ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে অনেকেই একটি অভিযোগ করে থাকেন যে, এখানে ভ্রমণ করা নাকি অনেক বেশি ব্যয়বহুল। আসলেই তা-ই। পুরো পরিবারের সাথে সেখানে ছুটি কাটাতে চাইলে আপানার হাজারখানেক ডলার তো পকেট থেকে খসবেই, বিশেষ করে আপনি যদি ডিজনির নিজস্ব হোটেলগুলোর কোনো একটিতে থাকতে চান।
এই অভিযোগটি যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও সত্য যে ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডকে সচল রাখতে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। এই স্বপ্নরাজ্যে ষাট হাজারের ওপর মানুষ বিভিন্ন খাতে কর্মরত আছে। গত চার দশক ধরে ধীরে ধীরে এই বিশাল মোহময় জগত গড়ে তুলতে এ পর্যন্ত কয়েক বিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হয়ে গেছে। এমন না যে, বেশিরভাগ অর্থই বিভিন্ন রাইড এবং স্থাপনা তৈরিতে ব্যয় করা হয়েছে। বরং এর একটি বড় অংশই খরচ হয়েছে ডিজনিল্যান্ডের মধ্যকার পাওয়ার সিস্টেম, ড্রেনেজ সিস্টেম, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। অবশ্য এসব ব্যবস্থার অধিকাংশই দর্শনার্থীদের দৃষ্টির বাইরে রাখা হয়েছে, তাই চট করে চোখে পড়ে না।
ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডের এরকম নয়টি ব্যয়বহুল ব্যবস্থা নিয়েই আজকের এই লেখা।
৯. ড্রেনেজ সিস্টেম
বর্তমানে যারা ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড ভ্রমণে যান তাদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, এই ডিজনি ওয়ার্ল্ড গড়ে উঠেছে একরের পর একর ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে এবং জলাময় ভূমির ওপর। ১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে যখন এর নির্মাণকাজ শুরু হয় তখন এই ধরনের একটি জলাভূমির ওপর এত বিশালাকার একটি পার্ক গড়ে তোলা ডিজনি কর্তৃপক্ষের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তার ওপর ফ্লোরিডায়, যার চারদিকে বিশুদ্ধ পানির প্রচুর জলাশয় রয়েছে, সেখানে একটি বড় ধরনের ড্রেনেজ সিস্টেম আশেপাশের পানিকে দূষিত করে ফেলতে পারত।
এই ধরনের সমস্যার সমাধানে ডিজনি ওয়ার্ল্ড থেকে ৫০ মাইলের অধিক দৈর্ঘের ক্যানাল (Canal) বা খাল এবং বাঁধ তৈরি করা হয়। এসব ক্যানালে ওয়াটারগেট বা জলকপাট বসানো হয়। ওয়াটারগেটগুলো ক্যানালে পানির উচ্চতা অনুযায়ী খুলতে বা বন্ধ হতে পারে। এই ক্যানালগুলো অবশ্য মাটির নিচ দিয়ে প্রবাহিত না করে বরং এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এগুলোকে দেখে সুদৃশ্য জলাশয়ের মতো মনে হয়।
পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত বেশ ভালো অঙ্কের অর্থই খরচ হয়েছিল এই প্রকল্পে।
৮. আবর্জনা ব্যবস্থাপনা
ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড থিম পার্কের আবর্জনা ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবহৃত Automated Vacuum Assisted Collection System (AVAC) গোটা ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড রিসোর্টের মধ্যেই সেরা। সুইডেনে তৈরি এই AVAC টেকনোলজিতে কম্প্রেসড বাতাস ব্যবহার করে প্রায় ৬০ মাইল/সেকেন্ড বেগে সমস্ত আবর্জনাকে একটি কেন্দ্রীয় আবর্জনা সংগ্রহালয় ভবনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে এসব আবর্জনার বেশিরভাগই রিসাইকেল করা হয় এবং বাকিগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়।
AVAC ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সমস্ত পার্ক জুড়েই বেশ কিছু ডাস্টবিন রাখা আছে। এসব ডাস্টবিনের ভেতর রয়েছে ২০ ইঞ্চি ব্যাসের একটি করে টিউব, যা একটি ভ্যাকুয়ামের সাথে যুক্ত। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আবর্জনা এসব ডাস্টবিনে জমা হলে তা ভ্যাকুয়ামের সাহায্যে টিউবের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সংগ্রহালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
ডিজনি ওয়ার্ল্ডে AVAC ছাড়াও আরও বিভিন্ন পদ্ধতির আবর্জনা সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু আছে। প্রতিবছর এই রিসোর্টে প্রায় চব্বিশ হাজার টন অ্যালুমিনিয়াম, কাগজ, ক্যান, কার্ডবোর্ড, খাদ্যের উচ্ছিষ্ট ইত্যাদি আবর্জনা রিসাইকেল করা হয়।
৭. কন্ট্রোল সিস্টেম
সিন্ডারেলা ক্যাসলের নিচে অবস্থিত ডিজিটাল এনিমেশন কন্ট্রোল সিস্টেম (DACS) হোল এমন একটি কম্পিউটার সিস্টেম যা কিনা ম্যাজিক কিংডমের সকল কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। ম্যাজিক কিংডমের লাইটিং সিস্টেম, স্টেজের পর্দার ওঠা-নামা, অগ্নি নির্বপন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পাওয়ার সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে এই DACS. এছাড়াও শ’খানেক অডিও-এনিমেট্রনিক্সের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও রয়েছে এই কন্ট্রোল সিস্টেরমের ওপর।
১৯৮২ সালে যখন ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডের দ্বিতীয় থিম পার্ক ‘এপকোট সেন্টার (EPCOT Center)’ গড়ে তোলা হয়, তখন সেখানেও ‘এপকোট কম্পিউটার সেন্ট্রাল’ নামে একটি ব্যয়বহুল কন্ট্রোল সিস্টেম গড়ে তোলা হয়। পার্কের প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে এই সিস্টেম।
প্রায় একই ধরনের ব্যয়বহুল কন্ট্রোল সিস্টেম দেখতে পাওয়া যায় ডিজনির হলিউড স্টুডিও এবং ডিজনি এনিম্যাল কিংডমেও।
৬. পাওয়ার সিস্টেম
বর্তমান সময়ে ইলেক্ট্রিসিটির গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডকে সচল রাখতেও প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ ইলেক্ট্রিক পাওয়ারের। বিদ্যুতের এই চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে তৈরি করা হয়েছে নিজস্ব একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট। অবশ্য এই প্ল্যান্ট পুরো রিসোর্টের চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়, বাইরে থেকেও বিদ্যুৎ কিনতে হয় ডিজনি কর্তৃপক্ষকে। তবে নিজস্ব পাওয়ার প্ল্যান্ট থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো যেকোনো দুর্যোগের সময় শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলেও ডিজনি ওয়ার্ল্ড থাকে সচল। ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডের এই পাওয়ার প্ল্যান্ট পঞ্চান্ন হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম।
নয়টি সাবস্টেশন এবং একটি বিশালাকার আন্ডারগ্রাউন্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম নিয়ে এই প্ল্যান্টের ট্রান্সমিশন সিস্টেম গঠিত। ডিজনি ওয়ার্ল্ডের এই পাওয়ার প্ল্যান্টটি গ্যাস দ্বারা চালিত। এসব গ্যাস ফ্লোরিডা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজনি ওয়ার্ল্ডের নিজস্ব গ্যাস সিস্টেমে নিয়ে আসা হয়।
৫. দূষিত পানি শোধনাগার
প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মানুষ ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড রিসোর্ট ভ্রমণে আসে। এসব দর্শনার্থী এবং রিসোর্টের কর্মচারীদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন সময়ে, যেমন- প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে, হাত-মুখ ধুতে, গোসল করতে ইত্যাদি কাজে পানি ব্যবহার করে থাকেন। এর ফলে যে বিপুল পরিমাণ দূষিত পানি জমে যায় সেসবের একটা ব্যবস্থা করা জরুরি। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ডিজনি ওয়ার্ল্ডের রয়েছে একটি নিজস্ব পানি শোধনাগার।
ডিজনি ওয়ার্ল্ডের এই পানি শোধনাগার প্রতিদিন প্রায় ১৫ মিলিয়ন গ্যালন পানি শোধন করতে পারে। এসব পানি যদিও পুনরায় পান করার যোগ্য হয়ে যায়, কিন্তু তা না করে বরং সেগুলো ব্যবহার করা হয় ডিজনি ওয়ার্ল্ডের গলফ মাঠ এবং বিভিন্ন গাছপালায় পানি দেয়ার কাজে।
৪. পানি সরবরাহ ব্যবস্থা
ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডকে সজীব রাখতে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয়। বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণে নিজস্ব পানি শোধনাগার ছাড়াও বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে এই রিসোর্টে। ফ্লোরিডান অ্যাকুইফারের (ভূগর্ভস্থ যে শিলাস্তরে পানি জমে থাকে) ১১টি কূপ থেকে এবং চারটি পাম্প স্টেশন থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০ মিলিয়ন গ্যালন পানি সরবরাহ করা হয় ডিজনি রিসোর্টে। এছাড়া ভূমির ওপরে থাকা পাঁচটি বিশালাকার পানির ট্যাঙ্ক থেকেও ৭.৯৫ মিলিয়ন গ্যালন বিশুদ্ধ পানির যোগান পায় ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডে।
রিসোর্টের এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেমকে সচল রাখতে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণে কনকনে ঠান্ডা পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। সে উদ্দেশ্যে ডিজনি রিসোর্টে রয়েছে ২২টি সেন্ট্রিফিউগাল চিলার (পানি থেকে তাপ অপসারণের যন্ত্র)। অন্যদিকে পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপন্ন অতিরিক্ত তাপ ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ মিলিয়ন গ্যালন গরম পানি সরবরাহ করা হয় রিসোর্টের বিভিন্ন কাজে।
৩. সেন্ট্রাল শপ
ফ্লোরিডায় যখন প্রথমবারের মতো ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড প্রতিষ্ঠিত হলো তখন সমগ্র ফ্লোরিডা জুড়ে এই রিসোর্ট পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের ছিল বড়ই অভাব। তাই ডিজনি কর্তৃপক্ষ রিসোর্টের কেন্দ্রে একটি সেন্ট্রাল শপ তৈরি করল যেখানে রিসোর্ট চালনার যাবতীয় উপকরণ থেকে শুরু করে দক্ষ লোকবল সবই থাকবে। এই সেন্ট্রাল শপের অবস্থান ম্যাজিক কিংডমের উত্তর দিকে।
ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডের ৪,০০০ রাইড, ১,৫০০ এনিমেট্রনিক্স, ৫০০ এর মতো এনিমেটেড চরিত্রের সাজসজ্জার যাবতীয় বিষয় দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে এই সেন্ট্রাল শপ। এটি পরিচালনায় ডিজনি কর্তৃপক্ষের প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ অর্থের খরচ হয়।
২. লন্ড্রি সার্ভিস
ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ডে প্রতিদিন প্রায় ২,৫০০ এর মতো অভিনেতা বিভিন্ন কার্টুন চরিত্র সেজে মানুষকে বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে। এসব কার্টুন চরিত্রকে রূপদানের জন্য প্রায় ১.৮ মিলিয়ন টুকরা কাপড় প্রয়োজন হয়। প্রতিবছর প্রায় ১৩,০০০ এর মতো নতুন কাপড় তৈরি করতে হয়। শুধুমাত্র মিকি-মাউসেরই রয়েছে ৩০০টি ভিন্ন ধরনের সাজসজ্জা এবং মিনি-মাউসের রয়েছে ২০০টি।
প্রতিনিয়ত এই বিপুল পরিমাণ কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থাপনা করতে ডিজনি ওয়ার্ল্ড যে লন্ড্রি সার্ভিস চালু করে, তা এই রিসোর্টের যাত্রা শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
১. ট্রি ফার্ম
পানি শোধনাগারের থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ডিজনি ওয়ার্ল্ডের এই ট্রি ফার্ম যেন গাছপালার স্বর্গরাজ্য। এখানে কাজ করেন অসাধারণ কয়েকজন উদ্যান বিশেষজ্ঞ (হর্টিকালচারিস্ট)। এই ট্রি ফার্মে রয়েছে পৃথিবীর সকল মহাদেশ থেকে (এন্টার্কটিকা বাদে) নিয়ে আসা বিস্ময়কর সব গাছপালা।
এছাড়া ডিজনি রিসোর্টের এপকোট থিম পার্কে রয়েছে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বর্গ ফুটের গ্রিন হাউজ প্রকল্প। রিসোর্টের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে যেসব ফলমূল, সবজি পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই এই গ্রিন হাউজ প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা হয়।
উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করে নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয় এসব ট্রি ফার্মে। হাইড্রোপনিক্স নামক একধরনের পদ্ধতিতে মাটির কোনো স্পর্শ ছাড়াই শুধুমাত্র পানি এবং বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের সাহায্যে উদ্ভিদ জন্মানো হয় ডিজনির ফার্মে। ডিজনি কর্তৃপক্ষ আরও উৎপন্ন করেছে মিকি মাউস আকৃতির মিষ্টি কুমড়া। এছাড়াও ডিজনির ফার্মেই উৎপন্ন হয়েছিল ১৫.০৫ পাউন্ডের একটি লেবু।
গাছপালা নিয়ে এত ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও প্রতিবছর একটি বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয় ডিজনি কর্তৃপক্ষকে।