তিন খান- সালমান, আমির ও শাহরুখের ছবি। সমালোচকরাও রীতিমতো ধুয়ে দিয়েছেন তাদের ছবিকে। অপরদিকে ত্রিশের ঘরে থাকা তরুণ অভিনেতাদের জয়জয়কার হয়েছে এ বছর। তবে তারা তাদের তারুণ্য দিয়ে নয়, বরং অভিনয় ও শক্তিশালী গল্পের মাধ্যমে সক্ষম হয়েছেন দর্শক-সমালোচক উভয়ের মন জয় করে নিতে। তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতেই পারি, বলিউডে সময় এখন খানদের নয়। সেখানে উড়ছে অভিনেতা ও গল্পের কেতন।
ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল গত বছরই
খানদের সময় যে শেষ হতে চলেছে, সে ইঙ্গিত আমরা গত বছরই পেয়েছিলাম, যখন পরপর চরম ব্যর্থতার শিকার হয়েছিল সালমানের টিউবলাইট এবং শাহরুখের জাব হ্যারি মেট সেজাল। অনেকে তখনই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিল যে, খানরা বুঝি আর ফিরে আসতে পারবেন না। কিন্তু সেই ধারণা সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েনি মূলত দুটি কারণে।
প্রথমত, সালমান-শাহরুখের ছবি ব্যর্থ হলেও, আমিরের কোনো সোলো ছবি পর্দায় আসেনি গত বছর। শুধু নিজের প্রযোজিত সিক্রেট সুপারস্টারে তাকে ক্যামিও রোলে দেখা গিয়েছিল, এবং সেই ছবিটি দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল, বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখও দেখেছিল। যেহেতু ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে বাকি দুই খানের চেয়ে আমিরকেই বেশি সচেতন বলে মনে হয়, তাই অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বাকি দুই খান ভুল পথে পা বাড়ালেও, আমির নিজের ট্র্যাকেই থাকবেন।
আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, ২০১৮ সালে নিজের প্রথম ছবি টিউবলাইটের মাধ্যমে সালমান খান কচুকাটা হলেও, বছরের শেষভাগে এসে তার দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল টাইগার জিন্দা হ্যায়ের মাধ্যমে। তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ব্লকবাস্টারে পরিণত হয়েছিল সেটি।
তাই মাত্র মাস কয়েক আগেও যারা খানদের শেষ দেখে ফেলেছিলেন, তারাও ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পূর্বে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তাদের ধারণা সর্বৈব সত্য নয়। এখনও হারিয়ে যাননি খানেরা, বরং ২০১৮ সালটাকে পুরোপুরি নিজেদের করে নেয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে তাদের। কেননা ২০১৮ সালেই মুক্তি পাবে তাদের বিগ বাজেটের তিনটি ছবি- সালমানের রেস ৩, আমিরের থাগস অব হিন্দুস্তান, এবং শাহরুখের জিরো।
যত গর্জে তত বর্ষে না
২০১৮ সালটা খানদের জন্য হওয়ার কথা ছিল অপার সম্ভাবনাময় একটি বছর। এবং প্রকৃতপক্ষেই, পুরো বছরজুড়েই আলোচনায় ছিলেন তারা, নিজ নিজ ছবির কারণে। কিন্তু একেকজনের ছবি মুক্তি পেয়েছে, আর বোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণ ভক্ত, সকলেই মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করেছে তাদের থেকে।
শুরুটা হয়েছিল সালমানের রেস ৩ ছবির হাত ধরে। অনসম্বল কাস্ট ছিল ছবিটির। অনিল কাপুর, ববি দেওল, জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজ সহ অনেকেই। তবে প্রধানতম আকর্ষণ অবশ্যই সালমান। এই ফ্র্যাঞ্চাইজির আগের দুই ছবিতে সাইফ আলি খান থাকলেও, এবার তাকে সরিয়ে সালমান বনে গিয়েছিলেন রেসের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি খুব একটা। ছবি মুক্তির পর নিরপেক্ষ দর্শকেরা তো বটেই, এমনকি সালমানের লয়্যাল ফ্যানবেজও বলতে বাধ্য হয়েছে, কোনো দরকার ছিল না রেস ফ্র্যাঞ্চাইজিটাকে এভাবে নষ্ট করার! ভারতীয় বক্স অফিস থেকে ছবিটি ১৬৬.৪০ কোটি রুপি আয় করতে পেরেছে বটে, তবু সেটি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
এরপর আমির খানের ছবি থাগস অব হিন্দুস্তান। এ ছবিতে আবার তার সাথেই পর্দা ভাগাভাগি করেছেন অমিতাভ বচ্চনও। তাই বলাই বাহুল্য, মুক্তির আগে কী ভীষণ উন্মাদনা ছিল ছবিটিকে কেন্দ্র করে! কিন্তু মুক্তির পর সব শেষ। অনেকেই একে অভিহিত করেছে আমিরের সাম্প্রতিক অতীতের দুর্বলতম ছবি হিসেবে। কেউ কেউ তো অবাক হয়ে প্রশ্নও ছুঁড়ে দিয়েছে, আমিরের মতো একজন পারফেকশনিস্ট কীভাবে এমন একটি স্ক্রিপ্টে কাজ করতে সম্মত হন! দর্শকের এই বিতৃষ্ণার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে টিকিট কাউটারগুলোতেও। ৩০০ কোটি রুপি বাজেটের ছবিটি ভারতীয় বাজার থেকে আয় করতে পেরেছে মাত্র ১৫১.১৯ কোটি।
এবং সবশেষে শাহরুখ খানের জিরো। অনেকের মতেই এটি ছিল কিং খানের নিজেকে ফিরে পাওয়ার সর্বশেষ সুযোগ। সেই সুযোগে যে তিনি চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ, তা বলাই যায়। শেষ পর্যন্ত জিরোর মোট আয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে আমরা এখানে একটি তুলনামূলক হিসাব তুলে ধরতে পারি। সালমানের রেস ৩ মুক্তির প্রথম তিন দিনে আয় করেছিল ১০৩ কোটি। আমিরের থাগস অব হিন্দুস্তান ১০৫ কোটি। সেখানে বিশাল ব্যবধানে পিছিয়ে জিরো। একই সময়ে ছবিটি ভারতীয় বাজার থেকে ঘরে তুলতে পেরেছে মাত্র ৫৯.০৭ কোটি। এবং মুক্তির পরপরই অনলাইনে যেভাবে ছবিটিকে জনরোষের শিকার হতে হয়, এবং নামজাঁদা সমালোচকরা ছবিটির নেতিবাচক রিভিউ দিতে থাকেন, তাতে ধরে নেয়াই যায় শেষ পর্যন্ত জিরোর ফিগার খুব একটা স্বাস্থ্যবান হবে না।
কোথায় ব্যর্থ খানেরা?
তিন খানের ছবি কেন ব্যর্থ, সে ব্যাপারে কথা বলতে গেলে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে বর্তমান সময়ের দর্শকের চাহিদার কথা, অর্থাৎ তারা এখন কোন ধরনের ছবি দেখতে আগ্রহী। ২০১৮ সালে কিছু ছোট থেকে মাঝারি বাজেটের ছবি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে বাধাই হো, রাজি, স্ত্রী, আন্ধাধুন, সোনু কে টিটু কি সুইটি প্রভৃতি ছবি। এসব ছবির কোনোটিতেই খুব বড় কোনো তারকা অভিনয় করেননি। তারপরও দর্শক হলমুখী হয়েছে, অনলাইনে এসব ছবির ভূয়সী প্রশংসা করেছে। এর কারণ কী?
কারণ হলো, এসব ছবির গল্প ও কাহিনী ছিল দারুণ জমজমাট। শিল্পীদের অভিনয় ছিল অসাধারণ। নির্মাতারা স্বল্প পরিসরেই খুব যত্ন করে ছবিগুলো বানিয়েছিলেন, যা বলতে চেয়েছিলেন তা খুব সুন্দরভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। মোট কথা, এসব ছবিতে কনটেন্ট ছিল সর্বোচ্চ মানের। আর কে না জানে, বর্তমান যুগে কনটেন্টই কিং! তাই তো আজকাল ছবির কনটেন্ট যদি ভালো হয়, তাহলে বড় তারকা, নামি নির্মাতা, অগুনতি বাজেট, ফরেন লোকেশন কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। আর এখানেই মার খেয়ে গিয়েছে খানদের ছবি। তাদের ছবিগুলোতে বাকি সব ছিল, ছিল না কেবল কনটেন্ট।
আরও একটি বড় কারণ হলো খানদের লার্জার দ্যান লাইফ পারসোনা, যা আজকের দিনে খুব একটা কাজে লাগছে না। এখন দর্শকরা অনেক বেশি খুঁতখুঁতে। তাই পর্দায় কেবল প্রিয় তারকার উপস্থিতিই তাদের মন ভরানোর জন্য যথেষ্ট না। তারকারা চরিত্রের সাথে কতটা মানানসই, সেটিও তারা খুবই সমালোচকের দৃষ্টিতে বিচার করে। তাই তো আমির দাঙ্গাল ছবিতে তার বর্তমানের কাছাকাছি বয়সী চরিত্রে অভিনয় করলে, তা প্রচলিত দৃষ্টিতে নায়কসুলভ না হলেও, দর্শক সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু সেই আমিরই বয়স লুকিয়ে ঠগ সাজলে, সেই ঠগের ভাঁড়ামিতে দর্শকমনে কেবল বিরক্তিরই উদ্রেক ঘটে। আবার জাব হ্যারি মেট সেজালের চেয়ে কিন্তু বক্স অফিসে ভালো করেছিল রইস, যেখানে শাহরুখ রোমান্সের পিছে ছোটেননি। মনে করে দেখুন, রোমান্সের (নাকি আংটির?) পেছনে ছুটতে গিয়ে জাব হ্যারি মেট সেজালে কী ভরাডুবিটাই না তার হয়েছিল!
এদিক থেকে সালমান অবশ্য কিছুটা নিরাপদ অবস্থানে আছেন। দর্শক জানে তার কাছ থেকে কী আশা করা যায়। আমির-শাহরুখের মতো সালমান প্রত্যাশার পারদ অতটাও উপরে নিয়ে যাননি, যে কারণে এখন দর্শককে হতাশ হতে হবে। রেস ৩ বা টিউবলাইট হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে মার খেয়েছে, কিন্তু টাইগার জিন্দা হ্যায় দর্শক ঠিকই গ্রহণ করেছে, এবং কে জানে, দাবাঙ ৩ দেখতেও হয়তো হলে উপচেপড়া ভিড় দেখা যাবে!
তবে এতক্ষণ ধরে এসব বলার মূল উদ্দেশ্য হলো এই সত্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করা যে, দর্শক আজকাল ছবিতে চরিত্রের বাস্তবসম্মত রূপায়ন দেখতে চায়। হাল আমলের ত্রিশের কোঠায় থাকা অভিনেতারা যখন সমসাময়িক কাহিনী নিয়ে ছবি করছেন, সেগুলো যে কমবেশি সাফল্য পাচ্ছে, তার মূল কারণ এটিই। অর্থাৎ বলিউড নিয়ে দর্শকের এখন আর অসম্ভব রকমের ফ্যান্টাসি নেই। তারা ছবিতে আর রূপকথার কাহিনী নয়, চায় বাস্তব জীবনের প্রতিফলন।
এই বিষয়টি তিন খানের, বিশেষ করে আমির ও শাহরুখের, গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিৎ। তাদের বোঝা উচিৎ, এখন আর তাদের একটি ধুম ৩ বা চেন্নাই এক্সপ্রেস করার বয়স নেই। বরং তারা এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে পারেন অক্ষয় কুমারের পদাঙ্ক, যিনি সাম্প্রতিক সময়ে সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত কিংবা সমাজ সচেতনতামূলক ছবিতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। একটিবার ভেবে দেখুন তো, প্যাডম্যান বা টয়লেট জাতীয় ছবির বিষয়বস্তু যতটা জোরালো, তাতে এই ছবিগুলোতে যদি অক্ষয়ের পরিবর্তে তিন খানের একজন থাকতেন, এগুলো কি এমনকি অলটাইম ব্লকবাস্টারও হওয়ার যোগ্যতা রাখত না?
২০১৮ সালটা কাদের ছিল?
এতক্ষণ ধরে তো আলোচনা করা হলো ২০১৮ সালে ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দি থাকা তিন খানের ব্যাপারে। তাহলে এ বছর জয়ী হয়েছেন কারা? এই তালিকায় বেশ অনেকেই আসতে পারেন।
প্রথমেই বলতে হয় সাইফ আলি খানের কথা। নেটফ্লিক্স অরিজিনাল স্যাক্রেড গেমস দিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন তিনি। এবং এরপর তার বাজার ছবিটিকেও দর্শক ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছে। তবে তার সবচেয়ে বড় লাভ সম্ভবত হয়েছে রেস ৩ এর কল্যাণে। তিনি নিজে রেস ৩ এ অভিনয় করলে যতটা আলোচনায় আসতেন, তারচেয়ে অনেক বেশি উচ্চারিত হয়েছে তার নাম, কারণ তার জায়গাটি দখল করেছেন সালমান খান। যতবার দর্শক-সমালোচকদের হাতে ব্যবচ্ছেদ হয়েছে রেস ৩, ততবারই কান পাতলে শোনা গেছে সাইফের না থাকার হাহাকার। অন্তত এজন্য সাইফ সালমানের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতেই পারেন!
বিশেষভাবে উল্লেখ্য রনবীর কাপুরের নামও। পরপর কয়েক বছর ধরে তার ব্যর্থতার পাল্লা কেবল ভারিই হয়ে চলেছিল। তাই তার দরকার ছিল বড় ধরনের একটি হিটের। এবং সেটি তিনি পেয়েছেন সাঞ্জুর কল্যাণে। অনেক খেটেখুটে, ডেডিকেশনের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সঞ্জয় দত্তের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। তার এত পরিশ্রম বৃথা যায়নি। সাঞ্জু যেমন ৩৩৪ কোটি রুপি আয় করে বলিউডে বছরের সবচেয়ে বড় হিট, ঠিক তেমনই দর্শকমনেও ফের জায়গা করে নিয়েছেন রনবীর।
বলতে হবে বরুণ ধাওয়ানের কথাও। এতদিন অনেকেই ভেবে এসেছে, বরুণ বুঝি কেবল লাউড অভিনয়ই পারেন। সেই ভুল ধারণা ভেঙে গিয়েছে এ বছর। নিজেকে ভেঙেছেন বরুণ। সুপারস্টারডম মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে অক্টোবর ছবিতে ড্যান চরিত্রে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন তিনি। তার দ্বারাও যে অভিনয়টা সম্ভব, এবং অন্য যে কারও চেয়ে অনেক ভালোভাবেই সম্ভব, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি অক্টোবরের মাধ্যমে। এবং সেই ধারা তিনি বজায় রেখেছেন সুঁই-ধাগা ছবিতেও। নিশ্চিত করেছেন যে ভবিষ্যতে পরিচালকরা তাকে কেবল ফর্মুলাসমৃদ্ধ মাসালা ছবির জন্যই নয়, সিরিয়াস কাহিনীসমৃদ্ধ ছবির জন্যেও বিবেচনা করতে পারবেন।
এছাড়াও ২০১৮ সালে প্রশংসার জোয়ারে ভেসেছেন রনবীর সিং, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিক, রাজকুমার রাওরা। বছরটা ভালো গেছে পঙ্কজ ত্রিপাঠী ও কার্তিক আরিয়ানেরও। তাদের প্রত্যেকের জন্যই ২০১৮ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখেন দুজন অভিনেতা। তারা হলেন ভিকি কৌশাল ও আয়ুষ্মান খুরানা।
ভিকি কৌশাল
নিঃসন্দেহে ২০১৮ সালে বলিউডের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ভিকি কৌশাল। বছরটা তিনি শুরু করেছিলেন নেটফ্লিক্সের রম-কম লাভ পার স্কয়ার ফুট দিয়ে। এরপর আবার বছরের মাঝামাঝি সময়ে তাকে নেটফ্লিক্সেই দেখা গেছে লাস্ট স্টোরিস ছবিটিতেও। এই দুইয়ের মধ্যেই অবশ্য তিনি পেয়ে গেছেন তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। সেটি হলো মেঘনা গুলজারের রাজি। আলিয়া ভাটের বিপরীতে এই ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমেই মূলধারার দর্শকের প্রিয়মুখে পরিণত হন তিনি। এরপর তিনি আলো ছড়ান সাঞ্জুতেও। এমনকি তিনি পর্দায় থাকতে রনবীর কাপুরকেও বেগ পেতে হয়েছে আকর্ষণ নিজের উপর ধরে রাখতে। তিনি ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন মানমারজিয়া ছবিতেও। এই ছবিতে তাকে দেখা গিয়েছিল তাপসী পান্নু ও অভিষেক বচ্চনের পাশে। আশা করা যায়, আসন্ন বছরেও সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখবেন তিনি। অ্যাকশন থ্রিলার উরি: সার্জিকাল স্ট্রাইকসের মুখ্য ভূমিকায় দেখা যাবে তাকে।
আয়ুষ্মান খুরানা
২০১৮ সালে বলিউডের সবচেয়ে বড় তারকা অবশ্যই আয়ুষ্মান খুরানা। বিগত কয়েক বছর সমালোচকদের চোখের মণি হয়ে থাকা আয়ুষ্মান এবার পেয়েছেন মূলধারার বাণিজ্যিক সাফল্যও। তার আন্ধাধুন ও বাধাই হো ছবি দুটি মিলে আয় করেছে ২০০ কোটি রুপিরও বেশি। মজার ব্যাপার হলো, দুটি ছবি একদম ভিন্ন ঘরানার। কিন্তু অভিন্ন যে বিষয়টি, তা হলো সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা আর টিকিট কাউন্টারের সামনে দর্শকের লম্বা লাইন।
শ্রীরাম রাঘবন পরিচালিত আন্ধাধুন ছবিটি অনেকের মতেই এ বছর বলিউডের সেরা ছবি। ইতিমধ্যেই সেটি পেয়ে গেছে কাল্ট হিটের তকমা। মুক্তির পর দর্শক হলে গিয়ে ছবিটি দেখেছে তো বটেই, এরপর নেটফ্লিক্সের বদৌলতে এখন ছবিটি বিশ্বের সব দেশের দর্শক অনলাইনেই দেখতে পাচ্ছেন। ফলে মুক্তির ৮০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও এই ছবি নিয়ে উন্মাদনার জোয়ার কমার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। যেহেতু ছবিটির ওপেন এন্ডিং ক্লাইম্যাক্স ছিল, তাই প্রায় প্রতিদিনই অনলাইনে কেউ না কেউ নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হচ্ছে। তর্ক-বিতর্কে মেতে উঠছে সবাই।
অন্যদিকে আয়ুষ্মান অভিনীত, অমিত শর্মার বাধাই হো ছবিটিও জিতে নিয়েছে দর্শক-সমালোচক নির্বিশেষে সকলের মন। হাস্যরসের মাধ্যমে এই ছবিতে এমন একটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যা পৃথিবীর অন্য অনেক অঞ্চলের মতো, আমাদের উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটেও খুবই প্রাসঙ্গিক। আমাদের চারপাশে এমন উদাহরণ অজস্র রয়েছে। তফাৎ এই যে, এমন বহুল পরিচিত একটি বিষয় নিয়ে ইতিপূর্বে ছবি নির্মাণের চেষ্টা করেননি কেউ। অমিত শর্মা সেটি করেছেন, আর সেখানে প্রথম পছন্দ হিসেবে তিনি অবশ্যই বেছে নিয়েছেন আয়ুষ্মানকে, যিনি এর আগেও স্পার্ম ডোনেশন কিংবা ইরেকটাইল ডিজফাংশনের মতো তথাকথিত ট্যাবু বিষয়গুলো নিয়ে নির্মিত ছবিতে অভিনয় করে এসেছেন।
বাধাই হো-তে চমৎকার অভিনয় ছিল আয়ুষ্মানের। তার কমিক টাইমিংয়ের প্রশংসা না করলেই নয়। কিন্তু তিনি আসল ছক্কাটি হাঁকিয়েছেন আন্ধাধুন দিয়ে। ছবিটি দেখার পর যে কেউ অভিভূত হতে বাধ্য। কোনো বিশেষণই হয়তো উপযুক্ত নয় এ ছবিতে আয়ুষ্মানের অভিনয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য। শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে, অভিনয় দক্ষতায় সমসাময়িক অনেকেই আয়ুষ্মানের সমকক্ষ থাকতে পারেন বলিউডে, কিন্তু আয়ুষ্মানের চেয়ে শ্রেয়তর কেউ সম্ভবত নেই। আন্ধাধুনে অন্ধ পিয়ানিস্ট আকাশের চরিত্রটি বোধহয় আয়ুষ্মানের জন্যই লেখা হয়েছিল। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে এ চরিত্রে মানাতোই না।
তবে অভিনয়ের চেয়েও আয়ুষ্মানের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হলো তার চিত্রনাট্য বাছাই। এক্ষেত্রে তিনি অদ্বিতীয়। সেই ভিকি ডোনার থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তার অভিনীত প্রতিটি ছবিই বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যতার কারণে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। এত বিচিত্র বিষয়ে ছবি করার মানসিকতা তিনি কোথা থেকে অর্জন করলেন, তা এক পরম বিস্ময়। তিন খানের অবশ্যই অনেক কিছু শেখার আছে ৩৪ বছর বয়সী এই তরুণ অভিনেতার কাছ থেকে। সামনের বছর তিনি আসছেন ড্রিম গার্ল ও বালা নিয়ে। চোখ বুজে বলে দেয়া যায়, ভালো কিছুই পেতে চলেছি আমরা।
শেষ কথা
২০১৮ সালটা বলিউডের তিন খানের জন্য খুবই বাজে গেছে, সে কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এখানেই কি তাদের যাত্রা শেষ? এমনটি যারা ভাবছেন, তারা নেহাতই বোকার স্বর্গে বাস করছেন। সমালোচকদের কলমে অপদস্থ হওয়া, দর্শকদের টিটকারি শোনা, এগুলো কিছুই খানদের জন্য নতুন ব্যাপার নয়। বিগত ২৫ বছরে এমন সময় বেশ অনেকবারই পার করে এসেছেন তারা। এই মুহূর্তে তাদের ব্যাপারে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে মূলত এ কারণেই যে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই বছর তিন খানই ব্যর্থ হয়েছেন। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা, যার সাথে বি-টাউন পূর্ব-পরিচিত নয়। কিন্তু এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই যে ভবিষ্যতে কোনো এক বছরেই হয়ত আমরা দেখব তিন খানের ছবিই সমান জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পাচ্ছে, অতীতের সব রেকর্ড চুরমার করে দিচ্ছে।
বলিউডে দিনবদলের হাওয়া লেগেছে বটে, কিন্তু তবু তিন খানের সফল হওয়া গোটা ইন্ডাস্ট্রির জন্যই খুব বেশি জরুরি। কারণ আজও তিন খানের নামেই বেশিরভাগ দর্শক হলে যায়। তিন খান আছেন বলেই বলিউড এখনও মাথা উঁচু করে টিকে আছে। নতুবা অনেক আগেই তাদের নিজেদের বাজারই দখল করে নিত দক্ষিণ ভারতীয় ছবি ও হলিউড। তাই তিন খানের ঘুরে দাঁড়ানো এখন কেবল তাদের নিজেদের সম্মান বাঁচানোর জন্যই দরকার না, তাদের ঘুরে দাঁড়ানো দরকার গোটা বলিউডের স্বার্থেই। যত তাড়াতাড়ি তাদের এ বোধোদয় হবে, ততই মঙ্গল।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/