১.
স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানোর সাহস সবার থাকে না, সে তুলনায় স্রোতের অনুকূলে সাঁতার কাটাই সহজ। কে চায় সহজ রাস্তা বাদ দিয়ে কঠিন পথকে ভালোবাসতে! তবে কিছু কিছু মানুষ হয়তো একটু ব্যতিক্রমধর্মীই হয়ে ওঠেন। গ্ল্যামার জগতের ঝকঝকে দুনিয়াটাই মানুষকে বেশি টানে, বেশিরভাগ মানুষ জনপ্রিয়তার পথটাকেই বেছে নেয়।
‘যত বেশি জনপ্রিয়, তত বেশি সফল’ – এই আপ্তবাক্যটিই হয়তো গ্ল্যামার জগতের বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস। কিছু কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী ভিন্ন ধারায় সফল হলেও তাদের বেশির ভাগই মূলধারায় ব্যর্থ হয়ে অফ-ট্র্যাকে পা রেখেছিলেন। মূলধারায় জনপ্রিয় হবার জন্য অনেক সময় শুধু ভালো অভিনয়টাই যথেষ্ট নয়, এর সাথে বাহ্যিক সৌন্দর্য কিংবা আরো কিছু বিষয় চলে আসে। অনেক সময় কোনো এক বিচিত্র কারণে বাহ্যিক সৌন্দর্যসম্পন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকেও বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমায় দর্শকরা গ্রহণ করেন না।
কিন্তু কোনো অভিনেত্রীর ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমাই যদি সুপারহিট হয় আর সেই অভিনেত্রী যদি সেই সিনেমার জন্য ‘ফিল্ম-ফেয়ার শ্রেষ্ঠ নবাগতা অভিনেত্রী’র পুরষ্কার পান! তাহলে তিনি বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য যথেষ্ট তৈরি এবং দর্শকদের কাছেও গ্রহণযোগ্য সে কথা সহজেই বলা যায়। দেখতে-শুনতেও তিনি সুশ্রী, অভিনেত্রী হিসেবেও দারুণ। তারপরও তিনি তার ক্যারিয়ারে গুরুত্ব দেন ‘লাইফ অফ পাই’, ‘চাঁদনী বার’, ‘হায়দার’, ‘মকবুল’ কিংবা ‘ফিতুর’-এর মতো কিছুটা ভিন্নধারার সিনেমাগুলোকে। অবশ্য এর সাথে সাথে ‘গোলমাল এগেইন’, ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’-এর মতো মূলধারার সিনেমাতেও তার সমান পদচারণা। ‘সব্যসাচী’ এই অভিনেত্রীর নাম টাবু।
২.
১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর হায়দারাবাদের একটি মুসলিম পরিবারে টাবুর জন্ম। পুরো নাম তাবাসসুম ফাতিমা হাশমি। খুব ছোটবেলাতেই টাবুর বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তিনি প্রাথমিক পড়াশুনা করেছেন হায়দ্রাবাদ সেন্ট আনস হাই স্কুলে। পরে ১৯৮৩ সালে তিনি মুম্বাই চলে আসেন এবং সেন্ট জেভিয়ার কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন দুই বছরের জন্য।
টাবু বিখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা আজমি এবং আশির দশক মাতানো আরেক অভিনেত্রী ফারাহ নাজের ছোট বোন। চলচ্চিত্র পরিবারের হওয়ায় খুব ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্র জগতের সাথে তার নিগূঢ় সম্পর্ক ছিল। চলচ্চিত্রে তার অভিষেক হয় ১৯৮০ সালে ‘বাজার’ সিনেমায় ছোট্ট একটি চরিত্রে। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে ‘হাম নওজোয়ান’ সিনেমায় তিনি দেব আনন্দের মেয়ে হিসেবে অভিনয় করেন। মূল অভিনেত্রী হিসেবে টাবুর অভিষেক হয় তেলেগু চলচ্চিত্র ‘কুলি নং ওয়ান’-এর মাধ্যমে।
হিন্দি সিনেমায় তার জমকালো অভিষেক হবার কথা ছিল, বনি কাপুরের সিনেমা ‘প্রেম’-এ সঞ্জয় কাপুরের বিপরীতে তিনি চুক্তিবদ্ধ হন। তবে নানা কারণে সিনেমাটা মুক্তি পায় ৮ বছর পর। বলিউডে তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘প্যাহলা প্যাহলা পেয়ার’ হলেও তিনি মূলত নজরে আসেন ‘বিজয়পথ’ সিনেমার মাধ্যমে। এই সিনেমাই তাকে পাইয়ে দেয় ফিল্ম-ফেয়ারের শ্রেষ্ঠ নবাগতা অভিনেত্রীর পুরষ্কার।
টাবুর প্রথম দিকের অনেক সিনেমাই বক্স অফিসে সাফল্য আনতে পারেনি। তবে ১৯৯৬ সালটা তার জন্য ছিল সাফল্য মোড়ানো। এই বছর তার ৮টি সিনেমা মুক্তি পায়। ‘সাজান চালে সাসুরাল’ এবং ‘জিত’ সিনেমা দুটো সেই বছরের সেরা ব্যবসা সফল সিনেমার প্রথম পাঁচে ছিল। তবে তিনি তার সেরা পুরষ্কারটা পান ‘মাচিস’ সিনেমার জন্য। এই সিনেমায় তিনি চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন এবং ফলস্বরূপ ‘ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার’ পান। একই বছরে দক্ষিণেও তার সফলতা অব্যাহত থাকে। তেলেগু সিনেমা ‘নিনে পেলাডাটা’ সুপার-ডুপার হিট হয় এবং তেলেগুর ‘ফিল্ম-ফেয়ার সেরা অভিনেত্রী’র পুরষ্কার পান টাবু।
১৯৯৭ সালে তিনি মাল্টিস্টারনির্ভর সিনেমা ‘বর্ডার’-এ খুব ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। একই বছর তিনি ‘বিরাসাত’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ‘ফিল্ম-ফেয়ার সমালোচক পুরষ্কার’ জিতে নেন।
৩.
ক্যারিয়ারে ‘বিবি নম্বর ওয়ান’, ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’, ‘হেরা ফেরি’ এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমার ভিড়ে টাবু আরেকটা মাস্টারপিস সিনেমা করেন ২০০১ সালে।
‘চাঁদনী বার’ নামক সেই সিনেমায় একজন বার ড্যান্সারের ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতে নেন। ২০০৩ সালে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ অবলম্বনে ‘মকবুল’ সিনেমায়ও ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান টাবু। সিনেমাটা ব্যবসায়িকভাবে সফলতা না পেলেও সমালোচকদের কাছে ভূয়সী প্রশংসা পায়।
২০০৭ সালে হলিউডে টাবু’র অভিষেক হয়। মিরা নায়ার পরিচালিত ‘দ্য নেমসেক’ সিনেমাটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায়িক সফলতা লাভ করে। পরবর্তীতে আরেক হলিউড সিনেমা ‘লাইফ অফ পাই’-তে তিনি সহঅভিনেত্রী চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন এবং সিনেমাটিও দারুণ সফলতা পায়।
২০০৮ সালে টাবু ‘চিনি কম’ সিনেমায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমায় তিনি ৩৪ বছর বয়সী একজন তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি কিনা ৬৪ বছর বয়স্ক একজন বৃদ্ধের (অমিতাভ বচ্চন) প্রেমে পড়ে যান। ভারতে সিনেমাটি খুব ভালো ব্যবসা করতে না পারলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য পায়। এছাড়া সমালোচকদের কাছেও সিনেমা এবং টাবুর অভিনয় প্রশংসিত হয়।
২০১৪ সালে তিনি শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘হায়দার’ সিনেমায় শহীদ কাপুরের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে ‘ফিল্ম-ফেয়ার শ্রেষ্ঠ সহঅভিনেত্রী’র পুরষ্কার জিতেন। একই বছরে মূলধারার সিনেমা ‘জয় হো’-তে সালমান খানের সঙ্গে অভিনয় করেন।
‘জয় হো’ সিনেমাটা ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হলেও ‘হায়দার’ সিনেমাটা সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ানোর সাথে সাথে ব্যবসায়িকভাবেও সাফল্য পায়। সিনেমায় ‘টাবু’র অভিনয় এতটাই প্রশংসিত হয় যে, ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ বলা হয় – সিনেমাটির নাম ‘হায়দার’ এর পরিবর্তে ‘ঘাযালা মির’ (টাবুর অভিনীত চরিত্রের নাম) হওয়া উচিত ছিল।
২০১৬ সালে অজয় দেবগনের সাথে ১৬ বছর পর ‘দৃশ্যম’ সিনেমায় অভিনয় করেন। সিনেমায় তিনি একজন কঠোর পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন। পরের বছর ‘ফিতুর’ সিনেমায়ও তার অভিনয় প্রশংসিত হয়, যদিও সিনেমাটা ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করতে একেবারেই ব্যর্থ হয়।
এত বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয়ের পর বাকি থাকে খল চরিত্র। সেটাতেও অভিনয় করে ফেলেন ২০০৩ সালে সানি দেওলের বিপক্ষে ‘জাল: দ্য ট্র্যাপ’ সিনেমায়। সিনেমায় প্রথম দিকে সাধারণ নারীর চরিত্রে অভিনয় করলেও পরবর্তীতে দেখা যায় তিনি একজন মুসলিম আতঙ্কবাদী। বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রগুলো তার ক্যারিয়ারকে ভিন্নরকম এক পূর্ণতা প্রদান করে।
৪.
সিনেমার খাতিরে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করলেও একটি জায়গায় টাবু সবসময়েই অপরিবর্তিত ছিলেন, সেটা হচ্ছে টাবুর লম্বা এবং ঘন কালো চুল। টাবু সবসময়েই এই চুলটাকে তার সম্পদ ভেবেছেন এবং চুল নিয়ে তিনি কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা করেননি।
ক্যারিয়ারে হিন্দি, তেলেগু, তামিল, ইংরেজি, বাংলা সব ধরনের ভাষার সিনেমাতেই অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। ‘বিবি নম্বর ওয়ান’, ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’, ‘গোলমাল এগেইন’ এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমা, ‘মাচিস’, ‘হায়দার’, ‘ফিতুর’, ‘চাঁদনী বার’ এর মতো ভিন্নধারার সিনেমা, ‘চাচী ৪২০’, ‘তোহ বাত পাক্কি’, ‘হেরা ফেরি’-এর মতো কমেডি, অথবা ‘হাওয়া’ এর মতো ভৌতিক সিনেমায় অভিনয় করার কৃতিত্ব হয়তো অনেক অভিনেত্রীরই রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে সব অঙ্গণে ব্যবসায়িকভাবে সফলতা লাভের সাথে সাথে সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা এবং জাতীয় পুরষ্কার অর্জন তাকে অন্যদের তুলনায় সুউচ্চ এক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
বলিউডে তাই অভিনেত্রীদের প্রথাগত ইঁদুর দৌড়ে প্রথম অবস্থানে না থাকলেও টাবুকে বিবেচনা করা হয় ভিন্ন আঙ্গিকেই। আশা করা যায়, ভবিষ্যতেও তিনি আরও ভিন্নধর্মী এবং ভালো কাজই চলচ্চিত্রপ্রেমীদের উপহার দিয়ে যাবেন।
ফিচার ইমেজ – Darpan Magazin