![](https://assets.roar.media/assets/QGSvAIX7UyNchvQZ_fok-music.jpg?w=1200)
প্রথাগত, সংস্কারবিহীন, সাধারণ মানুষের মুখে মুখে রচিত এবং সহজবোধ্য সুরে জীবনের গভীর দর্শনের কথা ব্যক্ত হয় যে সঙ্গীতে, তা-ই লোকসঙ্গীত হিসেবে সঙ্গীতের ইতিহাসে আলাদা এক স্থান করে নিয়েছে। বিষয়, ভাব, উপমার ছলে মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা আর পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা এবং এই ভূবন সৃষ্টির অপার রহস্যের কথা কী সহজেই না ব্যক্ত হয়েছে লোকসঙ্গীতের কথা ও সুরে। সহজ, সরল অথচ কী গভীর মর্মার্থ বহন করে তার ভাষা। তাই লোকসঙ্গীত কোনো দেশ-কালের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা হয়ে যায় বিশ্বের আপামর মানুষের সঙ্গীত।
ভারতীয় লোকসঙ্গীতের ইতিহাস
প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে ভারতীয় লোকসঙ্গীত সম্পর্কে প্রথম জানা যায়। অনেক ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞ এমনও মত দেন যে, অখন্ড ভারত সৃষ্টির পূর্ব থেকে এ অঞ্চলগুলোতে লোকসঙ্গীতের নানা ধারা বহমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ, মধ্য ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে জনপ্রিয় একটি লোকসঙ্গীত হচ্ছে ‘পাণ্ডবনি’, যা হিন্দু মহাকাব্য ‘মহাভারতের’ সমসাময়িক বলে ভাবা হয়। ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ এবং অন্ধ্র প্রদেশেও এই লোকসঙ্গীত বেশ জনপ্রিয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই লোকসঙ্গীতের ধারা একইভাবে চলে আসছে।
![](https://assets.roar.media/assets/xmy9TcTg7WV4zxTP_Indian-Folk-Music-ili-457-img-5.jpg)
পরবর্তী সময়ে লোকসঙ্গীত বিনোদনের এক মাধ্যমে হিসেবে সারা ভারতের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কোনো বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠান বা কোনো বিশেষ উৎসব, লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করা হতো। প্রাচীনকাল থেকেই লোকসঙ্গীতের কথা ও সুর বংশানুক্রমিকভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো। কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে এভাবেই লোকগানগুলো সংরক্ষণ করা হতো।
লোকগানের কথা ও সুর
প্রাচীনকালের কোনো গল্পগাঁথা বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণের কোনোরূপ ব্যবস্থা ছিল না। তাই সে সময়ের মানুষেরা এসব তথ্য সংরক্ষণের জন্য সঙ্গীতের আশ্রয় নিতেন। সে সময়ের কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, গল্প বা কাহিনীকে সহজবোধ্য কথা ও সুরে সাধারণ মানুষের মাঝে পরিবেশন করা হতো। আর এভাবে সে কাহিনী বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়তো। সহজ সুর ও কথায় গাওয়া সেসব গান সাধারণ মানুষ দ্রুত আত্মস্থ করে নিতে পারতো। গানগুলো তখন বিনোদনের জন্য নয়, দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যই মূলত ব্যবহৃত হতো।
![](https://assets.roar.media/assets/Edo4vgU1Vyuh6D1O_Untitled-4-copy.jpg)
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকসঙ্গীতের ধারা
ভারত সৃষ্টির পর থেকে লোকসঙ্গীতের নানা ধারা ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে আরও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে থাকে। ভারতের মানুষের চেহারা, ভাষা, আচার-আচরণ বৈচিত্র্যে ভরা। তাই সঙ্গীতেও বৈচিত্র্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। ভারতের লোকসঙ্গীত বেশ বর্ণময় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণও। যেমন- তুষারে ঢাকা হিমালয় অঞ্চলের মানুষজনের গান আর রাজস্থানের তপ্ত বালুকাময় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের গানের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের কথায় মূলত প্রাধান্য পায় কোনো ঐতিহাসিক বিষয় (যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়), উপকথা (দেবদেবীর কল্পকাহিনী) কিংবা মানব জীবনেরই কোনো গুঢ় রহস্য (যেমন- জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ বা প্রেম)। ভারতের প্রতিটি রাজ্যেই বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত চালু আছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের এমনই কিছু জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত সম্পর্কে আজ আমরা জানাবো।
নাদানপততু, কেরালা
কেরালা ভূখন্ডের শ্রমজীবী মানুষের গল্প শোনায় নাদানপততু। লোকসঙ্গীতের এই ধারাটিি বেশ প্রাচীন। কাজ করতে করতে নানা ধরনের লোকগীতি করেন সেখানকার করেন মানুষ। গানের তাল তাদের কাজ দ্রুত শেষ করতে সাহায্য করে। প্রতিটি গানেই তাদের কাজের বর্ণনা থাকে। কখনো জমিতে লাঙল চালানোর গান, কখনো বা ফসল কাটার গান, কখনো আবার শস্য পেষাই কিংবা মাছ ধরার গান। মাছ ভর্তি জাল টানার সময় জেলেরা কাজের তালে তালে সুন্দর গান করতে থাকেন।
![](https://assets.roar.media/assets/vR0SSz7ooGOSxm60_kerela.jpg)
বিঁহুগীত, আসাম
আসামের এক জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত বিঁহু। উত্তর-পূর্ব ভারতে কিছু কিছু অংশে এই লোকসঙ্গীত গাওয়া হয়ে থাকে। মূলত বিঁহু নাচের সাথে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। অসমিয়া সংস্কৃতির এক প্রধান উৎসব বিঁহু। বছরে তিনবার এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গই হলো বিঁহু নাচের সাথে জনপ্রিয় বিঁহুগীত। আসামের যুবক-যুবতীরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে গান ও নাচে অংশ নেয়। এই গানের মধ্যে থাকে উচ্ছলতা, আনন্দের নানা বহিঃপ্রকাশ। বিঁহু গানের মূল বিষয়বস্তু প্রকৃতি, প্রেম, সম্পর্ক, সামাজিক বার্তা এবং নানা হাস্যরস।
![](https://assets.roar.media/assets/p60ixnQZfhQvR8eF_image-28437.jpg)
গুলরেজ, কাশ্মির
কাশ্মিরিদের একটি লোকসঙ্গীত যা অন্য সব রাজ্যের লোকসঙ্গীতের ধারার চেয়ে আলাদা, তার নাম ‘গুলরেজ’। এর অর্থ একটি লোককাহিনী। প্রাচীন সব লোককাহিনী উঠে এসেছে এই লোকসঙ্গীতে। কবিরা এর কাহিনী লেখেন। কখনো সখনো একটি কাহিনীতে হাজারখানেক পদ্য থাকে। প্রতিটি পদ্য জনপ্রিয় গানের সুরে গাওয়া হয়। এই লোকসঙ্গীতের সুর এতই জনপ্রিয় যে অনেক হিন্দী সিনেমার জনপ্রিয় গান এই লোকসঙ্গীতের সুরের আদলে গাওয়া হয়েছে।
যোধা, থাধাই (উত্তরাখন্ড)
উত্তরাখন্ড রাজ্যে আয়োজিত বিভিন্ন উৎসব এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্থানীয়রা যোধা, থাধাই নামের লোকসঙ্গীত গেয়ে থাকে। এসব গানে থাকে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা, ঐতিহাসিক কোনো সাহসী চরিত্রের কথা এবং ধর্মীয় কোনো গল্প বা চরিত্রের নির্যাস। এই লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয়রা।
![](https://assets.roar.media/assets/Ixi8tz2AwQsZ3mKm_uttarakhand-culture-tradition-e1470823693728.jpg)
থাধাই সাধারণত রাজ দরবারে গাওয়া হয়। যোধা সঙ্গীতে একদল গান করে আর একদল গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করে। এই গানের সাথে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে দৌর, থালি, রাসিঙ্গা, দমুন, ঢোলকি, ঢোল, ভনকোড়া, হারমোনিয়াম, তবলা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
গরবা, গুজরাট
গুজরাটিদের লোকসঙ্গীতের একটি ধারাকে ‘গরবা’ বলা হয়। এই গানের সাথে নারী ও পুরুষ উভয়েই লাঠি হাতে নাচেন। বিদেশে থাকেন এমন গুজরাটিরাও উৎসবের সময় এই লোকসঙ্গীতের সাথে লোকনৃত্য পরিবেশ করে থাকেন।
![](https://assets.roar.media/assets/9NBvCTFnZo9KJcfI_garba.jpg)
ভাঙড়া, পাঞ্জাব
এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত হলো ‘ভাঙড়া’। এটি ভারতের সবচেয়ে প্রাচীনতম সঙ্গীতগুলোর একটি। সঙ্গীতটি প্রায়ই বিখ্যাত ভাঙড়া নাচের সাহায্যে গাওয়া হয়। মহিলারা সুর করে গান করেন আর পুরুষরা গানের তালে তালে নাচেন, সাথে থাকে ড্রাম, তারের যন্ত্র আর করতাল।
![](https://assets.roar.media/assets/zsZvMOJrE4roov3I_Untitled-3-copy.jpg)
লাবনি, মহারাষ্ট্র
লাবনি মহারাষ্ট্রের একটি জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত। মূলত সৈন্যদের বিনোদনের জন্য এই লোকসঙ্গীতের আয়োজন করা হতো। প্রথমদিকে মহিলাদের দ্বারা গানগুলো গাওয়া হতো, পরে পুরুষরাও এই গানে অংশ নিতে থাকে। গানের মূল বিষয়বস্তু থাকে রাজনীতি এবং সমাজ জীবনের নানা কথা। এই লোকসঙ্গীতের আবার দুটি ধারা: নিরগুনী লাবনি ও শৃঙ্গারী লাবনি।
![](https://assets.roar.media/assets/i5rA6v3em0LCNTAT_Untitled-2-copy.jpg)
নিরগুনী সঙ্গীতে সাধারণত দার্শনিক কথাবার্তাই প্রকাশিত হয়। আর শৃঙ্গারী লাবনিতে প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার কথা বলা হয়ে থাকে। সমাজের উঁচু শ্রেণীর কর্তাব্যক্তিদের মাঝে একটি নির্দিষ্ট বদ্ধ কক্ষে লাবনির যে ধারাটি গাওয়া হয়ে থাকে তাকে বৈঠকিচি লাবনি বলা হয়ে থাকে। আর উন্মুক্ত মঞ্চে সাধারণ মানুষের মাঝে লাবনির যে ধারাটি গাওয়া হয় তা পাদেচি লাবনি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
বাউল, বাংলা
কবিতা আর সঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত বাংলা। এই রাজ্যের জনপ্রিয়তম লোকসঙ্গীতের একটি ধারা হলো বাউল। চারণ কবিরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান আর বাউল গান পরিবেশন করেন। গান গেয়ে সুর রচনা করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। মূলত ধর্ম, জীবন আর প্রকৃতিই হলো বাউল গানের বিষয়বস্তু। একতারা, দোতারা, খোল, সারেঙ্গি এসব অনুষঙ্গই মূলত ব্যবহৃত হয়ে থাকে বাউল গানে। বর্তমানে আধুনিক সমাজের বাউলরা তারের যন্ত্র আর করতাল নিয়ে গান করেন। বাউলদের গান বহু পশ্চিমী গায়ককেও আকর্ষণ করেছে। বিখ্যাত গায়ক বব ডিলানও বাউল গানে হয়েছিলেন মোহিত।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এর বাইরেও লোকসঙ্গীতের বেশ কিছু ধারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন লোকশিল্পীরা। তার মধ্যে রাজস্থানের ‘মানন্দ’, ‘পবজি কি পাহচ’, ‘পানিহারি’; অন্ধ্র প্রদেশের ‘সুভ্ভি’, ‘মাদিগা’; বিহারের ‘সোহার’, ‘সুমঙ্গলি’; ঝাড়খন্ডের ‘ঝুমুর’; গোয়া অঞ্চলের ‘ভানবার’, ‘ফুগরি’, ‘মান্ডো’ উল্লেখযোগ্য। অঞ্চলগুলোর জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের এসব ধারা বহির্বিশ্বেও পরিচিতি লাভ করেছে। এসব লোকসঙ্গীতেও স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পুরনো উপকথা, কোনো বীরত্বপূর্ণ চরিত্র এবং মানবিক প্রেম-ভালবাসার কথাই ঘুরে ফিরে এসেছে। তবে অঞ্চলভেদে গানগুলো গাওয়ার ভঙ্গি, সুর রীতিতে বৈচিত্র্য লক্ষণীয়।
ফিচার ইমেজ- YouTube.com