যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘কোন খাবারের পুষ্টিগুণ সবচেয়ে বেশি?’ নিশ্চয়ই উত্তর দিবেন শাকসবজি, ডিম-দুধ, মাছ, মাংস অথবা ফল। না, এই খাবারগুলো যথেষ্ট পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হলেও এর কোনোটিই পুষ্টিগুণ তালিকার শীর্ষে নেই। উত্তর শুনলে আপনিও হয়তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য যে, সবচেয়ে বেশি পুষ্টির সন্ধান মিলবে শুঁয়োপোকা থেকে। চমকে উঠলেন কি? পুষ্টির অভাব পূরণে সাম্প্রতিক সময়ে এমন তথ্যই দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের তথ্যমতে, বর্তমানে আমরা যেসব পুষ্টিকর খাবার খাই, তাতে আমাদের পর্যাপ্ত পুষ্টি মেলে না। এমনকি বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে মাছ, মাংসের উৎপাদন মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়। তাই খাদ্য তালিকায় প্রোটিনের অভাব পূরণে শুঁয়োপোকার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন।
শুঁয়োপোকার জীবনচক্র
শুঁয়োপোকা শব্দটি শুনলেই আমাদের মাঝে একটি ভীতিকর অবস্থার তৈরি হয়। অথচ রঙ বেরঙের প্রজাপতি ধরতে তাদের পেছনে ছোটেনি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, শুঁয়োপোকারই পরিণত রূপ প্রজাপতি। জীবনচক্রে শুঁয়োপোকার পাঁচটি ধাপ পাওয়া যায়। সেগুলো হলো ডিম, শুঁয়োপোকা, গুটিপোকা, পিউপা এবং পরিণত প্রজাপতি।
স্ত্রী প্রজাপতি সাধারণত পাতার উপর ডিম পাড়ে এবং এই ডিম থেকে শুঁয়োপোকার জন্ম হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে। ডিমগুলো আঠালো পদার্থ দ্বারা পাতার সাথে যুক্ত থাকে, ফলে নিচে পড়ে যায় না। অনবরত খাদ্য গ্রহণের কারণে শুঁয়োপোকার বৃদ্ধিও বেশি হয়। শুঁয়োপোকা থেকে গুটিপোকায় পরিণত হতে এদের সাধারণত পাঁচ দিন সময় লাগে। তখন এগুলো ককুনের মধ্যে অবস্থান করে। ককুন থেকে সপ্তাহখানেকের মাঝেই পরিণত প্রজাপতির জন্ম হয়। তবে উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে ককুনের মধ্যে এরা মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতে পারে। প্রজাপতির এই অবস্থাকে ‘নিষ্ক্রিয় অবস্থা’ বলা হয়। জীবনচক্রে গুটিপোকায় পরিণত হওয়ার পূর্বেই শুঁয়োপোকাগুলো খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
পুষ্টিগুণে খাদ্যতালিকায় শুঁয়োপোকা
খাদ্যের তালিকায় যুক্ত হওয়ায় শুঁয়োপোকার চাহিদা ইউরোপ, আফ্রিকার দেশগুলোতে অনেক হারে বেড়েছে। কিন্তু শুঁয়োপোকা সংগ্রহ নিতান্ত সোজা কাজ নয়। ঘন জঙ্গলে পাম গাছের ডাল থেকে এগুলো সংগ্রহ করা বেশ কঠিন কাজ। ফলে প্রাকৃতিক প্রজননের বাইরেও শুঁয়োপোকা চাষ শুরু করেছে এই দেশগুলো। মধ্য আফ্রিকায় শুঁয়োপোকা প্রোটিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার হিসাবে পরিচিত। রীতিমত চড়া দামে বিক্রি হয় সেগুলো বাজারে। সেখানে এক ঝুড়ি শুঁয়োপোকার দাম প্রায় ৪ ডলার।
আফ্রিকা মহাদেশের ক্যামেরুনে শুঁয়োপোকাকে প্রোটিনের অন্যতম বাহক ধরা হয়। রান্না করা অথবা ভাজা তাদের খাদ্যতালিকায় শুঁয়োপোকার বিভিন্ন পদের সমাবেশ থাকে নিত্যদিন। ক্যামেরুনে প্রায় প্রতি তিনজনের একজন অপুষ্টিতে ভোগে। তাই ক্যামেরুনের বিজ্ঞানীগণ শুঁয়োপোকাকে খাদ্যতালিকায় যুক্ত করলে তাদের পুষ্টিহীনতা দূর হবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন।
শুঁয়োপোকার উৎপাদন বাড়াতে বর্তমানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি লাভ করেছে। শুরুতে সকলের জানা না থাকলেও এখনকার চাষীরা এ পদ্ধতিতে কম পরিশ্রমে সহজেই চাহিদা মাফিক শুঁয়োপোকা উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে। লিভিং ফরেস্ট ট্রাস্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা জন মোয়াফোর নতুন প্রকল্প সম্পর্কে বলেন, “আমরা যখন প্রথম এই ধারণা নিয়ে আসি তখন স্থানীয় লোকজন আমাদের বিশ্বাসই করছিলেন না। কিন্তু পরে তাদের কাছে মূল বিষয়টি উপস্থাপন করার পর তারা আশ্বস্ত হন”। নতুন এই পদ্ধতিতে শুঁয়োপোকার উৎপাদনে প্রয়োজন একটি প্লাস্টিক বক্স, যার উৎপাদন সাধারণ পদ্ধতিতে উৎপাদনের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ।
পরবর্তীতে সমীক্ষার সময় একজন চাষী মিশায়েল সোনগুই চাষের নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, “এ প্রক্রিয়ায় আমার সময় বেঁচেছে। আমি এখন মাসে মাত্র চারবার জঙ্গলে যাই। কিন্তু আগে হয়তো প্রতিদিনই আমাকে জঙ্গলে যেতে হতো। বাক্সের মধ্যে পাম গাছের ডালগুলো প্রক্রিয়াজাত করে রেখে দেওয়ার পর সেখানে আমার অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ারও কোনো প্রয়োজন হয় না। আমার অনেক সময় বেঁচে যাচ্ছে। এভাবে পাম গাছ থেকে শুঁয়োপোকা উৎপাদন করে আমি খুবই খুশি”।
এসব দেশে শুঁয়োপোকার পাশাপাশি ফড়িং, ঘাস পোকা, ঝিঁঝিঁ পোকা, উইপোকা এবং অনান্য পোকামাকড়ও পুষ্টিকর খাবার হিসাবে সমান জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। স্কটল্যান্ডে এসব পোকামাকড় বিশেষভাবে প্রক্রিয়াকরণ করে খাওয়ার উপযোগী করে তোলা হয়। তাদের মতে, পোকামাকড়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা আবশ্যক। তাই অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ভিতর পোকা মিশ্রণ করে সুস্বাদু খাবার তৈরি করছে যাতে চোখে না দেখে পোকামাকড় খাওয়ার অভ্যাস তৈরি সম্ভব হয়। তাহলে পরবর্তীতে স্বাচ্ছন্দ্যে তারা এসব খাবার উপভোগ করবেন।
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার একটি বেকারীতে সম্প্রতি পোকামাকড় দিয়ে তৈরি কেক দেখা গেছে। পোকামাকড় প্রক্রিয়াজাত করে কেকের উপর ছড়িয়ে অথবা কেক তৈরির মিশ্রণে পোকা মিশিয়ে কারিগররা বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন খাবার তৈরি করছেন।
গত বছর ইউরোপে একটি প্রতিবেদনে বিশ্বের ক্রমবর্ধমান পুষ্টি চাহিদায় মাছ, মাংসের বিকল্প হিসেবে পোকামাকড়ের উপকারিতা সম্পর্কে জনগণকে উৎসাহিত করা হয়। তারপর থেকে বিভিন্ন পোকামাকড়ের সংমিশ্রণে তৈরি খাবার জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য পোকা খাওয়ার বিষয়টি এলিয়েন কালচার মনে হলেও এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষের প্রধান প্রোটিনের উৎস এই পোকামাকড়”। ভবিষ্যতে এটাই আরো বেশি সংখ্যক মানুষের পুষ্টি যোগাতে ভূমিকা রাখতে চলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে মানুষের প্রোটিনের যে চাহিদা ছিল বর্তমানে তা অনেক হারে বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ২০৩০ সালে সেটা আরো ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি লাভ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তখন প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য মানুষকে পোকামাকড়ের উপরই নির্ভরশীল হতে হবে।
২০১৩ সালে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে পোকামাকড় চাষের উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ইতিমধ্যেই ইউরোপিয়ান কমিশন ‘প্রোটইনসেক্ট’ নামক একটি প্রজেক্ট চালু করেছে। এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের খাদ্য উপযোগী পোকামাকড় চিহ্নিতকরণ এবং সেই সাথে পরিবেশের যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। বর্তমানে ‘মিনেভরা কমিউনিকেশন ইউকে’ নামক প্রকল্পও এর সাথে কাজ করছে।
তবে বিশেষজ্ঞেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে। তারা ধারণা করছেন, প্রকৃতিতে এমন কিছু পোকামাকড় আছে যেগুলো মানুষের পাকস্থলী হজমে সক্ষম নয় অথবা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে ইউরোপীয়ান খাদ্য নিরাপত্তা কমিশন আশ্বস্ত করেছে এ বিষয়ে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানুষ ক্রমশ মাংস কিংবা মাছ যেভাবে প্রক্রিয়াকরণ করে খেতে শিখেছে, সেভাবেই এসব পোকামাকড়কে খাদ্য উপযোগী করে তোলা হবে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা থাকবে না এবং সেই সাথে তাদের প্রোটিনের অভাবও পূরণ হবে।
বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় পোকামাকড়, বিশেষ করে শুককীট বা শুঁয়োপোকার উপস্থিতি তাদের প্রয়োজনীয় প্রোটিন ঘাটতি মেটাতে সক্ষম, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে। ধীরে ধীরে এর গ্রহণযোগ্যতা সীমিত কিছু দেশ ছাড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীতে জনপ্রিয়তা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইমেজ ফিচার- panoramio.com