মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘লাস্যময়ী’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলছে দীর্ঘকাল ধরে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থের বিচারে লাস্যমায়ী মানে লীলায়িত ভঙ্গিতে নৃত্যরত নারী হলেও প্রচলিত অর্থে যৌন উদ্দীপক অর্থেই এই শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হয়। বিশেষত সিনেমার নায়িকাদের বেলায় অনেক সময় ‘কমপ্লিমেন্ট’ স্বরূপই বলা হয় কথাটি। এই লাস্যময়ী ইমেজ ব্যবহারে শুধু নায়িকারাই নয়, তাদের চেয়ে বরং অনেকাংশে এগিয়ে আছেন নারী গুপ্তচররা। বাস্তব জীবনে প্রতি মুহূর্তে অভিনয় করতে থাকা এই নারীদের মারণাস্ত্র ‘হানি ট্র্যাপ’ বা ‘মধুর ফাঁদে’ যে কত শত রাঘব বোয়াল ধরা পড়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই!
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এমন এক নারীর সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার যিনি নিজেকে ফেসবুকে ডামিনি ম্যাকনট নামে পরিচয় দিয়েছিলেন। নিজেকে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এক সংবাদ সংস্থার অপরাধ বিভাগের সাংবাদিক বলে দাবী করেন তিনি। প্ররোচনায় পড়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর রণকৌশলের গোপন নথিপত্র বান্ধবীর সাথে শেয়ার করে বসেন ভদ্রলোক। এমন পেশায় আবেগের যে কোনো জায়গা নেই, তা হয়তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি।
সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল দুজনের মধ্যে। ফ্যাঁকড়া বাঁধল ঠিক তখন, যখন কাজ উদ্ধার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যের পাখি উড়াল দিল নিজ আকাশে, আর পেছনে ফেলে রেখে গেল আবেগী অফিসারের চালান করা তথ্যের প্রমাণ। এসপিওনাজ সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হলো ভদ্রলোককে। খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল মেয়েটি আসলে যুক্তরাজ্যের হয়ে নয়, কাজ করছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের হয়ে। বলতেই হচ্ছে, বিমান বাহিনীর আবেগপ্রবণ অফিসার আহ্লাদে আটখানা হয়ে আটকে পড়েছিলেন বান্ধবীর মধুর ফাঁদে!
‘হানি ট্র্যাপ’, খাঁটি বাংলায় যাকে আমরা ‘মধুর ফাঁদ’ বলতে পারি, সর্বপ্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে ১৯৬০ এর দশকে। মার্টিনির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা অবসন্ন প্রাণগুলোকে এক ঝলক স্বস্তি দেয়ার ফাঁকে তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্যাদি হাতিয়ে নেয়ার জন্য অনবদ্য এক হাতিয়ার হিসেবে এই ফাঁদ পাততো গুপ্তচররা। পুরুষরা পটাতে চাইত, নারীরা পেশাগত কারণে পটেই থাকত। ফলাফল- চাতুর্যের সাথে কাজ হাসিল করা। একপেশেভাবে শুধু নারীদের দিকে আঙুল তুললে ভুল হবে, নারী-পুরুষ উভয় লিঙ্গই এই ফাঁদ পাততে ওস্তাদ ছিল। এমনকি ১৯৫০ এর দশক থেকে ‘রোমিও স্পাইস’ নামে পুরুষদের নিয়ে একটি নতুন ধারার প্রচলন ঘটে, যার মূলে ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ সমকামী সাংবাদিক জেরেমি উলফেন্ডেন। সমকামিতাকে পুঁজি করে সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের হয়ে ডাবল এজেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করেন তিনি।
কিন্তু আমাদের কল্পনায় হানি ট্র্যাপের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে নারীদের প্রতিচ্ছবি। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির ভাষ্যমতে, এই শব্দটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে জন লা ক্যারের উপন্যাস ‘টিংকার, টেইলর, সোলজার, স্পাই’ থেকে। উপন্যাসের এক থুত্থুড়ে জরাগ্রস্ত বুড়োর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় অমর সে বাণী, “আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এক বিশাল মাপের ভুল করে ফেলেছিলাম, ধরা দিয়েছিলাম এক মধুর ফাঁদে (হানি ট্র্যাপ)”।
ইতিহাসে নির্মম বাস্তবতা আর কল্পকাহিনীর রঙের মিশেলে একটি কথা এখন শতভাগ প্রতিষ্ঠিত। গোয়েন্দা, নিরাপত্তা কর্মী, আর্মি অফিসার থেকে শুরু করে কঠোর চরিত্রের রাজনীতিবিদ- সবার মনের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সুপ্ত প্রেম। গুপ্তচররা শুধু মধুর ফাঁদ পেতে তাদের সেই সুপ্ত প্রেমকে জাগিয়ে তুলে বের করে আনে প্রয়োজনীয় তথ্য। বছরের পর বছর ধরে হানি ট্র্যাপ কাজ করছে, করবে আরও অজস্র বছর। জেমস বন্ড, মাসুদ রানার গল্পেও বারংবার ফুটে উঠেছে গুপ্তচরবৃত্তির এই বিশেষ দিকটি। কয়েক বছর আগে, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক নিরাপত্তা সংস্থা এমআই৫ শত শত ব্রিটিশ ব্যাংক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১৪ পৃষ্ঠার একটি নথি সরবরাহ করে, যার সারমর্ম হলো- চাইনিজ গোয়েন্দা সংস্থা যৌনতাকে কাজে লাগিয়ে গোপন তথ্য সংগ্রহ করছে, সাধু সাবধান!
ভারতীয় সেই বিমান বাহিনী অফিসার ধরা পড়ার পর থেকে অনলাইন জগতে ফেক বা ভুয়া অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে ভারত সরকার। তরুণ অফিসাররা যেন এই প্রতারণার শিকার না হয়, সেজন্য ইন্টারনেট দুনিয়ায় কড়া নজরদারি জারি রাখা হয়েছে। তবে ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এ কথা অবিশ্বাস করার কোনো উপায় কিন্তু সত্যিই নেই যে, গোটা পৃথিবী মজে আছে হানি ট্র্যাপের মনোমুগ্ধকর ফাঁদে। চলুন তবে দেখে আসা যাক দুনিয়া কাঁপানো কিছু মধুর ফাঁদের গল্প।
মাতা হারি, যার মধুর ফাঁদে মাতোয়ারা ছিল গোটা প্যারিস
এসপিওনাজের জগতে খুব জনপ্রিয়, সেটা কুখ্যাত হোক কিংবা বিখ্যাত, একটি নাম মাতা হারি। ডাচ এই বারবণিতার কথা কে না জানে? বিংশ শতাব্দীতে স্বল্পবসনা নাচকে ধর্মীয় আচারের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এই নারী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে স্পেন থেকে ইংল্যান্ডে ঘুরতে পারতেন অনায়াসে। জার্মানির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে ফ্রান্সের পুলিশ। স্পেনে বসবাসরত এক জার্মান রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের প্রমাণ স্বরূপ একটি টেলিগ্রাম জব্দ করে তারা। ঐ রাষ্ট্রদূতের কথা অনুযায়ী কাজ করছিল মাতা হারি, এক টেলিগ্রাম থেকেই উপসংহারে চলে আসে ফ্রেঞ্চ কর্তৃপক্ষ। প্যারিসে বসে রাজনীতিবিদ আর কূটনৈতিক ব্যক্তিদের মনোরঞ্জন করে মাতা হারি গোপন সব তথ্য হাতিয়ে ঐ দূতকে পাচার করছিল বলে অবলীলায় প্রমাণ করে তারা।
প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সেরই এক গোয়েন্দা অফিসার ক্যাপ্টেন গিওর্গি জোরপূর্বক মাতা হারিকে বাধ্য করে গোয়েন্দাগিরি করতে। কোনো রকম সাক্ষ্যপ্রমাণের বালাই ছাড়াই ১৯১৭ সালে মাতা হারিকে দাঁড় করানো হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে। চোখে কালো কাপড় বাঁধতেও অস্বীকৃতি জানান তিনি। তার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৫০ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে, এমন একটি তথ্য প্রচলিত থাকলেও তা গুজব না আদতে সত্যি তা জানার উপায় নেই। তবে জার্মানি, ফ্রান্স সহ তৎকালীন বিশ্বের বেশ বাঘা বাঘা নেতাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য মধুর ফাঁদ তিনি পেতেছিলেন, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। এজন্য মাতা হারিকে অনেকে ‘হানি ট্র্যাপের জননী’ বলে আখ্যায়িত করেন।
ক্রিস্টিন কিলারের সাথে প্রফুমোর কেলেঙ্কারি
১৯৬০ এর দশকে ব্রিটেনকে কাঁপিয়ে দেয়া এক কেলেঙ্কারির অনবদ্য উপাদানগুলো ছিল- হাই প্রোফাইল এক রাজনীতিবিদ, তার সুন্দরী স্ত্রী, মায়াবিনী কুহকিনী এক নারী হিসেবে যার খ্যাতি/কুখ্যাতি উভয়ই ছিল। ১৯৬৩ সালের শুরুর দিকে হ্যারল্ড ম্যাকমিলান সরকারের আমলে ব্রিটিশ সংসদ সদস্য এবং যুদ্ধকালীন রাজ্য সচিব জন প্রফুমোর সাথে ১৯ বছর বয়সী ক্রিস্টিন কিলারের প্রণয়ের সম্পর্ক চলছে, এ খবর চতুর্দিকে চাউর হয়ে যায়। সে নাহয় হলো, ঘাপলাটা বাঁধে ঠিক সে সময় যখন জানা যায় ক্রিস্টিন ইয়েভগনি ইভানভের সাথেও ঘনিষ্ঠ ছিল, যিনি কি না সোভিয়েত নৌবাহিনীর বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করছিলেন। ব্রিটিশ এই আইটি গার্লকে মিডিয়া ইভানভের উপপত্নী বলে প্রচার করতেও কার্পণ্যবোধ করেনি। প্রণয় আর রক্ষিতার সম্পর্কের জালে ফেঁসে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়ে যায় ক্রিস্টিন।
ধারণা করা হয়, ক্রিস্টিনের হাত ধরে প্রফুমোর কাছ থেকে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সোভিয়েত রাশিয়ার কানে চলে আসে। ফলাফল, রাজনৈতিক জীবন নিয়ে রীতিমতো যুঝতে শুরু করে প্রফুমো। শেষতক উপায়ান্তর না দেখে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করেন তিনি। এদিক-ওদিক করে গুপ্তচর হিসেবে ক্যারিয়ারে আরও কিছু প্রাপ্তি যোগ করতে ব্যর্থ হয়ে ফটোগ্রাফের মডেল হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ক্রিস্টিন। এরপর চলচ্চিত্র জগতে পা রাখার পাঁয়তারা করতে গিয়ে আবারও ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে ধীরে ধীরে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় এক সময়কার দুর্ধর্ষ এসপিওনাজ ক্রিস্টিন কিলার।
গরশকোভ রহস্য
আবারও হানি ট্র্যাপ, আবারও রাশিয়া। আকাশযান কেন্দ্রিক বাণিজ্যকে ঘিরে বছরের পর বছর ধরে রাশিয়া বনাম ভারত স্নায়ুযুদ্ধ লেগেই ছিল। পুরো অবস্থা আরও নাজুক করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখে অ্যাডমিরাল গরশকোভ নামক একটি রণতরী। কমোডোর সুখজিন্দর সিংয়ের সাথে রাশিয়ান এক নারীর প্রণয়ের সম্পর্কের মিথ্যা রটনা রটিয়ে ২০০৫-২০০৭ সাল পর্যন্ত তামাম নৌবাহিনীর মাথা খারাপ করে ফেলেছিল রাশিয়ানরা। তাদের এই অভিযোগ শুনে সত্যি সত্যি সুখজিন্দর সিংকে অভিযুক্ত করে ভারতীয় নৌবাহিনী। তবে নেভি কর্মকর্তারা পরবর্তীতে এ কথা স্বীকার করেন যে, স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে এই প্রেমের সম্পর্ক কোনো প্রভাব ফেলেনি।
সে যা-ই হোক, দিনশেষে অবশ্য ভারতের এসব শুকনো কথায় চিড়ে ভেজেনি। ৯৭৪ মিলিয়ন ডলারের পরিবর্তে ২.৩৩ বিলিয়ন ডলার দিয়ে অ্যাডমিরাল গরশকোভকে ঘরে তুলে সে দফা ঝামেলা থেকে পরিত্রাণ মেলে ভারতের। ছেলেরাও যে হানি ট্র্যাপে ফেলতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে অ্যাডমিরাল গরশকোভের এই ঘটনাটি। শেষপর্যন্ত চাকরি চলে যায় সুখজিন্দর সিংয়ের।
আনা চ্যাপম্যান, ভাগ্যহত এক এসপিওনাজের কথা
হয় রাশিয়ার এসপিওনাজরা এতটাই দুর্ধর্ষ যে তাদের বাদ দিয়ে অন্য কারো কথা লেখা যায় না, নাহয় তারা এত বেশি ধরা পড়ে যে তাদের বাদে অন্য কারো কথা জানা যায় না। ২০১০ সালে নিউ ইয়র্কে বসবাসরত আনা চ্যাপম্যান নামক এক রাশিয়ান নারী গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে গ্রেপ্তার হন। মস্কো শহরে জন্ম নেয়া এই নারী নাম-পরিচয় পরিবর্তন করে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব অর্জন করে নাইটক্লাব আর নামীদামী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হানি ট্র্যাপ ফেঁদে বেড়াতেন। ধারণা করা হয়, আনা ছিলেন রাশিয়ান এক স্পাই রিংয়ের সদস্য যাদের প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ‘নীতি নির্ধারণী নীতিমালা’ জেনে ব্ল্যাকমেইল করা। এই ফাঁদের হাত থেকে বাদ পড়েনি সরকারি নানা অধিদপ্তরও।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আনা তার শারীরিক সৌন্দর্য ব্যবহার করে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করতেন। ওবামা সরকারের এক উচ্চপদস্থ কেবিনেট কর্মকর্তাও তার জালে ধরা পড়েছিলেন বলে কথিত আছে। ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাশিয়ায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয় আনাকে। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে একপ্রকার তারকা বনে যান তিনি। টেলিভিশন শো উপস্থাপনা করা থেকে ম্যাগাজিনের সম্পাদক অলংকৃত করে বেশ ভালোই আছেন আনা চ্যাপম্যান।
ফিচার ইমেজ- wired.com