১
চলচ্চিত্র কিংবা টেলিভিশন মিডিয়াতে জুটি বলে একটা শব্দ প্রচলিত আছে। নাটক কিংবা সিনেমায় নায়ক এবং নায়িকা চরিত্র থাকে। কোনো কারণে কোনো নায়ক-নায়িকার অনস্ক্রিন রসায়ন যদি দর্শকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তখনই পরিচালক তাদের নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করা শুরু করে। যেহেতু মিডিয়ার বেশিরভাগ অনুষ্ঠান নির্মিতই হয় দর্শকদের চাহিদার কথা ভেবে, তাই তাদের ভালো লাগার কথা চিন্তা করেই যুগে যুগে দর্শক প্রিয় নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে কাজ করা হয়েছে। প্রচলিত অর্থে ‘নায়ক-নায়িকার’ এই একত্রে কাজ করার বিষয়টাই জুটি নামে পরিচিত।
বাংলাদেশে প্রতি যুগেই জুটি প্রথা চালু ছিল। সিনেমাতে নাদিম-শবনম, আজিম-সুজাতা, আলমগীর-শাবানা, রাজ্জাক-কবরী, ববিতা-জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু ঘোষ, নাঈম- শাবনাজ, সালমান-শাবনুর কিংবা বর্তমানের শাকিব-অপু ছাড়াও ছোটখাটো আরো কিছু জুটি কাজ করে গিয়েছে। নাটকের কথা বিবেচনা করলে সেখানেও দর্শকেরা অনেক জুটি দেখেছে। আবদুল্লাহ আল মামুন–ফেরদৌসী মজুমদার, পীযুষ-আফরোজা, মানস-ফাল্গুনী, আল মনসুর-মিতানুর, আফজাল- সুবর্ণা, ফরিদী-সুবর্ণা, জাহিদ-শমী, বিপাশা-তৌকীর, সেলিম-মিমি, মাহফুজ-তারিন, হাকিম-শমী কিংবা বর্তমানের অপূর্ব-মেহজাবিন আর তাহসান-তিশার জুটিগুলো দর্শকপ্রিয়।
তবে সবদিক বিবেচনা করে যদি বাংলাদেশের সেরা জুটি নির্বাচন করা হয়, তাহলে সবাইকে ছাপিয়ে নিঃসন্দেহে এগিয়ে আসবে রাজ্জাক-কবরী এবং আফজাল-সুবর্ণা জুটি দুটি। এমনকি বিবেচনাটা যদি সমগ্র উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটেও বিবেচনা করা হয় তাহলেও এক উত্তম-সুচিত্রা বাদে আর কোনো জুটি সম্ভবত এই দুই জুটিকে টেক্কা দিতে পারবে না।
এই সেরা তিন জুটির মাঝে আফজাল-সুবর্ণা টিভি মিডিয়ার হওয়ায় নিশ্চিতভাবেই একটু বাড়তি কৃতিত্ব দাবি করে। ৭০ এর দশকে এই জুটির কাজ শুরু হলেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে ৮০ এর দশকে। সেই জনপ্রিয়তা এখনও মানুষকে নষ্টালজিক করে তোলে। এমনকি এই মুহূর্তেও আফজাল-সুবর্ণা জুটি নিয়ে নাটক তৈরী হয় এবং সেটিতে আগের প্রজন্মের দর্শকদের সাথে সাথে বর্তমান প্রজন্মের দর্শকদেরও আগ্রহ লক্ষ করা যায়।
আজ আমরা জানবো সেই কালজয়ী জুটির সুবর্ণা মুস্তাফার গল্প।
২
সাংস্কৃতিক পরিবারেই জন্ম তার, ১৯৫৯ সালের ২রা ডিসেম্বর ঢাকাতেই জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম মুস্তাফা ছিলেন একজন সুবিখ্যাত অভিনেতা, যিনি ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ সিনেমায় অভিনয় করার জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। মা হোসনে আরা মুস্তাফা কলকাতা থেকে কলেজ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। একসময় কলকাতা রেডিওতে কাজ করতেন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের রেডিওতেও কাজ করেছেন প্রযোজক হিসেবে। চমৎকার আবৃত্তি করতেন, মঞ্চেও অভিনয় করতেন। সেই সময়টাতে মেয়েদের অভিনয় এতটা সহজ বিষয় ছিল না। তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেরা মেয়ে সেজে মঞ্চে অভিনয় করতেন। টিভির জন্য নাটক লিখেছেন অসংখ্য। ‘আকাশ কুসুম’ নাটকে সুবর্ণা নিজেও অভিনয় করেছেন।
অবশ্য তার মিডিয়াতে কাজ শুরু অনেক ছোট বয়সেই। মায়ের হাত ধরে ৫/৬ বছর বয়সেই বেতারে কাজ করা শুরু হয়ে গিয়েছে। এছাড়া ১৯৭১ সালের আগপর্যন্ত শিশু শিল্পী হিসেবে তিনি টেলিভিশনেও নিয়মিত ছিলেন। তবে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে ‘বরফ গলা নদী’তে অভিনয় দিয়ে টেলিভিশনে আবার যাত্রা শুরু। প্রখ্যাত অভিনেতা-নির্দেশক আবদুল্লাহ আল মামুনের অনুরোধ মুস্তাফা পরিবার ফেলতে পারেননি। এর পরপরই টেলিভিশনে আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশনাতেই করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি নাটক। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে আল মনসুরের প্রস্তাবে বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসব এ ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ এ অভিনয় করেন।
তখনও তিনি ভিকারুন্নেসা স্কুলের গণ্ডি পার করেননি।
ধীরে ধীরে টেলিভিশনে জনপ্রিয়তা পেতে থাকলেন। একই সময় আফজাল-সুবর্ণা জুটিটিও জনপ্রিয় হতে থাকলো। দর্শকেরা পর্দায় তাদেরকে একসাথে দেখতে পছন্দ করতো। আফজাল-সুবর্ণার অনেক নাটকই জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে ‘পারলে না রুমকি’ নাটকটি বাংলাদেশের টিভি নাটকে একটা নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছিল। একটা সময় সুবর্ণা মুস্তাফা, হুমায়ুন ফরিদীর সাথে জুটি বেঁধে নাটক করা শুরু করেন এবং সেই জুটিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায়। এরই মাঝে হলিক্রস কলেজের সীমানা পার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে অনার্সে পড়াশোনাটাও চলছে।
৮০’র দশকের শেষের দিকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হুমায়ুন ফরিদীর সাথে বিয়ের মঞ্চে বসেন সুবর্ণা মুস্তাফা। যদিও সবাই ধারণা করেছিলেন যে পর্দার মতো বাস্তবেও আফজাল-সুবর্ণা জুটি বাঁধবেন।
টেলিভিশনের অনেক কালজয়ী নাটকের সাথেই সুবর্ণা জড়িয়ে ছিলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক ধরা হয় যে ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটিকে, সেটির রচয়িতা হুমায়ূন আহমেদ সুবর্ণা মুস্তাফাকে বলেছিলেন, যদি মুনা চরিত্রটি সূবর্ণা করতে রাজি থাকেন তাহলেই কেবল তিনি নাটকটি নির্মাণ করবেন।
এছাড়া ‘অয়োময়’, ‘বারো রকম মানুষ’, ‘আজ রবিবার’ ইত্যাদি অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকেও তিনি প্রধান চরিত্রে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে ‘কাছের মানুষ’ এবং ‘ডলস হাউস’ নামের দুটো মেগা ধারাবাহিকেও প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
টেলিভিশনের সাথে সাথে সেই সময়ে মঞ্চেও সমান পারফর্ম করে গিয়েছিলেন সুবর্ণা। টানা ২৫ বছর ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের সাথে।
৩
পরিচালক হিসেবেও সুবর্ণা মুস্তাফা কিছু কাজ করেছেন। এটিএন বাংলার জন্য ‘আকাশ কুসুম’ নামের এক পর্বের একটা নাটক পরিচালনা করেন, যা কি না সেই সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে ‘শূন্য’ নামের আরেকটি এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেন।
বিজ্ঞাপনেও তার মুখর পদচারণা ছিল। ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়ে লাক্স সাবানের মডেল হয়েছিলেন সুবর্ণা।
এগুলো ছাড়া সিনেমা জগতেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। ১৯৮০ সালেই সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকির ‘ঘুড্ডি’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ। অবশ্য কিছুটা অফট্র্যাকের সিনেমা হওয়ায় সেই মুহূর্তে ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। এই প্রসঙ্গে সূবর্ণা মোস্তফার বক্তব্য হচ্ছে,
কিছুদিন আগে সিনেমাটি দেখলাম। খুব ভালো প্রিন্ট আছে। আমার মনে হলো, ঘুড্ডি যদি জাকি ভাই সাহস করে এখন একবার সিনেপ্লেক্সে রিলিজ করেন, আমার মনে হয় লোকজন কিন্তু দেখবে। ছবিটি বোধহয় সময়ের আগে নির্মিত একটি ছবি, অ্যাহেড অব ইটস টাইম। এখন এটি দেখলে দর্শকরা আনন্দ পাবে। সেই পুরনো ঢাকাকে দেখা যাবে।
এরপরই অভিনয় করেন ‘নতুন বউ’ এবং ‘নয়নের আলো’ সিনেমাতে। ‘নতুন বউ’ সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য তিনি পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান। যদিও তিনি সে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
নিয়মিত সিনেমায় অভিনয় না করলেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এর মাঝে ভিন্ন ধারার সিনেমা বাদেও কিছু কিছু মূলধারার সিনেমাতে যেমন ‘পালাবি কোথায়’, ‘কমান্ডার’, ‘অপহরণ’ ইত্যাদিতে তার উপস্থিতি ছিল। চলচ্চিত্রে তার সর্বশেষ উপস্থিতি ছিল ‘গহীন বালুচর’ সিনেমাতে।
বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে অভিনীত ৯৫ ভাগেরও বেশি সিনেমা ব্যবসাসফল হবার পরেও সিনেমায় নিয়মিত না হবার কারণ হিসেবে তিনি বলেন,
সিনেমায় কাজ করা অনেক কঠিন। এত কষ্ট করতে হয়, আমি আমার বাবা গোলাম মুস্তাফাকে দেখেছি, পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন হুমায়ুন ফরীদিকে দেখেছি। লম্বা সময় দিতে হয়। কিন্ত আমার নিজের জন্য সময় দরকার। আমি শর্টকাটে কোনো কাজ করতে পারি না। যেটা করবো, শতভাগ দিয়ে করবো।
এছাড়া একজন ক্রিকেট ফ্যান হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ‘রেডিও ভূমি’তে ধারাভাষ্যকারের কাজটাও করে চলেছেন।
তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তিনি সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্রের নির্বাচক হিসেবেও কাজ করেছেন।
৪
শুধু বিনোদন জগতে নয়, একজন সুনাগরিক হিসেবেও নিজের দায়িত্ব সবসময় পালন করে গিয়েছেন তিনি। ২০১৫-১৬ কর বছরে দেশের হয়ে ‘অভিনেতা/অভিনেত্রী’ শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি কর দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্মাননা পত্র এবং ট্যাক্সকার্ডও পেয়েছেন।
তবে ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে ব্যক্তিগত জীবনটাকে কিছুটা বিতর্কিত করে ফেলেছিলেন। দীর্ঘদিনের সহযাত্রী হুমায়ুন ফরিদীকে ডিভোর্স দেন ২০০৮ সালে। পরবর্তীতে তিনি বিয়ে করেন বদরুল আনাম সৌদকে।
জীবনে এই ছোটখাটো বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও তিনি দর্শকদের কাছে এখনো জনপ্রিয়। অনেকের মতেই বাঙালি নারীর শাশ্বত সৌন্দর্যের মৌন রূপ এবং একইসাথে রহস্যময় ঘরানার সৌন্দর্য তার ভেতর ফুটে ওঠায় তার সৌন্দর্য দর্শকদের কাছে পেয়েছে ‘ক্ল্যাসিকাল’ রূপ।
ইচ্ছে আছে কোনো একসময় চলচ্চিত্র পরিচালনায় আসার। যদি ইচ্ছেটা পূরণ হয় এবং ব্যক্তি সুবর্ণা মুস্তাফার মতো সেই চলচ্চিত্রটিও কালজয়ী হয়, তাহলে দর্শকদের জন্যেও মঙ্গল।
শুভকামনা এই গুণী অভিনেত্রীর জন্য।