১৯৯৪ সাল, দক্ষিণ আফ্রিকা। বর্ণবাদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার হাত ধরে একটি সুখী, সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছিল দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী। দেশের তরুণ প্রজন্মেের মন আশা-আনন্দে ভরপুর। জাইন বিখা তখন ১৯ বছরের তরুণ। তিনি ও তার বাল্যবন্ধু মুবীনও অন্যান্য তরুণদের মতোই দেশে নতুন যুগের আবির্ভাবে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু জাইন যদি জানতেন কী অপেক্ষা করছে তার জন্য!
সেই বছরই শরীরে গুলি লেগে মৃত্যুবরণ করেন তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু মুবীন। বন্ধুর মৃত্যুতে ভীষণ কষ্ট পেলেন জাইন। তিনি কিছুতেই তরুণ, হাসিখুশী বন্ধুর মৃত্যু মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি ভাবতেন, মারা যাবে শুধু বৃদ্ধ আর রোগীরা। সুস্থ-সবল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর কোনো তরুণ কেন মারা যাবে? প্রশ্নটি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। তিনি বন্ধুর বিয়োগবেদনা সহ্য করতে পারছিলেন না। একসময় তিনি নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন, “জীবন আসলে কী? আমি কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাচ্ছি? আমার জীবনের উদ্দ্যেশ্য কী?”
এই ঘটনার কিছুদিন পরই স্থানীয় রেডিও স্টেশন গানের প্রতিযোগীতার আয়োজন করে। জাইন মনপ্রাণ ঢেলে গাইলেন প্রতিযোগীতাটির জন্য। ফলাফল? তিনি জিতে গেলেন!
তারপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি গাইছেন। উপরের দুটি ঘটনা জাইন বিখার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন ভাল কিছু করতে। ফলে আমরা পেয়েছি আজকের জাইন বিখাকে। ইংরেজি ভাষাভাষী মুসলিমদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এই ইসলামী সঙ্গীতশিল্পী। জাইন বিখা বিশ্বে পরিচিত তার ভদ্র আচরণ, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সুমধুর কন্ঠস্বর এবং ইসলামী বিশ্বাস ও ইতিবাচক বার্তা সম্বলিত গানের জন্য। জাইন বিখা শুধু নাশীদ বা ইসলামী সঙ্গীতের জগতে অসাধারণ সব গান গাওয়ার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই রাখেননি, অনুপ্রাণিত করেছেন অসংখ্য শিল্পীকে। এই লেখাটি বিখ্যাত ইসলামী সঙ্গীতশিল্পী জাইন বিখার জীবন ও সঙ্গীতদর্শন নিয়েই।
জাইন বিখার জন্ম ১৯৭৪ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে। তার বাবা প্রফেসর রাশীদ বিখা একটি শ্রমজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মা তাকে অনেক কষ্ট করে কলেজের গন্ডীতে পৌঁছে দেন। রাশীদ বিখা সবসময় চাইতেন একজন ফার্মাসিস্ট হতে। তার স্বপ্ন ছিল তিনি ওষুধ বানাবেন। একসময় তিনি তার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে পেরেছিলেন।
প্রফেসর বিখা লোন নেন, ওষুধ তৈরির যন্ত্রপাতি কেনেন এবং বি-ট্যাবস ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিটি শুরু করেন। বর্তমানে এটি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। প্রফেসর বিখা অলাভজনক দাতব্য সংগঠন ‘দ্য ইবন সিনা ইন্সটিটিউট অফ তিব্ব’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটি দক্ষিণ আফ্রিকার গরীর জনগোষ্ঠীকে সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকে। জাইন বিখার মা মারিয়াম একটি ক্যান্সার সংগঠনের সাথে কাজ করেন। সেই সুবাদে বহু ক্যান্সার রোগীর কষ্ট কাছ থেকে দেখেছেন। সেজন্য তিনি খুবই সহানুভূতিশীল স্বভাবের। জাইন বিখা যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাশন ম্যাগাজিন এমিল ম্যাগাজিনকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার মা আমার সবচেয়ে কঠোর সমালোচক। তিনি আমার গানের নানা দিক সম্পর্কে আমাকে উপদেশ দেন। আমি তার একমাত্র ছেলে। তাই তিনি আমাকে নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন থাকেন।” বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনিই একমাত্র ছেলে।
জাইন তার বাবার সম্পর্কে বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকে বাবার কাজকর্ম দেখে বড় হয়েছি। তিনি প্রমাণ করেছেন যে আপনি শূন্য থেকে অনেক বড় কিছু করতে পারেন। তিনি মানুষ হিসেবে ভীষণ সৎ। তিনি সব মানুষের সাথে সম্মান গুরুত্ব ও সম্মানের সাথে কথা বলেন। আমাকেও তিনি সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।”
জাইন বিখা ছোটবেলা থেকেই পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের মাঝে গান গাইতেন। কিন্তু স্থানীয় রেডিও স্টেশন আয়োজিত প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হওয়ার পর তিনি তার সঙ্গীতপ্রতিভা কতটা বেশি তা ভালভাবেই জানতে পারেন। এরপর তিনি সঙ্গীত রেকর্ড করার প্রতি মনোযোগ ঢেলে দেন। শুরু হয় স্থানীয় একটি স্কুলের অনুরোধে স্কুলটির জন্য থিম সং লেখা ও গাওয়ার মাধ্যমে।
এরপর জাইন আরও একধাপ এগিয়ে নিজস্ব অ্যালবাম তৈরীর প্রস্তুতি নেন। প্রকাশিত হয় তার প্রথম অ্যালবাম ‘অ্যা ওয়ে অফ লাইফ’। অ্যালবামটি দক্ষিণ আফ্রিকায় তাকে শিল্পী হিসেবে পরিচিত করে যা তাকে আরও অ্যালবাম প্রকাশে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘প্রেইজ টু প্রফেট (সা.)’, ১৯৯৭ সালে ‘ফর্চুনেট ইজ হি’, ১৯৯৮ সালে ‘দ্য জার্নি’। এরই মধ্যে সাউথ আফ্রিকায় জাইন বিখা শিল্পী হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিশেষ করে বাচ্চারা তার শিক্ষামূলক ও অনুুপ্রেরণাদায়ী গানগুলো পছন্দ করতো ও গাইতো।
জাইন বিখার জনপ্রিয়তার কথা দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছে যায় এবং বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম সঙ্গীতশিল্পী ইউসুফ ইসলামের কানেও পৌঁছায়। ইউসুফ ইসলাম তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তার অ্যালবাম ‘এ ইজ ফর আল্লাহ’ এর জন্য। তিনি ভাবলেন, জাইন বিখা হয়তো তার দারুণ কন্ঠ দিয়ে তার অ্যালবামকে সৌন্দর্যমন্ডিত করতে পারেন। জাইন তার আমন্ত্রণে ১৯৯৯ সালে উড়ে যান যুক্তরাজ্যে। ইউসুফ ইসলামের ‘মাউন্টেন অফ লাইট’ স্টুডিওতে শুরু হয় রেকর্ডিং। এটি জাইন বিখার কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। তিনি অ্যালবামের আটটি গানের সাতটিতেই অংশগ্রহণ করেন। এই অ্যালবামটি ‘জামাল রেকর্ডস’ এর ব্যানারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায়।
জাইন বিখা ইউসুফ ইসলামের কাছে থেকে সঙ্গীতের নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করলেন, অনুপ্রাণিত হলেন এবং তাদের মধ্যে সখ্যতাও গড়ে উঠল। ইউসুফ ইসলাম সম্পর্কে পরে তিনি বলেন, “তার থেকে আমি শিখেছি মুসলিম হওয়া এবং মুসলিম হিসেবে বাঁচা এক জিনিস নয়। আমি শিখেছি যে মুসলিম শব্দটি কোনো নামবাচক শব্দ নয়, বরং এটি ক্রিয়াবাচক শব্দ।”
এরপর ২০০১ সালে জামাল রেকর্ডসের ব্যানারে জাইন বিখা বের করেন তার নতুন অ্যালবাম ‘ফেইথ’। এই অ্যালবামের গানগুলো দুঃখ-কষ্ট বা সুখ সকল আবেগীয় অবস্থায় আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ রাখার বার্তা নিয়ে রচিত। এই অ্যালবামে তার সাথে গলা মেলান আরেক বিখ্যাত শিল্পী দাউদ হোয়ার্ন্সবি আলী।
২০০২ সালে প্রকাশিত হয় জাইন বিখার অ্যালবাম ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড’। সকল সংস্কৃতি, ভাষা আর ঐতিহ্যের মানুষের কাছে মহান আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন- নতুন অ্যালবামের গান এই বিষয়কে সামনে রেখে লেখা হয়েছে। এই অ্যালবামে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিষেক ঘটে জাইন বিখার বড় ছেলে রাশীদ বিখার।
২০০৫ সালে জাইন বিখা চালু করেন তার নিজস্ব স্টুডিও ‘জাইন বিখা স্টুডিওস’। আগের রেকর্ড কোম্পানির ব্যানারেই নিজের স্টুডিওতে গেয়ে চললেন জাইন। নিজের স্টুডিও থেকে প্রকাশিত প্রকাশিত হয় তার প্রথম অ্যালবাম ‘মাউন্টেন অফ মক্কা’। তিনি এই অ্যালবামের গানগুলো লেখার অনুপ্রেরণা পেয়ছিলেন ২০০৪ সালে তার পবিত্র হজ্জ্বে গমন থেকে।
জাইন বিখা সাধারণত একটিমাত্র তবলার সাথে গান গান। তার ব্যাকিং ভোকালিস্ট হিসেবে থাকেন চারজন শিল্পী। তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় ডিজনির সিনেমা ‘দ্য লায়ন কিং’ এ কন্ঠ দিয়েছিলেন।
২০১৪ সালে জাইন বিখা তার নাশীদ ক্যারিয়ারের বিশ বছর পূর্ণ করেন। এর মাঝে তিনি অসংখ্য গান লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেন। স্থান করে নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকাসহ পুরো পৃথিবীর ইংরেজী ভাষাভাষী মুসলিমদের হৃদয়ে। হয়েছেন কত মুসলিমের অনুপ্রেরণা এবং আনন্দের উৎস। জাইনের আরেকটি বড় অর্জন আছে। তিনি বেশ কয়েকবার বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিমের তালিকায় নাম লিখেয়েছেন।
একবার দুবাই আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের বড় বড় নেতা, পন্ডিত ও দাশনিকদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পান তিনি।
জাইন বিখা অবশ্য তার নাশীদ ক্যারিয়ারকে ঠিক ক্যারিয়ার বলতে রাজী নন। কারণ তিনি নাশীদ গাওয়াকে পেশা হিসেবে নেননি কখনো। তিনি বরং তার বাবার সাথে ব্যবসার কাজ করার পাশাপাশি নাশীদ চর্চা করেন বললেই ভালো মানায়। মুসলিম লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন একুইলা স্টাইলের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমার করা সবচেয়ে ভাল কাজগুলোর একটা হচ্ছে নাশীদকে পেশা হিসেবে না নেয়া। আপনি যদি কোনো শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গিকে বিশ্বাসের সাথে সমন্বয় করতে চান তাহলে আপনার প্রকৃত ইচ্ছা গুড়িয়ে যাবে।” তিনি বলেন, “আমি যখন নাশীদ শুরু করি তখন আমি ভাবিনি এত সাড়া পাব, এত অ্যালবাম বিক্রি হবে বা মানুষ গান শুনতে সারাবিশ্ব থেকে আমাকে আমন্ত্রণ করবে। এখন তো ব্যাপারটা পপ স্টারের পর্যায়ে চলে গেছে। আমি এটা পছন্দ করি না। সঙ্গীত মানুষ হিসেবে আপনার অনুভূতির প্রকাশ হতে পারে, হতে পারে অনুপ্রেরণার একটা মাধ্যম, কিন্তু কোনোভাবেই বিনোদন নয়”।
তিনি কেন নাশীদই গান এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমি মনে করি আমার গান আমার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। আমাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়া। আমি মনে করি গান সেই আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির একটি উপায় হতে পারে। কিন্তু সঙ্গীতই যদি আপনার জীবন হয়ে যায়, তাহলে সেটাতে আর আধ্যাত্মিকতা থাকে না। আমি মনে করি আমাদের জীবনটা এমন হওয়া উচিত না। জীবন একটা আধ্যাত্মিক যাত্রা এবং স্রষ্টার কাছাকাছি হওয়া।”
জাইন বিখা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে বেশ ভাবেন। তিনি বোঝেন যে চারদিক থেকে অপসংস্কৃতির বিপদ তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। তিনি মনে করেন সৃজনশীল কাজকর্মের মাধ্যমে এসবের বিকল্প তৈরি করা জরুরি। তিনি ‘আরবান পয়েট’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির চিন্তা করছেন, যেখান সারাবিশ্বের তরুণরা এসে গান গাইবে, গান লিখবে, রেকর্ড করবে।
জাইন বিখা নিজেও চার সন্তানের জনক। তার বড় ছেলে রাশীদ বিখার বয়স ১৭ বছর। ছেলের সাথে রয়েছে তার প্রগাঢ় মমতার বন্ধন। তিনি এমিল ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা একে অপরের প্রতি সৎ এবং পরস্পরের সাথে খোলা মনে কথা বলি। আমি তার জীবন, তার চ্যালেঞ্জের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকি। আমি তার ফুটবল ট্রেনিং সেশন এবং খেলাধুলাতেও আগ্রহের সাথে অংশগ্রহণ করি। আমি তাকে বিশ্বাসকে বৃহৎ সীমানার মধ্যে ভাবতে, বড় পরিসরে জীবনকে দেখতে এবং সব মানুষকে শ্রদ্ধা করতে বলি।”
একজন মানুষ হিসেবে, বাবা হিসেবে এবং সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে জাইন বিখা নিঃসন্দেহে এই সময়ের আদর্শ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তার ইসলামী সঙ্গীতযাত্রা সচল থাকুক।
ফিচার ইমেজ – Genius