দুই অনুসন্ধানী প্রতিবেদক, ক্রিস্টিয়ান মিলার (প্রোপাবলিকা) এবং কেন আর্মস্ট্রং (দ্য মার্শাল প্রজেক্ট) পৃথকভাবে কাজ করছিলেন আপাতদৃষ্টিতে দুইটি ভিন্ন ঘটনার উপর। মিলার কাজ করছিলেন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর দুইটি আলাদা জায়গার পুলিশের গোয়েন্দা স্টেসি গ্যালব্রেইথ ও এডনা হেন্ডারশট একজোট হয়ে এক সিরিয়াল রেপিস্টকে পাকড়াও করেছিলেন। আর আর্মস্ট্রংয়ের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু ছিল ওয়াশিংটনে মেরি নামের এক কমবয়েসি নারীর কেস, যিনি প্রথমে পুলিশের কাছে একটি ধর্ষণের মামলা দায়ের করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশ তার নামে মিথ্যা প্রতিবেদনের অভিযোগ এনে তাকে জরিমানা করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে শুরু থেকে তিনি সত্যি কথাই বলে আসছিলেন।
কাজ করতে গিয়ে দুই সাংবাদিক একে অপরের সাথে পরিচিত হন, এবং তারা আবিষ্কার করেন যে তারা দুজনে যে বিষয় দুইটি নিয়ে কাজ করছেন, সেগুলো পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। প্রথম দিকে নিছকই স্কুপের আশায় থাকলেও, এক পর্যায়ে মিলার ও আর্মস্ট্রং উপলব্ধি করেন গোটা বিষয়টি ঠিক কতটা গুরুতর। তখন তারা সিদ্ধান্ত নেন, পৃথকভাবে প্রতিবেদন করার বদলে এমনভাবে প্রতিবেদনটি সাজাতে হবে, যাতে তা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সংখ্যক পাঠকের কাছে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। তাই মিলার ও আর্মস্ট্রং তাদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানকে রাজি করান, এবং শেষ পর্যন্ত প্রোপাবলিকা ও দ্য মার্শাল প্রজেক্ট যৌথভাবে প্রকাশ করে তাদের প্রতিবেদনটি। “An Unbelievable Story of Rape” শিরোনামের সেই প্রতিবেদনটি সর্বমহলে দারুণ প্রশংসিত হয়, এবং ২০১৫ সালে পুলিৎজার পুরস্কারও জিতে নেয়।
পরবর্তীতে প্রতিবেদনটিকে আরো বিস্তৃত আকারে প্রকাশ করা হয় একটি বইয়ের (A False Report: A True Story of Rape In America) মাধ্যমে, এবং দুই পর্বের পডকাস্ট (Anatomy Of Doubt) হিসেবে কাহিনীটি প্রচারিত হয় This American Life অনুষ্ঠানেও। তবে এতদিন প্রতিবেদন, বই ও পডকাস্টের মাধ্যমে কাহিনীটি নির্দিষ্ট কিছু পাঠক-শ্রোতার কাছেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সেটি পুরো বিশ্বব্যাপী পৌঁছে গেছে নেটফ্লিক্সের নতুন অরিজিনাল মিনি সিরিজ আনবিলিভেবল (Unbelievable) এর মাধ্যমে। আট পর্বের মিনি সিরিজটির শো-রানার সুজানা গ্রান্ট, এবং সিরিজটি নেটফ্লিক্সে স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে।
সিরিজটির নাম কেন আনবিলিভেবল, যার বাংলা করলে হয় অবিশ্বাস? এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
প্রথমত, আমাদের সমাজের সেই রুঢ় বাস্তবতাটিকেই এখানে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে কোনো নারী তার উপরে হওয়া যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করলেও সে সকলের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে না। অনেকেই তাকে সন্দেহ করতে থাকে, হয়তো সে যা বলছে তা সত্যি নয়, হয়তো সে কাউকে ফাঁসানোর জন্য, অর্থের লোভে, কিংবা খ্যাতি পাওয়ার লক্ষ্যে এমন অভিযোগ আনছে। অনেকে সরাসরি তার চরিত্রের দিকেও আঙ্গুল তোলে। এভাবে যৌন নিপীড়নের অভিযোগকারীর উপর সমাজের যে অবিশ্বাস, সে বিষয়টি এই সিরিজের প্রথম পর্ব থেকেই প্রাধান্য পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত, অবিশ্বাসের আরো অনেক জায়গা রয়েছে এই কাহিনীতে। এক কিশোরী পুলিশের কাছে তার উপর হয়ে যাওয়া ধর্ষণের অভিযোগ করলে, পুলিশের প্রাথমিক তদন্তকারী অফিসার এবং গোয়েন্দা, সকলেই তার সাথে যে অসহানুভূতিশীল আচরণ করে, এবং মূল অপরাধীকে ধরার চেষ্টা না করে যেভাবে অভিযোগকারীর বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা চালাতে থাকে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য এ-ও যে একটি বিচ্ছিন্ন ধর্ষণের ঘটনা থেকে কীভাবে আরো অনেকগুলো ধর্ষণের ঘটনা বের হয়ে আসে, এবং দেখা যায় সেগুলো কোনোটিই আসলে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং সবগুলোই একই সুতায় গাঁথা।
আনবিলিভেবলের কাহিনী এগিয়েছে দুইটি পৃথক টাইমলাইনে। প্রথম টাইমলাইনটি ২০০৮ সালের। ওয়াশিংটনের লিনউডে বসবাসরত ১৬ বছর বয়সী কিশোরী মেরি অ্যাডলার (কেইটলিন ডেভার) একজন ফস্টার চাইল্ড। ইতিপূর্বে বেশ কিছু ফস্টার প্যারেন্টসের সাথে থাকার পর, সম্প্রতি সে একা একা একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে শুরু করেছে। একদিন সে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে যে আগের রাতে জনৈক মুখোশধারী ব্যক্তি তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেছে। কেসটি গ্রহণ করে দুইজন মধ্যবয়সী পুরুষ গোয়েন্দা, এবং যেহেতু ঘটনাস্থল থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাই বারবার তারা মেরির কাছে ঘটনাটি জানতে চায়। মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়া মেরিকে অজস্রবার সেই বীভৎস ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়।
এক পর্যায়ে মেরির বক্তব্যের মাঝে কিছু অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়লে গোয়েন্দাযুগল সন্দেহ করতে থাকে, মেরি বুঝি মিথ্যা কথা বলছে। কারণ তাদের মতে, একটি কমবয়েসী মেয়ে, যে কিনা ছোটবেলা থেকে সকলের অবহেলা, নিগ্রহের শিকার হয়ে এসেছে, সে সমাজের ‘এটেনশন সিক’ করার জন্য এমন একটি মনগড়া গল্প বলতেই পারে। এছাড়া তাদের সন্দেহ আরো উসকে দেয় মেরির দুই প্রাক্তন ফস্টার মাদারও, যাদের কাছেও মেরির আচরণ অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল। এভাবে জীবনের কঠিনতম সময়ে মেরি এই পৃথিবীতে পুরো একা হয়ে যায়, এবং গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করে, সে আসলে মিথ্যা কথা বলেছিল। গোয়েন্দারা কেসটি শুধু ক্লোজ করে দিলেই পারত, কিন্তু তা না করে তারা মেরির উপর মিথ্যা প্রতিবেদনের অভিযোগ এনে তাকে জরিমানা করে, মেরির জীবনকে আরো বেশি দুর্বিষহ করে দেয়।
দ্বিতীয় টাইমলাইনটি শুরু তিন বছর পর, ২০১১ সালে। কলোরাডোর গোল্ডেনে একটি ক্রাইম সিনে এসে উপস্থিন হয় এক নারী গোয়েন্দা, ক্যারেন ডুভাল (মেরিট ওয়েভার)। আরো একজন কমবয়েসী নারী, অ্যাম্বার স্টিভেনসন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শুরু থেকেই এই নতুন ভিকটিমের প্রতি ক্যারেনের সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হতে থাকে। মেরির বেলায় পুলিশ গোয়েন্দাযুগল যতটা অমানবিক ছিল, অ্যাম্বারের প্রতি ক্যারেন ঠিক ততটাই মানবিক। সে খুবই ধৈর্য, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধার সাথে অ্যাম্বারের প্রতিটি কথা শোনে, তাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়, এবং অ্যাম্বারের প্রতিটি কথা ও আচরণের যথাযথ প্রতিক্রিয়াও সে দেখায়। মেডিকেল টেস্টের সময় অ্যাম্বারের সাথে কী কী করা হবে, সেটিও খুবই শান্ত ও স্পষ্টভাবে তাকে জানায় ক্যারেন। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এবারও ঘটনাস্থলে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রমাণ না মিললেও, ক্যারেন তার আচরণের মাধ্যমে অ্যাম্বারের কাছে এটি পরিষ্কার করে দেয় যে তার সব কথাই সে বিশ্বাস করছে।
ক্যারেন খুবই গুরুত্ব সহকারে তদন্ত শুরু করে দেয় এবং শীঘ্রই সে সন্দেহ করতে থাকে, ধর্ষকের জন্য এটি প্রথম ধর্ষণ ছিল না। আগেও সে ধর্ষণ করেছে, এবং সম্ভবত সে একজন সিরিয়াল রেপিস্ট। এই কেসের সাথে সে সাম্প্রতিক সময়ের অন্য আরেকটি কেসের মিল খুঁজে পায়, যা ঘটেছিল ডেনভারে। ধর্ষকের আচরণ থেকে সে এমন কিছু প্যাটার্ন চিহ্নিত করতে পারে, যা ডেনভারের ঘটনায়ও ধর্ষক করেছিল। তাই ক্যারেন ডেনভারে গিয়ে ওই কেসটির গোয়েন্দা গ্রেস রাসমুসেনের (টনি কোলেট) সাথে কথা বলে। শুরুতে ক্যারেনের উপস্থিতিতে গ্রেস বিরক্তি প্রকাশ করলেও, এক পর্যায়ে এই দুই নারী একত্র হয়ে উঠেপড়ে লাগে ধর্ষককে ধরার জন্য। দুইজনই নারী হওয়ায়, ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের মনের উপর দিয়ে কী ঝড় যায়, সেটি তারা উপলব্ধি করতে পারছিল, এবং এই উপলব্ধিই তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে যেভাবেই হোক ধর্ষককে ধরার মাধ্যমে তাকে পরবর্তী ধর্ষণ থেকে প্রতিহত করতে।
অনেকেই হয়তো আনবিলিভেবলের কাহিনীর সাথে এই বছরই নেটফ্লিক্সে স্ট্রিমিং শুরু হওয়া আরেকটি সিরিজ দিল্লি ক্রাইমের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। আসলেই দুইটি সিরিজের মধ্যে বেশ কিছু মিল রয়েছে। প্রথমত, দুইটিই সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। দ্বিতীয়ত, দুইটি কেসেই নেতৃত্বে ছিল নারীরা। তৃতীয়ত, দুইটি সিরিজেই পুলিশ বা গোয়েন্দাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের অনুসন্ধানের খুঁটিনাটি দেখানো হয়েছে। এবং চতুর্থত, দুইটি সিরিজই যাবতীয় নাটকীয়তা ও বাহুল্যবর্জিত। কাহিনীতে ‘থ্রিল’ ঢোকানোর জন্য কাহিনীতে কোনো ধরনের অতিরঞ্জনের প্রবেশ ঘটেনি, বরং বাস্তবিক যা যা হয়েছিল, সেগুলোকেই অত্যন্ত নির্মোহভাবে সিরিজ দুইটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এত মিল থাকার পরও, মোটা দাগে একটি অমিলও নির্দেশ করা যেতে পারে। দিল্লিতে বাসে গণধর্ষণের ঘটনাটি নিয়ে ওই সময়েই গোটা ভারতজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি একটি বহুলচর্চিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সে তুলনায় আনবিলিভেবলের ধর্ষণগুলোকে মোটামুটি অখ্যাতই বলা চলে। সিরিজটি প্রকাশের পর এমনকি ওয়াশিংটন ও কলোরাডোর অনেক দর্শকও জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় যে এমন কিছু ঘটেছিল সে ব্যাপারে তারা জানতেনই না!
সে যা-ই হোক, নেটফ্লিক্সে স্ট্রিমিং শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রশংসার বৃষ্টিতে ভিজছে আনবিলিভেবল। দর্শক-সমালোচক নির্বিশেষে সকলেই ইতিবাচক মতামত জানাচ্ছে সিরিজটির বিষয়ে। সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিমত হলো, যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও মানবিক নির্মাণ এই সিরিজটি। অনেকের মতে এটি বছরের অন্যতম সেরা টিভি সিরিজও বটে।
এখানে যে সাংস্কৃতিক সত্যটিকে তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেরির সাথে হওয়া ঘটনাটির মাধ্যমে এই সিরিজ দেখিয়েছে, ধর্ষণের অভিযোগ আনার পর একজন নারীকে কতটা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। ধর্ষিতা নারী চায় ঘটনাটিকে ভুলে যেতে, মন থেকে সেটিকে মুছে ফেলতে। কিন্তু পুলিশ, গোয়েন্দা থেকে শুরু করে আদালতের উকিল, সকলেই বারবার তাকে বাধ্য করে ঘটনাটি বলতে। এভাবে ধর্ষিতার মনের ক্ষতটিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দগদগে ঘা করে ফেলা হয়। গণমাধ্যমে ধর্ষণের খবর প্রচারের ফলেও ধর্ষিতার ব্যক্তিজীবন নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বলা হয়ে থাকে, একজন ধর্ষিতা বাস্তবে ধর্ষণ হয় হয়তো একবার, কিন্তু পরবর্তীতে তার পারিপার্শ্বিক সমাজ তাকে ধর্ষণ করে আরো হাজারবার। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও সিংহভাগ নারীই যে তা পুলিশকে জানায় না এবং ধর্ষককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় না, তার পেছনে এটিই অন্যতম কারণ। কে চাইবে ধর্ষককে একজন বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে গিয়ে নিজেকে সমাজের প্রতিটি তথাকথিত বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে! একজন মানসিকভাবে ভঙ্গুর ধর্ষিতার পক্ষে সেটি কি অত্যন্ত অসম্ভব ব্যাপার নয়?
ভিকটিম ব্লেমিং ও ভিকটিম শেমিংয়ের বিষয়টিও এই সিরিজে উঠে এসেছে। এক ধর্ষিতা কিশোরী, যে তার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার চাইছে, পুলিশের গোয়েন্দারা কিনা তার উপরই সন্দেহ আরোপ করছে! বলছে, মেয়েটি নাকি এটেনশন সিক করার জন্য মিথ্যা অভিযোগ আনছে! বিষয়টি অদ্ভূত লাগতে পারে, কিন্তু এতে অবাক হওয়ার বোধহয় আর কিছু নেই। কারণ আমাদের সমাজেও বর্তমানে এমনই হয়ে আসছে। বছরখানেক আগে মি-টু মুভমেন্টের পর অনেক নারীই এগিয়ে আসতে শুরু করেছিলেন তাদের সাথে হওয়া যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে। তখনো আমরা দেখেছি, অনেকেই তাদের দিকেই আঙ্গুল তুলেছে। বলেছে, তারা নাকি সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে মনগড়া কাহিনী ফাঁদছেন! এভাবেই ভিকটিম ব্লেমিং ও ভিকটিম শেমিংয়ের মাধ্যমে মি-টু মুভমেন্টের মতো একটি সম্ভাবনাময় আন্দোলনকে গলা টিপে মারা হয়েছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে যাদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাদের প্রায় সকলেই কিন্তু আজো স্বাভাবিক জীবনযাপন করে যাচ্ছে। কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি তাদের। তাই সঙ্গত কারণেই, অনেক সমালোচকই মি-টু পরবর্তী সময়ের একটি অতি জরুরি মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন হিসেবে আখ্যায়িত করছেন আনবিলিভেবল সিরিজটিকে।
ধর্ষণের অভিযোগ খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে পুরুষ পুলিশ অফিসার ও গোয়েন্দারা যে উন্নাসিকতা দেখায়, সহজে ভিকটিমের কথাকে বিশ্বাস করতে চায় না, বরং তার বক্তব্যের মাঝে নানা ফাঁকফোকর খুঁজে বের করতে চায়, সে বিষয়টিও এই সিরিজে প্রদর্শিত একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। কিংবা যদি কোনো পুরুষ পুলিশ অফিসার বা গোয়েন্দা দাবি করেনও যে তারা ব্যতিক্রম, তারপরও প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়, একজন ধর্ষিতা নারীর সাথে যতটা মানবিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ প্রয়োজন, তা করতে কি তারা সক্ষম? অনেকে হয়তো বলতে পারেন, এক্ষেত্রে সরাসরি পুরুষদের দোষারোপ করে লাভ নেই, কারণ তারা নারী না হওয়ায় কোনো নারীর মন বোঝা স্বাভাবিকভাবেই তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়, একজন পুরুষকে যেহেতু ধর্ষিতা নারীর কেসেরও তদন্ত করতে হবে, সুতরাং কেন আগে থেকেই তাকে নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না? অপরাধবিজ্ঞানে অপরাধীদের সাথে মিথস্ক্রিয়তায় যতটা গুরুত্বারোপ করা হয়, নারীসহ সব ধরনের ভিকটিমের সাথে উপযুক্ত আচরণের বিষয়টিতে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয় না কেন?
এই সিরিজে আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে: অপরাধীদের কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করে যেসব বই রচিত হয়, কিংবা যেসব সিরিজ-চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, সেগুলো থেকেও কি নব্য-অপরাধীরা অপরাধের নানা দিক সম্পর্কে শিক্ষালাভ করে না? অবশ্য এই বিষয়টি নিয়ে যদি বিতর্ক হয়ই, তাহলে স্বয়ং এই সিরিজটিও পার পাবে না। কেননা এই সিরিজেও ধর্ষকের কার্যপ্রণালী থেকে শুরু করে তদন্তের নানা খুঁটিনাটি যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা থেকেও তো চাইলে যে কেউই প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত হতেই পারে।
বরং যে বিষয়ে এই সিরিজটিতে আলোকপাতের সম্ভাবনা ছিল, তা হলো সিরিয়াল রেপিস্টরা কেন সিরিয়াল রেপিস্ট হয়। সিরিয়াল কিলারদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সিরিজ ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, কিন্তু সিরিয়াল রেপিস্টদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিশদভাবে এখনো কোনো কাজ হয়নি। কেউ যদি এই সিরিজে থেকে তেমন কিছুর আশা করেন, তাকেও হতাশ হতে হবে। সেজন্য এই সিরিজটিকে দায়ী করার কোনো সুযোগ অবশ্য নেই। বাস্তবে যা যা ঘটেছিল, কেবল সেগুলোর প্রতিফলনই তো এখানে ঘটেছে। এবং দুঃখজনক ব্যাপার, বাস্তবে ধর্ষক তার কাজের পেছনের ব্যাখ্যা দেয়নি।
যা-ই হোক, ফিরে আসা যাক সিরিজটির টেকনিক্যাল বিষয়ে। যদি জানতে চাওয়া হয়, এই সিরিজটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক কী, তবে উত্তর হবে: অভিনয়, পরিচালনা এবং কাহিনীবিন্যাস।
এই সিরিজের প্রধান তিন অভিনেতা অবশ্যই কেইটলিন ডেভার, মেরিট ওয়েভার এবং টনি কোলেট। ‘বুকস্মার্ট’ কমেডিতে অভিনয় করে নজর কাড়া কেইটলিন এই সিরিজে মেরি হিসেবে এতটাই চমৎকার অভিনয় করেছেন যে, বাস্তবের মেরি অ্যাডলারও তার মাঝে নিজের ছায়া খুঁজে পেয়েছেন। মেরিকে পর্দায় কষ্ট পেতে দেখে তিনি নিজের অতীতে ফিরে গেছেন, সেই সময়গুলোর অভিজ্ঞতাকে নতুন করে অনুভব করেছেন। একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য এর থেকে বড় প্রশংসাবাণী নিশ্চয়ই আর কিছু হতে পারে না। এমি, গোল্ডেন গ্লোবসহ একাধিক পুরস্কারজয়ী টনি কোলেটও গ্রেস রাসমুসেন হিসেবে দারুণ ছিলেন। গ্রেসের চারিত্রিক কাঠিন্য ও রুক্ষতা খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
তবে এই সিরিজের সবচেয়ে ভালো লাগার চরিত্রটি অবশ্যই ক্যারেন ডুভাল। একটি চরিত্রের পক্ষে ঠিক কতটা মানবিক হওয়া সম্ভব, তার খানিকটা আঁচ পাওয়া গেছে ক্যারেন ডুভাল চরিত্রটির মধ্যে। আর সেজন্য পুরো কৃতিত্ব অবশ্যই দুইবারের এমি জয়ী মেরিট ওয়েভারের। ভালচারের আনবিলিভেবল রিভিউতে জেন চেনি তো লিখেই দিয়েছেন, “স্বর্গে যদি একজন ঈশ্বর থাকেন এবং সেখানে পা রাখার পর ঈশ্বরই প্রথম সত্তা হিসেবে আপনাকে অভ্যর্থনা জানান, আমি মনেপ্রাণে চাইব তিনি যেন দেখতে ও শুনতে মেরিট ওয়েভারের মতো হন।” কে জানে, সিরিজটি দেখার পর অনেক দর্শকেরই হয়তো মনে আশা জাগবে বাস্তব জীবনেও এমন কারো সান্নিধ্য লাভের!
উল্লেখ করা প্রয়োজন এই সিরিজের তিন ক্রিয়েটর সুজানা গ্রান্ট (শেষ দুই এপিসোডের পরিচালকও), আয়লেট ওয়াল্ডম্যান, মাইকেল চেবন এবং পরিচালক লিজা চোলোডেঙ্কো ও মাইকেল ডিনারের নামও। যেভাবে তারা একটি জটিল কাহিনীকে অতি সহজ-সরলভাবে সাজিয়েছেন ও পর্দায় উপস্থাপন করেছেন, তা সত্যিই অসাধারণ। বিশেষ করে কোনো রকম বাড়তি অনুষঙ্গ যোগ না করে মূল ঘটনাকে প্রাধান্য দেয়া, অযাচিত থ্রিল আনতে গিয়ে কাহিনীর মৌলিকত্বকে নষ্ট না করা, এবং দুইটি পৃথক টাইমলাইনের কাহিনীকে একই সমান্তরালে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া — এই প্রতিটি বিষয়ই প্রশংসার দাবিদার।
ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে সিরিজ বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে অনেকেই পর্দায় সরাসরি নৃশংসতাকে তুলে ধরতে চান। এতে করে সিরিজ বা চলচ্চিত্রটি বাস্তবসম্মত হলেও, অনেক দর্শকের জন্যই তা দেখা দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে যায়। দিল্লি ক্রাইমে ধর্ষণের দৃশ্যটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আনবিলিভেবলে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া যেমন হয়নি, তেমনই সরাসরি দৃশ্যগুলোকে দেখানোও হয়নি। বরং ফ্ল্যাশব্যাকে টুকরো টুকরো দৃশ্য দেখানো হয়েছে, এবং শব্দ শোনানো হয়েছে। প্রথম দুই এপিসোডে দৃশ্যগুলো বারবারই এসেছে, যে কারণে ওই দুইটি এপিসোড অনেকের কাছেই ডিস্টার্বিং লাগতে পারে। কিন্তু এরপর থেকে ওইসব দৃশ্যের মাত্রা কমতে থেকেছে, এবং মূলত শব্দকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমেও নির্মাতারা মূলত ধর্ষিতার মানসিক অবস্থার স্বরূপই তুলে ধরতে চেয়েছেন। একদম শুরুর দিকে তার কাছে ধর্ষণের বিভীষিকাময় স্মৃতিটা কতটা জীবন্ত থাকে, এবং এরপর ধীরে ধীরে সেটি কীভাবে ম্লান হতে থাকে, কিন্তু কখনোই একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় না, সেটিই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন নির্মাতারা।
এত কথার পরও যদি কেউ দোটানায় থাকেন, আনবিলিভেবল দেখবেন কি না, তাদেরকে বলব, অবশ্যই দেখুন। ধর্ষিতা নারীর প্রাথমিক অবস্থা, তাকে যেসব ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সামাজিকভাবে যেসব ঝড়-ঝঞ্ঝার সম্মুখীন তাকে হতে হয় সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাবেন সিরিজটি দেখলে। পাশাপাশি আনবিলিভেবলে অবিশ্বাসটা বেশি করে ফুটে উঠলেও, এর মাধ্যমে বিশ্বাসকেই আরো তাৎপর্যময় করে তোলা হয়েছে। এবং এই বিশ্বাসই কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই নারী গোয়েন্দাকে সব বাধা পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যায়। সুতরাং ধর্ষণের মতো একটি স্পর্শকাতর ও অসহনীয় বিষয় বলে এড়িয়ে না গিয়ে যদি সিরিজটি শেষ পর্যন্ত দেখতে পারেন, তাহলে খুব ভালো কিছুই অপেক্ষা করে থাকবে আপনাদের জন্য।
দেখে নিন আনবিলিভেবলের অফিসিয়াল ট্রেইলার:
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/