“পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষটিকে বদ্ধ উন্মাদ বানিয়ে দিতে একটি খারাপ দিনই যথেষ্ট। আমার অবস্থান থেকে দুনিয়ার বাকি সবার দূরত্ব ঐ একটি দিন!”
কমিকস জগতের এক নম্বর সুপার ভিলেন এবং ব্যাটম্যানের চিরশত্রু, জোকারের ভাষ্য এটি। সবুজ চুল আর ফ্যাকাসে সাদা চেহারার এক সাইকোপ্যাথ মাস্টারমাইন্ড হওয়ার আগে তার জীবনটা কেমন ছিলো? জোকারের কাছে এই তথ্যটি যতবারই কেউ জানতে চেয়েছে, সে দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর। মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে স্মৃতি বিলোপ নাকি, সবার কাছে নিজের রহস্যকে ভাঙতে না চাওয়ার প্রবণতা- জোকারের এমন আচরণের পেছনের কারণটা কী?
জোকারের বয়স কিন্তু কম হলো না! ৭৭ বছর আগে কমিক দুনিয়ায় আবির্ভাব ঘটেছিলো ‘দ্য ক্লাউন প্রিন্স অফ ক্রাইমে’র। এই ৭৭ বছরে বহুবার বহুভাবে বলার চেষ্টা হয়েছে জোকারের গল্প। কখনো সে গোবেচারা এক কেমিকেল কারখানার কেরানি, ভাগ্যদোষে যে ভিড়ে যায় এক অপরাধচক্রের সঙ্গে। লুটপাট করে পালাবার পথে ব্যাটম্যানের ধাওয়া খেয়ে রাসায়নিক ভরা পাত্রে ডুবে চেহারা আর মস্তিষ্কের আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় যার! কোনো কোনো গল্পে জোকার আগে থেকেই এক কুখ্যাত অপরাধী, পাগলের ভান ধরে যে বাঁচার চেষ্টা করে মৃত্যুদণ্ড থেকে! ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ নামের এক অল্টারনেট ইউনিভার্স কমিক্স ইভেন্টে তো জোকারকে দেখানো হয়েছে ব্রুস ওয়েইনের মা হিসেবে! এই জগতের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন সেই প্যারালাল ইউনিভার্সে ছিনতাইকারীদের গুলিতে মার্থার বদলে মরে গিয়েছিলো তার ছেলে ব্রুস। আর পুত্রশোকে পাগল মার্থা বনে যায় ভয়ঙ্কর খুনি জোকার!
কমিক্সের পাতা থেকে ছোটবড় দুই পর্দাতেই অনেকবার জোকারকে তুলে ধরার গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন হলিউডের জাঁদরেল সব অভিনেতারা। অ্যানিমেটেড সিরিজগুলোতে জোকারের সবাক করেছেন মার্ক হ্যামিল আর ট্রয় বেকাররা। ওদিকে সিজার রোমেরো, জ্যাক নিকলসন, হিথ লেজার আর হালের জ্যারেড লেটো- হেভিওয়েট সব তারকারা দায়িত্ব পেয়েছিলেন জোকারকে সিনেমায় জীবন্ত করে তুলতে। এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন হোয়াকিন ফিনিক্স।
মার্ক হ্যামিল বিশ্বখ্যাত সাই ফাই সিরিজ ‘স্টার ওয়ার্স’-এর লুক স্কাইওয়াকার। ছেলে থেকে বুড়ো- সবাই তার ভক্ত। তিনবারের অস্কারজয়ী জ্যাক নিকলসনের অভিনয় প্রতিভার কথা কে না জানে! হিথ লেজার তো মরণোত্তর অস্কার জিতে জোকারকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়! ‘সুইসাইড স্কোয়াড’-এ খুব বেশি কারিকুরি দেখাতে না পারলেও জ্যারেড লেটোরও রয়েছে অস্কারজয়ের ইতিহাস।
এতসব বর্ণময় তারকার ভিড়ে হোয়াকিন ফিনিক্সকে আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা সাদামাটাই দেখায়। কিন্তু অস্কারে তিনবার মনোনয়ন জিতে নেয়া ফিনিক্স কিন্তু সাধারণ মাপের কোনো ব্যক্তি নন! তার নিজের জীবনটাই অনেকের কাছে শোনাবে গল্পের মতো। আর ফিনিক্সে ভর করেই নির্মাতা টড ফিলিপ্স এবার শোনাতে চাইছেন জোকারের জন্মকাহিনী!
চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক কে এই হোয়াকিন ফিনিক্স, এবং কেন স্ট্যান্ড অ্যালোন ‘জোকার’ সিনেমায় তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চলছে এত মাতামাতি।
ফিনিক্স: পুনর্জন্মপ্রাপ্ত এক অভিনয়পাগল মানুষ
পশ্চিমা রূপকথার ফিনিক্স হলো এমন এক পাখি, যে নিজের আগুনে পুড়ে ফের পুনর্জন্ম নেয় নতুন রূপে। ফিনিক্সকে তাই ধরা হয় রূপান্তরের রূপক হিসেবে। হোয়াকিন ফিনিক্স-এর নিজের জীবনের গল্পটিও ঠিক সেরকম!
ষাটের দশকের শেষভাগে আমেরিকাজুড়ে যখন হিপ্পি সংস্কৃতি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তখন পরিচয় ঘটে আর্লিন ডানেটজ এবং জন লি বটম-এর। একে অপরের প্রেমে পড়া এই জুটি শিগগিরই বিয়ে করে ফেলেন এবং বেরিয়ে পড়েন আমেরিকা মহাদেশটিকে ঘুরে দেখার এক সফরে। এই সফরেই একে একে জন্ম নেয় তাদের পাঁচ সন্তান- রিভার, রেইন, হোয়াকিন, লিবার্টি এবং সামারের। বড় সন্তান রিভারের জন্ম হওয়ার পর তারা অনুসারী হন মেক্সিকোর ‘চিলড্রেন অফ গড’- নামের একটি ধর্মীয় গোত্রের।
১৯৭৭ সালে এই গোত্র থেকে বেরিয়ে আসে বটম পরিবার। স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে লস এঞ্জেলসে এবং বেছে নেয় নিরামিষাশী জীবনধারা। আর্লিন কাজ নেন এনবিসি-এর একজন প্রযোজক হিসেবে। নতুন এই জীবনধারাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে পরিবারের সবাই তাদের পদবী ‘বটম’কে পরিবর্তন করে ‘ফিনিক্স’-এ। শিশু হোয়াকিন নিজেও চাইলো ভাই-বোনদের মতো প্রকৃতিঘেঁষা নাম! হোয়াকিন থেকে তার নাম হয়ে গেল ‘লিফ’!
তো নদী, বৃষ্টি, পাতা, মুক্তি আর গ্রীষ্মের জীবনটাও আরও অন্যরকম হয়ে গেল যখন মায়ের সূত্র ধরে একে একে সবাই পা রাখতে শুরু করলো রূপালী পর্দায়। প্রথমে বাচ্চাদের বিজ্ঞাপন, এরপর টিভি সিরিজের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে হলিউডের ফিল্মমেকারদের কাছেও পরিচিত হতে শুরু করলো ফিনিক্স ভাই-বোনেরা। বিশেষ করে সবার বড় রিভার ফিনিক্স তো কিশোর বয়সেই বনে গিয়েছিলেন তারকা! ‘রানিং অন এম্পটি’র মতো সিনেমা দিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তিনি অর্জন করে ফেলেন অস্কার মনোনয়ন। একই বছরে স্পিলবার্গের ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স: দ্য লাস্ট ক্রুসেডার’-এ ইন্ডিয়ানা জোন্সের তরুণ বয়সের চরিত্রে অভিনয় তাকে এনে দেয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। ‘মাই ওউন প্রাইভেট আইডাহো’ দিয়ে জিতে নেন সমালোচকদের মনও।
ভাইয়ের এমন যশ আর খ্যাতির আড়ালে প্রায় ঢাকাই পড়ে গিয়েছিলেন লিফ। অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা অফুরান হলেও এই ক্যারিয়ারে শেষ পর্যন্ত সফল হবেন কি না- তা নিয়ে সবসময়ই একধরনের শঙ্কা কাজ করতো তার মনে।
অথচ মাত্র দশ বছর বয়সেই ভাইয়ের সঙ্গে লিফ অভিনয় করেছিলেন সেসময়ের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘ব্যাকওয়াটারস: রিডলস অফ ডিসলেক্সিয়াতে’-এ। এর দু’বছর পর বড় পর্দার সফল ছবি ‘স্পেসক্যাম্প’-এ অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান তিনি।
কিশোর বয়স থেকেই হলিউডে পরিচিতি পেতে শুরু করলেও ১৯৮৯-এর সাড়া জাগানো সিনেমা ‘প্যারেন্টহুড’-এর পর নিজেকে কিছুদিনের জন্য গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন লিফ। মনমতো চরিত্র না পাওয়া আর পৃথিবীটাকে আরেকটু ভালোভাবে দেখতে চাওয়ার প্রয়াসই ছিলো এই সাময়িক বিরতির কারণ।
এদিকে ফিনিক্স পরিবারে ধরতে শুরু করে ভাঙন। বাবা-মা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর বাবার সঙ্গে মেক্সিকো পাড়ি জমান লিফ। ভাই রিভার, আর অন্য দুই বোন ফ্লোরিডায় রয়ে যান মায়ের সঙ্গে।
লিফ হয়তো এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যেতেন যদি না তার জীবনে ১৯৯৩ সালের ৩১ অক্টোবর দিনটি না আসতো। ভাই রিভারের সঙ্গে দেখা করতে ১৯ বছরের লিফ এসেছিলেন লস এঞ্জেলসে। রিভার ততদিনে হলিউডের বড় তারকা। তারকাখ্যাতির সঙ্গে মদ এবং মাদক প্রবেশ করতে শুরু করেছে তার জীবনে। ভাই লিফকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন ‘দ্য ভাইপার রুম’-এ। আরেক হলিউড তারকা জনি ডেপের মালিকানাধীন এই ক্লাবটিতে নিয়মিত পান করতে যেতেন তিনি।
এখানেই ১৯৯৩ সালের ৩১ অক্টোবর একাধিক মাদকের অতিরিক্ত সেবনে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন রিভার। ভাইকে চোখের সামনে মারা যেতে দেখেন লিফ। ভয়াবহ সেই মুহূর্তে আতঙ্কে থর থর করে কাঁপতে থাকা লিফই ৯১১ তে ফোন করে জানিয়েছিলেন রিভারের মৃত্যুর খবর। সেদিন পৃথিবীর সবক’টি বড় গণমাধ্যমে লিফ-এর সেই ফোনকলটি প্রচারিত হয়েছিলো রিভারের মৃত্যুসংবাদ পরিবেশনের সময়।
ভাইয়ের মৃত্যুর আকস্মিকতা, সেইসঙ্গে মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল- একেবারেই মেনে নিতে পারেননি লিফ। আরও একবার রূপালি জগৎ আর মিডিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তিনি। সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিলেন, আর কখনো ফিরবেন না এই জগতে।
তবে সেই ঘটনার কয়েকমাস পর রিভারের কাছের বন্ধুদের অনুরোধে ফের সিনেমার চিত্রনাট্য পড়তে শুরু করেন তিনি। সে বছরই তিনি অভিনয় করেন ‘ইভেন কাউগার্লস গেট দ্য ব্লুজ’। ১৯৯৫-এ ‘টু ডাই ফর’। এই দুই সিনেমা দিয়েই সমালোচকদের চোখের মণি হয়ে ওঠেন তিনি। লিফ থেকে তিনি ফিরে যান তার আদি নাম, ‘হোয়াকিন’এ।
হোয়াকিন তার এত বছরের ক্যারিয়ারে সিনেমা করেছেন খুব বেছে বেছে। প্রায় প্রতিটিতেই তার অভিনয় নজর কেড়েছে সবার। তবে যে সিনেমাটি দিয়ে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসেন, সেটি হলো ‘গ্ল্যাডিয়েটর’। হ্যাঁ, রাসেল ক্রো এই সিনেমার সবচেয়ে বড় তারকা হলেও, তার শত্রু হিসেবে পর্দায় ঠিক তার সমান আলোই কেড়ে নিয়েছেন হোয়াকিন। বাবাকে হত্যা করে ক্ষমতায় আরোহণ করা রোমান সম্রাট কমোডরের হতাশা, ক্রোধ, অসহায়ত্ব আর ভঙ্গুর আবেগ তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন- তা পায় ভূয়সী প্রশংসা। সেবারই প্রথম তিনি জায়গা করে নেন অস্কার মঞ্চে, পার্শ্ব চরিত্রের সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়ে।
কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী জনি ক্যাশ-এর চরিত্রে ‘ওয়াক দ্য লাইন’-এ অভিনয় করে তিনি পান সেরা অভিনেতার অস্কার মনোনয়ন। তার দ্বিতীয় সেরা অভিনেতার অস্কার মনোনয়ন ছিলো ২০১২ সালের সিনেমা ‘দ্য মাস্টার-এর জন্য। ২০১৩ সালে তার অভিনীত ‘হার’ সিনেমাটিও সেরা সিনেমার অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিলো।
ফিনিক্স কেন জোকার?
আগেই বলেছি জোকারকে বড় পর্দায় যারা তুলে এনেছেন, তাদের প্রত্যেকেই রথী-মহারথী। এরপরও জোকারের একার কোনো সিনেমা কিন্তু এতদিন তৈরির সাহস পাননি নির্মাতারা। জোকারের জন্মকথাও খুব বেশি আসেনি কোনো সিনেমায়। ১৯৮৯ সালের ‘ব্যাটম্যান’-এ জ্যাক নিকলসন অভিনীত জ্যাক নেপিয়ার কীভাবে জোকারে রূপান্তরিত হয়, সেই গল্প আছে বটে, কিন্তু সেটিকেও এই চরিত্রের সঠিক অরিজিন হিসেবে মানতে নারাজ জোকারের পাঁড় ভক্তরা। ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এ জোকাররূপী হিথ লেজার তো একেকবার একেক গল্প ফেঁদে নিজের অতীত নিয়ে সবাইকে ধাঁধাতেই ফেলে দিয়েছেন!
লাইভ অ্যাকশনের নির্মাতারা এড়িয়ে গেলেও অ্যানিমেশনে ঠিকই উঠে এসেছে জোকারের গল্প।
১৯৮৬ সালের কমিক সিরিজ ‘দ্য কিলিং জোক’-এ বলা হয়েছিলো জোকারের সবচেয়ে করুণ কাহিনীটি। ২০১৬ তে সেটি পর্দায় তুলে আনে ওয়ার্নার ব্রাদার্স। মার্ক হ্যামিল কণ্ঠ দেন জোকারের চরিত্রে। ব্যর্থ এক কৌতুকাভিনেতার সব হারানোর গল্প এটি। ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হারানোর পর এক ‘রেড হুড’ দলের সাথে ভিড়ে যায় সে। ডাকাতির দিনে ব্যাটম্যানের ধাওয়া খেয়ে রাসায়নিক ভর্তি ড্রামে পড়ে গিয়ে মানসিক সুস্থতাও পুরোপুরি হারায় সে।
জোকারের এই গল্পটি হার্ডকোর ভক্তকুলের মনে ধরেছিলো। নতুন সিনেমাতেও এই গল্পটিই উঠে আসবে কি না- তা জানা যায়নি এখনও। এটুকু জানা গেছে, নতুন ছবিতে জোকারের নাম আর্থার ফ্লেক। সেও ব্যর্থ এক কৌতুকাভিনেতা। তবে গল্পের বাকিটুকু কেমন- তা খোলসা করেননি নির্মাতারা। সিনেমায় ফিনিক্সের পাশাপাশি থাকবেন রবার্ট ডি নিরো, জাজি বিটজ, মার্ক ম্যারন এবং ফ্রান্সেস কনরয়। তবে কোন ভূমিকায় কে অভিনয় করছেন, জানা যায়নি সেটাও।
নির্মাতা টড ফিলিপস চাইছেন সবার থেকে আলাদা কিছু করতে। ফিলিপসের ভাষায় তার জোকারটি হবে নির্মাতা মার্টিন স্করসেসির ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’-এর মূল চরিত্র ট্র্যাভিসের মতো, কংক্রিটের শহরের শূন্যতায় জীবনের মানে খুঁজে না পেয়ে ধীরে ধীরে বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠতে শুরু করে যে।
ফিলিপস প্রথমে প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন সময়ের আরেক শক্তিমান অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি থিতু হন ফিনিক্স-এ। সেটিও অন্যদের থেকে আলাদা কিছু করতে চাওয়ার প্রয়াসেই।
দ্য ইনডিপেন্ডেন্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফিলিপস বলেছেন, “সমাজের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত এমন এক চরিত্রকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছি, যেখানে স্রেফ গল্প বলে যাওয়ার চেয়েও করার আছে অনেক কিছু।”
জোকারকে নিয়ে সেই ‘অনেক কিছু করা’র ক্ষেত্রে ফিলিপস-এর তুরুপের তাস ফিনিক্স। কিন্তু কেন?
এই চরিত্রের আগের অভিনেতাদের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, কতটা সাধনা তারা করেছেন জোকারকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে। হিথ লেজারকেই দেখুন, জোকারকে বুঝতে শ্যুটিং শুরুর আগে নিজেকে তিনি আটকে রেখেছিলেন একটি হোটেল রুমে। সেখানে দিনের পর দিন জোকারকে নিয়ে পড়ে থেকেছেন তিনি। বুঝতে চেষ্টা করেছেন তার মনস্তত্ব। গোথামের সেই অন্ধকার অলি-গলিতে জোকারের ত্রাসের রাজত্ব কেমন ছিলো, তা বুঝতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছেন বাস্তবের দুনিয়া থেকে। এই সাধনার ফলও মিলেছে লেজারের। ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এ জোকার ছাপিয়ে গেছে ব্যাটম্যানকেও। লেজার নিজে অর্জন করেছেন সেরা পার্শ্ব অভিনেতার অস্কার। তাই মৃত্যুর পরও লেজার এই একটি চরিত্রের জন্যই অমর।
তার উত্তরসূরি জারেড লেটো জোকারের চরিত্রে সেরকম গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও, পরিশ্রম তিনিও কম করেননি। শ্যুটিংয়ের দিনগুলোতে জোকারের সাজ পোশাকেই থেকেছেন তিনি, জীবন-যাপনও করেছেন জোকারের মতো। শোনা যায়, শ্যুটিং-এর মধ্যে সহকর্মীদের বাড়িতে মরা শূকর পাঠিয়ে তিনি অপেক্ষা করতেন তাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য! এর মাধ্যমেই নাকি জোকারের স্যাডিস্টিক মনস্তত্ত্ব বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি!
পর্দার চরিত্রকে এভাবে নিজের জীবনে নিয়ে আসার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় মেথড অ্যাক্টিং। লেজার, লেটোরা তা করে দেখিয়েছেন। ফিনিক্স কি তা করছেন?
ফিনিক্সের অতীত কিন্তু এই মেথড অ্যাক্টিং-এর উপরেই দাঁড় করানো। ‘গ্ল্যাডিয়েটর’-এ যখন তিনি সম্রাট কমোডরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তখন তিনি সেভাবেই নিজের জীবন যাপন করেছেন। পর্দায় কমোডোরকে যেমন ফ্যাকাসে মুখে কাঁপা কাঁপা গলায় অদ্ভুত এক প্রাণহীন সুরে কথা বলতে শোনা যায়- ঠিক তেমনি ওই সময়টাতে শ্যুটিং-এর বাইরেও কথা বলতেন ফিনিক্স। এমনকি, পরিচালকের নির্দেশনা নয়, চরিত্রের প্রয়োজনে অমন অদ্ভুত সুরে কথা বলার কায়দাটা আবিষ্কার করেছেন ফিনিক্স নিজেই!
আবার ‘ওয়াক দ্য লাইন’ সিনেমার কথাই ধরুন। কিংবদন্তী শিল্পী জনি ক্যাশ-এর চাইতে ফিনিক্স অন্তত দেড় হাত খাটো! কিন্তু পর্দায় তা বোঝা গেল কোথায়! ফিনিক্স পরিবেশবাদী ও প্রাণীপ্রেমী মানুষ। চামড়ার কোনো কিছু তিনি কখনো পরেন না। এমনকি সিনেমায় শুটিং করতে এলেও নির্মাতাদের শর্ত দেন সিনথেটিক চামড়ার কস্টিউম বা প্রপস ব্যবহার করার। সেই তিনিই জনি ক্যাশের ‘ভিনটেজ বুটজোড়া’ গর্বের সঙ্গে পরেছেন। চলনে-বলনে হয়ে উঠেছেন স্বয়ং ক্যাশ!
তবে অভিনয়ের চাইতেও এই সিনেমায় ফিনিক্স বড় জাদু দেখিয়েছেন গান গেয়ে। একজন গায়কের বায়োপিকে গান থাকবেই। তবে সাধারণত সেসব গান পেশাদার প্লেব্যাক শিল্পীদের দিয়েই গাওয়ানোর নিয়ম। কিন্তু ‘ওয়াক দ্য লাইন’-এর সবগুলো গান গেয়েছেন ফিনিক্স নিজে! চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট সিনেমাটি দেখে বলেছিলেন,
“জনি ক্যাশের ভক্ত হিসেবে গানগুলো আমি আলাদাভাবে শুনেছি। চোখ বন্ধ করে মনে হয়েছে ক্যাশ নিজেই যেন গাইছেন। আমিও ভেবেছি, ক্যাশের পুরানো রেকর্ড থেকেই গানগুলো নেয়া বোধহয়। কিন্তু সিনেমা শেষে ক্রেডিট লাইনে গায়কের জায়গায় ফিনিক্সের নাম দেখলাম। আমার তো একেবারে আক্কেল গুডুম!”
এই পরিশ্রমেরও ফল মিলেছে ফিনিক্সের। অস্কারে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়ে জিততে না পারলেও গ্র্যামি ঠিকই জিতে নিয়েছিলেন সিনেমায় গানগুলো গেয়ে!
তো, এই হলেন ফিনিক্স। এই হলো তার অভিনয়ের প্রতি নিবেদন। কিন্তু জোকারকে নিয়ে তার ভাবনাটা কেমন?
এমন প্রশ্নের জবাবে নিজের স্বভাবসুলভ রসিকতা করতে করতে ফিনিক্স বলেছেন,
“মূলত এটা (জোকারের চরিত্রে অভিনয় ) নিয়ে আমি আতঙ্কে অস্থির। এমনও হতে পারে এটা দেখে আপনারাও আতঙ্কে অস্থির হয়ে যাবেন!”
আসলেই ফিনিক্স-এর জোকারকে দেখে দর্শক আতঙ্কে জমে যাবে কি না, এটি জানতে অপেক্ষা করতে হবে ২০১৯ পর্যন্ত। তবে তার আগে দেখে নিতে পারেন সিনেমার টিজারটি। আর নিজেই বিচার করুন, নিকলসন, লেজার, লেটোদের তুলনায় জোকারের রূপে ফিনিক্স কতটা সফল হবেন!
Featured photo: Screenrant