রিক এন্ড মর্টি, গেম অব থ্রোনস, শারলক, ব্রেকিং ব্যাড, ওয়েস্টওয়ার্ল্ড, ডার্ক; কত শত টিভি সিরিজ! বলতে গেলে এখন টিভি সিরিজের স্বর্ণযুগে বসবাস করছি আমরা। কখনো চিন্তা করেছেন, এত এত এপিসোড সমৃদ্ধ টিভি সিরিজগুলো কীভাবে তৈরি করা হয়? লেখকের পাণ্ডুলিপি থেকে টিভি পর্দা পর্যন্ত আসতে একটি শোর খুবই জটিল ও নিখুঁত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই প্রবন্ধে আমরা টিভি সিরিজ তৈরির বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে আলোচনা করবো।
আমরা সবাই জানি সারা বিশ্বব্যাপী অসংখ্য স্টুডিও রয়েছে, যাদের বাণিজ্যই হচ্ছে টিভি সিরিজ নির্মাণকে কেন্দ্র করে। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, এবিসি, সিবিএস, হুলু হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতনামা স্টুডিওগুলোর একাংশ। প্রচার মাধ্যমের উপর ভিত্তি করে স্টুডিও আবার দু’রকম হতে পারে। ক্যাবল নেটওয়ার্ক এবং অনলাইন স্ট্রিমিং সার্ভিস। আমরা টিভি চালু করলে যে চ্যানেলগুলো দেখি, ওগুলোই ক্যাবল নেটওয়ার্ক। আর স্ট্রিমিং সার্ভিস হচ্ছে নেটফ্লিক্স, আইফ্লিক্সের মতো সার্ভিস, যাদের প্রচারটা শুধুমাত্র অনলাইনেই।
একটি নির্দিষ্ট টিভি সিরিজ তৈরির প্রথম সিদ্ধান্ত নেয় স্টুডিও। তাদের কাছে আসা বিভিন্ন স্ক্রিপ্ট থেকে তারা যাচাই-বাছাই করে ঠিক করে কোন টিভি সিরিজটি তারা তৈরি করবে এবং কোন টিভি সিরিজটি কেমন বাজেটের হবে। এটা ঠিক করার পর তারা বাজেট ও স্ক্রিপ্ট তুলে দেয় একজন শো রানারের হাতে। মাঝে মাঝে অবশ্য উল্টোটাও হয়। শো রানারই স্ক্রিপ্ট নিয়ে স্টুডিওর কাছে যায় এবং তার প্ল্যান বলে স্টুডিওকে রাজি করায় সিরিজটি ফিন্যান্স করার জন্য। মোদ্দা কথা হচ্ছে, শো রানারই হচ্ছে একটি সিরিজের মূল স্রষ্টা।
প্রায়সময়ই এমন হয়, স্টুডিওর পক্ষ থেকে শো রানারকে বলা হয় সিরিজের প্রথম এপিসোডটি তৈরি করে দেখাতে। এটিকে বলা হয় পাইলট এপিসোড। পাইলট এপিসোড যদি টিভিতে সম্প্রচারের পর ভালো রেটিং পায় এবং স্টুডিওকে সন্তুষ্ট করতে পারে তাহলে স্টুডিও পুরো সিজন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়।
এখন মনে করুন আপনি হচ্ছেন একটি সিরিজের শো রানার। যেই সিরিজটি আপনার হাতে তুলে দিয়েছে স্টুডিও, সেটি একটি ড্রামা সিরিজ। প্রতি সিজনে এপিসোড হবে ১৩টি করে। প্রতিটি এপিসোডের দৈর্ঘ্য ধরুন ৫০ মিনিট। স্টুডিও কিন্তু আপনাকে রাজ্যের সময় দেবে না একটা সিজন ফিল্মিংয়ের জন্য। স্টুডিওর অর্থ ব্যবস্থাপনা, কাস্টদের টাইম-শিডিউল সবমিলিয়ে খুবই অল্পসময় পাবেন পুরো সিজন শ্যুট করার জন্য। দেখা যায় ১৩ এপিসোডের একটা সিরিজের পুরো সিজন শ্যুট করতে যে টাইম লাগে, একটি ব্লক বাস্টার ফিল্ম তৈরি করতে এরচেয়ে বেশি সময় লাগে।
সুতরাং শো রানার হিসেবে আপনার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সময় ও দায়িত্ব বণ্টন। শুরুতেই আপনি পুরো সিজনকে নিয়ে একটি নীল নকশা করবেন। বিস্তারিত পরিকল্পনা করবেন। কোন এপিসোড কে পরিচালনা করবে, কোন অংশ শ্যুট করতে কেমন টাইম লাগবে, গল্পের কোথায় ক্লাইম্যাক্স থাকবে, কোথায় কোন চরিত্র প্রবেশ করবে বা মারা যাবে সব ঠিক করবেন। পরিকল্পনার এই পুরো অংশকে বলা হয় প্রি-প্রোডাকশন।
প্রি-প্রোডাকশন
গল্পের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো শো রানারই ঠিক করে দেয়। সে অনুযায়ী স্ক্রিপ্ট লিখে চিত্রনাট্যকাররা। সিজনের সব এপিসোড চাইলে শো রানার পরিচালনা করতে পারেন। আবার চাইলে কিছু এপিসোড অন্য পরিচালকদের দ্বারাও পরিচালনা করাতে পারেন।
চিত্রনাট্যকারদের কাহিনী বুঝিয়ে দেয়ার পর তারা পুরো সিজনের সব এপিসোডের স্ক্রিপ্ট এনে আপনার কাছে জমা দিবে। ৫০ মিনিটের একটি এপিসোডের স্ক্রিপ্ট হবে প্রায় ৪০ পৃষ্ঠার মতো, যার মানে পুরো সিজনের স্ক্রিপ্ট হবে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার মতো। তখন আপনি প্রতি এপিসোডের স্ক্রিপ্ট পাঠিয়ে দিবেন পরিচালক ও চিত্র পরিচালকের কাছে। তারা প্রতি এপিসোড নিয়ে তৎক্ষণাৎ পরিকল্পনা করা শুরু করবে। আর সাথে থাকবে আর্ট ডিপার্টমেন্ট। এখানে আর্ট ডিপার্টমেন্টের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধরি, এই সিরিজের গল্প রচিত হয়েছে ষাটের দশকের ঢাকাকে কেন্দ্র করে। আর্ট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব হচ্ছে ওই সময়ের সবকিছু নিয়ে গবেষণা করা। তখন মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ কেমন ছিল, তখনকার বিল্ডিং, রাস্তাঘাট কেমন ছিল। এরকম বড় বিষয় থেকে শুরু করে তখন কী কী পত্রিকা-ম্যাগাজিন প্রচলিত ছিল, এমনকি মানুষ কেমন ঘড়ি, জুয়েলারি পরিধান করতো, সেসব নিয়েও বিস্তর গবেষণা করবে আর্ট ডিপার্টমেন্ট। তাদের গবেষণার ভিত্তিতে সাজানো হবে সেট, ডিজাইন করা হবে কস্টিউম।
প্রোডাকশন
এবার হচ্ছে সিরিজের প্রধান অংশ- শ্যুটিং। ৪০ পৃষ্ঠার স্ক্রিপ্ট ৮ দিনের মধ্যে শ্যুট করার জন্য আপনার দরকার একটি ‘টাইট শিডিউল’। কোনদিন কোথায় কোন অংশের শ্যুটিং হবে, কোন দিন কোন অভিনেতাকে লাগবে সব বিস্তারিত পরিকল্পনাতে থাকতে হবে। পরিচালক প্রতিটি দৃশ্যের বিস্তারিত পরিকল্পনা করে নেবেন। প্রতিটি দৃশ্য কোন স্থানে শ্যুট হবে, দিনের কোন সময়ে শ্যুট হবে এবং কোন কোন অভিনেতা এতে অভিনয় করবেন। প্রতিটি দৃশ্যের এই বিস্তর পরিকল্পনার নথিকে বলা হয় ‘হোয়াইট শিডিউল’। শ্যুটিং শুরুর আগে সিরিজের সাথে সম্পর্কিত সবাইকেই হোয়াইট শিডিউলের একটি কপি পাঠিয়ে দেবেন আপনি।
শ্যুটিং শুরুর আগে সব অভিনেতারা একসাথে একটি বড় টেবিলে বসবে এবং পুরো স্ক্রিপ্ট প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে শেষ করবে। এটাকে বলা হয় ‘টেবিল রিড’। এই সময় পরিচালক চিত্রপরিচালকের সাথে মিলে পরিকল্পনা করবেন আজকের দৃশ্যগুলো কীভাবে শ্যুট করবেন। প্রতিটি দৃশ্য কীভাবে ক্যামেরাবন্দি করা হবে, কোন চরিত্রকে কীভাবে কোন কোণ থেকে দেখানো হবে, সব ঠিক করবেন। এক মিনিটের একটি দৃশ্য শ্যুট করতেও কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যেতে পারে।
পোস্ট প্রোডাকশন
পোস্ট প্রোডাকশন একটি সিরিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আপনার সুচারু-শৈল্পিক মহা-পরিশ্রমের কাজ নষ্ট করে পোস্ট প্রোডাকশনের আনাড়িপনা। পোস্ট প্রোডাকশন টিমের কাজের গুণগত মানের উপর আপনার সিরিজের সার্বিক মান নির্ভর করবে।
পোস্ট প্রোডাকশন টিম আবার তিন ভাগে বিভক্ত। এডিটর, সাউন্ড ডিজাইনার, ভিজুয়াল ইফেক্ট আর্টিস্ট। ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট আর্টিস্টদের দায়িত্ব হচ্ছে শ্যুটিংয়ে নেয়া কোনো দৃশ্যে আংশিক ত্রুটি থাকলে, তা ঠিক করে দেওয়া।
সাউন্ড ডিজাইনারের কাজ হচ্ছে সাউন্ড এডিট করা, ভয়েস মসৃণ করা, ডাবিং ঠিকঠাক বসানো।
এডিটরকে করতে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ৫০ মিনিটের এপিসোডের জন্য ক্যামেরায় ধারণ করা অংশ কয়েক ঘণ্টারও হতে পারে। আপনি নিশ্চই জানেন, পরিচালক নিখুঁত দৃশ্যায়নের জন্য একটি দৃশ্য অনেকবার শ্যুট করতে পারে। অনেকগুলো টেক থেকে তাই সবচেয়ে নিখুঁত টেকটি বেছে নেয়াটাই এডিটরের দায়িত্ব। এছাড়া বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় অংশ এবং সময় সংকুলানের জন্য মাঝে মাঝে কিছু কম প্রয়োজনীয় অংশও কেটে-ছেঁটে ফাইনাল ৫০ মিনিটের এপিসোড দাঁড় করাবেন এডিটর। এডিটর এডিট করার পর ৫০ মিনিটের যে এপিসোড দাঁড় করাবেন, সেটা হচ্ছে ‘এডিটরস কাট’ (editor’s cut)। সেটি তখন চলে যাবে পরিচালকের কাছে। পরিচালক সেখানে নিজের মনমতো কিছু পরিবর্তন আনবেন। পরিচালক কর্তৃক স্বীকৃত এই কাটকে বলা হয় ‘ডিরেক্টরস কাট’ (director’s cut)। ডিরেক্টরস কাটটি তখন চলে যাবে শো রানারের কাছে। শো রানার দেখবেন, এই এপিসোডে তার ভিশন বাস্তবায়িত হয়েছে কি না। তিনিও কোনো পরিবর্তন আনার থাকলে আনবেন। তার কাটটিকে বলা হয় ‘প্রডিউসারস কাট’ (producer’s cut)। এই প্রডিউসারস কাটই এরপর স্টুডিওতে পৌঁছবে, যাকে তখন বলা হবে ‘নেটওয়ার্কস কাট’ (network’s cut)। নেটওয়ার্কস কাটই সর্বশেষ কাট, যা সম্প্রচারের জন্য পাঠানো হয়।
যেই পুরো প্রক্রিয়ার কথা উপরে বলা হলো, তা কিন্তু মাত্র একটি এপিসোডের। বাকি আছে আরো ১২টি এপিসোড। হ্যাঁ, বাকি ১২টি এপিসোডও এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে।
আমরা টিভিতে যত টিভি সিরিজ দেখি, তার অধিকাংশ এপিসোডই সম্পন্ন হয় সম্প্রচারের মাত্র কয়েকদিন আগে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। সুতরাং সিজনের প্রথম এপিসোড দেখার সময়ই ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে বাকিসব এপিসোড ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। অবশ্য নেটফ্লিক্সের বেলায় অন্য হিসেব। আপনি হয়তো জানেন অন্য স্টুডিওদের মত সপ্তাহে সপ্তাহে একটি এপিসোড সম্প্রচার না করে নেটফ্লিক্স পুরো সিজনের সব এপিসোড একসাথে রিলিজ করে।
ফিচার ইমেজ- TrendLeakers