সিনেমা জগতের সবচেয়ে আরাধ্য বস্তুটি হচ্ছে অস্কার পুরষ্কার। অনেক বিখ্যাত সিনেমা কলাকুশলীরাও বাগিয়ে নিতে পারেননি এই পুরষ্কার। হালের ব্র্যাড পিট, জনি ডেপ থেকে শুরু করে অনেকেই আছেন এই তালিকায়। তাদের কিছু কিছু সিনেমায় অভিনয় দেখলে মনে হবে এই চরিত্র অস্কার পাবার যোগ্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পায়নি। এরকমই কয়েকটি উদাহরণ দেখব এখানে।
লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও (হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ)
ক্যারিয়ারে ২০ বছরের বেশি অতিবাহিত করার পর অবশেষে ২০১৬ সালে দ্যা রেভেনেন্ট মুভির জন্য সেরা অভিনেতার অস্কার জেতেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও। যদিও এর আগে অস্কারের জন্য মনোনিত হয়েছিলেন আরো পাঁচবার। ১৯৮৫ সালে ছোট পর্দায় অভিনয়ের মাধ্যমে অভিষেক ঘটানো এই হলিউড রাজপুত্র প্রথমারের মতো পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে অস্কারের মনোনয়ন পান ১৯৯৪ সালে। ল্যাস হ্যালস্ট্রমের পরিচালনায় হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ মুভিতে জনি ডেপের সাথে অভিনয়ে এই মনোনয়ন জুটে তার।
সেবারই অস্কার ঘরে তোলার যোগ্য দাবিদার ছিলেন ২০ বছর বয়সী এই তরুণ। মুভিতে গিলবার্ট গ্রেপ চরিত্রে অভিনয় করা জনি ডেপের ছোট ভাই হিসেবে অভিনয় করেন ডিক্যাপ্রিও। আর্নি গ্রেপ নামের মানসিকভাবে অসুস্থ ছেলেটিকে দারুণ দক্ষতায় পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন এই তারকা। পুরো মুভিতে ডিক্যাপ্রিওর স্বতঃস্ফুর্ত অভিনয় মন কেড়েছে দর্শকদের। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেবার অস্কার হাতছাড়া হয়েছিল তার। বেশিরভাগ সিনেমাবোদ্ধার মতে দ্যা রেভেন্যান্ট এর বদলে হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেপ এর জন্য ডিক্যাপ্রিও অস্কার পেলে তা বেশি মানানসই হতো।
ডেনজেল ওয়াশিংটন (ম্যালকম এক্স)
গ্লোরি আর ট্রেইনিং ডে মুভি দুটির জন্য দুইটি অস্কার জিতলেও ম্যালকম এক্স-এ ডেনজেল ওয়াশিংটনের ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্স অস্কারে উপেক্ষিতই থেকে গেছে। স্পাইক লির মুভিতে অনবদ্য অভিনয় দিয়ে অস্কারের মনোনয়ন পান তিনি। একজন ছোট গ্যাংস্টার থেকে কালো ন্যাশনালিস্ট হয়ে উঠা এই বায়োপিকে এক বিতর্কিত চরিত্রকে উপস্থাপন করেন ডেনজেল। হয়তো বিতর্কিত বলেই অস্কারে উপেক্ষিত থেকে গেছেন তিনি। তবে নিঃসন্দেহে তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয় ফুটে উঠেছে এখানে।
আল পাচিনো (গডফাদার টু)
আট বারের মনোনয়নের পর অবশেষে ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো অস্কার জেতেন আল পাচিনো। সেন্ট অব উইমেন-এর জন্য অস্কার জিতেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। তবে সত্তরের দশকেই অস্কার পেতে পারতেন তিনি। বিশেষ করে ’৭৩ থেকে ’৭৬ পর্যন্ত টানা নমিনেশনের মধ্যে গডফাদার টু এর জন্য অস্কার হাতছাড়া হওয়াটা বেমানান ছিল। মাইকেল কর্লিওনি চরিত্রটির দৃরতা আর কঠোরতা দারুণভাবে পর্দায় তুলে ধরেছেন। ফ্যামিলি ড্রামা আর ক্রাইম থ্রিলারের এই চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেও অস্কার জেতা হয়নি সেবার।
হামফ্রি বোগার্ট (ইন আ লোনলি প্লেস)
হলিউড জগতের অন্যতম আইকন হওয়া সত্ত্বেও ক্যারিয়ার জুড়ে মাত্র তিনবার মনোনয়ন পেয়েছেন হামফ্রি বোগার্ট। এর মধ্যে আফ্রিকান কুইন-এর জন্য অস্কার জিতেছেন। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে ক্যারিয়ার সেরা কাজ ইন আ লোনলি প্লেস-এর জন্য মনোনয়ন পর্যন্ত জুটেনি। সিনেমায় কিছুটা নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করায় দর্শকেরা কিছুটা আশাহত হয়েছিলেন। সে কারণেই হয়তো অস্কার কমিটির চোখে উপেক্ষিতই থেকে গেছেন ফ্রেড ডবস চরিত্রে অভিনয় করা বোগার্ট। আফ্রিকান কুইন-এর জন্য অস্কার পেলেও ফেড ডবস চরিত্রটি তার করা অন্য যেকোনো চরিত্র থেকে এগিয়ে আছে।
ড্যানিয়েল ডে লুইস (গ্যাংগস অব নিউইয়র্ক)
তিনটি অস্কারই বলে দেয় বর্তমানে হলিউডের জীবন্ত কিংবদন্তী এই অভিনেতা। মাই লেফট ফুট, দেয়ার উইল বি ব্লাড এবং লিংকন-এর জন্য সর্বোচ্চ তিনবার সেরা অভিনেতার পুরষ্কার ঘরে তোলেন তিনি। তবে গ্যাংগস অব নিউইয়র্ক-এ বিল দ্যা বুচার চরিত্রটি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। মার্টিন স্করসিসের এই ক্লাসিক চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে অস্কারের মনোনয়নও পেয়েছিলেন।
এখানে অভিনীত চরিত্রের জন্য বাফটা এওয়ার্ড জিতলেও অস্কার হারান আদ্রিয়েন ব্রডির কাছে। চরিত্রের জন্য তিনমাস তিনি কসাইয়ের কাজও শিখেছিলেন। মুভিতে ড্যানিয়েল ডে লুইসের অভিযোগাত্মক অঙ্গভঙ্গি, একমাত্রিক ভিলেন থেকে জটিল চরিত্রে পদার্পন কিংবা লিপ্সিত আকাঙ্খা যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। বিল দ্যা বুচার চরিত্রটি একইসাথে উপভোগ্য এবং ভয়ঙ্কর ছিল। এর জন্য পুরো কৃতিত্ব ড্যানিয়েল ডে লুইসের প্রাপ্য। তার অসাধারণ অভিনয়ের কারণে মুভিতে ডিক্যাপ্রিওর পারফরম্যান্সও আড়ালে পড়ে যায়। বিল দ্যা বুচারের জন্য অস্কার হাতছাড়া হয়ে যাওয়াটা একটু দৃষ্টিকটুই ছিল।
টম হ্যাঙ্কস (ক্যাস্ট এওয়ে)
টম হ্যাঙ্কস হচ্ছেন টানা দুইটি সেরা অভিনেতার অস্কার পাওয়া দুইজনের একজন। ফিলাডেলফিয়া এবং ফরেস্ট গাম্প-এর জন্য দুইবার অস্কার জিতলেও দুই দশক ধরে সেই পুরষ্কার পুনরায় জেতার সৌভাগ্য এখনো হয়নি এই আমেরিকান অভিনেতার। যদিও গত দুই দশক ধরে অস্কার জেতার মতো অনেকগুলো চরিত্র উপহার দিয়ে এসেছেন টম হ্যাঙ্কস।
সবচেয়ে দারুণ পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন রবার্ট জেমেকিসের ক্যাস্ট এওয়ে-তে। ক্যাস্ট এওয়ে মুভিতে অন্যরকম এক অভিনয়ের চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল তাকে। আধুনিক ঘরানার রবিনসন ক্রুশো ধাঁচের চরিত্রটি অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলেন। চোখ ধাঁধানো অভিনয় উপহার দেওয়া সত্ত্বেও অস্কার জেতেননি টম হ্যাঙ্কস।
পিটার ও’টুল (লরেন্স অব আরাবিয়া)
হলিউডের সবচেয়ে দুর্ভাগা অভিনেতার নাম বললে প্রথমেই আসবে পিটার ও’টুলের কথা। ক্যারিয়ারে মোট আটবার মনোনয়ন নিয়েও অস্কার জেতেননি। ২০০৩ সালে বিশেষ সম্মাননায় অস্কার জিতেন। তবে তারচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল ২০০৭ সালে আবারও মনোনিত হন তিনি। কিন্তু সেবারও জিততে পারেননি। ক্যারিয়ার জুড়ে অনেক মুভিতে অভিনয় করলেও অবিশ্বাস্য ছিল লরেন্স অব আরাবিয়ার জন্য অস্কার হাতছাড়া হওয়াটা। তবে সে বছর গ্রেগরি পেকের টু কিল আ মকিংবার্ড-এর জন্যই মূলত অস্কার খুইয়েছিলেন তিনি। সেবার মানুষ তাকে স্বান্ত্বনা দিয়েছিল এই বলে যে তার তো কেবলমাত্র ক্যারিয়ার শুরু। তবে সেই সুসময় আর আসেনি পিটারের ক্যারিয়ারে।
রবার্ট ডুভাল (দ্যা গডফাদার)
টেন্ডার মার্সিস চলচ্চিত্রের জন্য সেরা অভিনেতার অস্কার পেলেও রবার্ট ডুভালের সেরা কাজগুলো ছিল পার্শ্ব-চরিত্রগুলোতে অসামান্য অভিনয়। বিশেষ করে দ্যা গডফাদার এবং এপোক্যালিপ্স নাউ মুভিতে পার্শ্ব চরিত্রে তার অতিমানবীয় অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন এই অভিনেতা। নিঁখুতভাবে আবেগপ্রবণতাকে পুঁজি করে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন অসামান্য অভিনয়। ক্যারিয়ার সেরা এই কাজের জন্য অস্কারে মনোনিত হলেও জিততে পারেননি। একইভাবে এপোক্যালিপ্স নাউ এর বেলাতেও খালি হাতেই ফিরেন এই গুণী অভিনেতা।
তবে তাদের অভিনয় অস্কারের ঊর্ধ্বে। অস্কার পুরষ্কার না পেলেও সেগুলো নিজ নিজ যোগ্যতায় নিজেদের আসনে অসীন। মানুষের গ্রহণযোগ্যতাই তার প্রমাণ।