দেখা যাচ্ছে, আপনি দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। কোনো কাজে যে ডুবে আছেন ব্যাপারটা এমন নয়, বরং আপনি খানিকটা বিরক্ত হয়েই আছেন। না হচ্ছে কোনো কাজ, আবার না পারছেন মনঃসংযোগ অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে। ক্লান্তি, হতাশা আর মন খারাপ- সবই আপনাকে পেয়ে বসেছে। ক্লান্তি কেবল আপনাকে শারীরিকভাবে বিধ্বস্তই করে ফেলে না, সেই সাথে মানসিকভাবেও ভেঙে পড়তে মদত দেয়।
শুধুমাত্র এক কাপ কফি বা চা আপনার শরীর ও মনকে নিমিষে চাঙ্গা করে তুলবে এই ভাবনা মাথায় আসার আগে আপনাকে জানিয়ে রাখা ভালো যে, এমন কিছু স্বাস্থ্যকর খাবারও রয়েছে যা আপনার সুস্থ মানসিক ও শারীরিক বিকাশ সাধনের পাশাপাশি আপনার মনকে করবে ফুরফুরে এবং ক্লান্তি ও অবসাদকে রাখবে দূরে। আজকের আর্টিকেলটি এমনই কিছু খাবার নিয়ে সাজানো, যা আপনার ‘মুড বুস্টার’ হিসেবে কাজ করবে।
হট চকলেট
২০১৩ সালের মে মাসে ‘দ্য জার্নাল অফ সাইকোফার্মালোজি’-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানানো হয়, এক মাসের জন্য প্রতিদিন এক গ্লাস করে হট চকলেট পানীয় পান করার ফলে পানকারীদের মধ্যে মানসিক ও জ্ঞানীয় সুফল লাভ করতে দেখা যায়।
চকলেটে পলিফেনল নামের এক প্রকারের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বহন করে যা আমাদের মন ও মেজাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। গবেষণাকালীন সময়ে ৭৫ জন মহিলাকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে পলিফেনল সমৃদ্ধ চকলেট পানীয় পান করানো হয়, যেমন ০ এমজি, ২৫০ এমজি এবং ৫০০ এমজি। দেখা যায় যে সর্বাধিক পলিফেনল সমৃদ্ধ পানীয় পানকারীদের মধ্যে অনেক বেশী ফুরফুরে মেজাজ, শান্ত মন এবং আরও সৃজনশীল মানসিকতা লক্ষ্য করা গিয়েছে।
ডিম
হাতের কাছেই পাওয়া যায় এমন একটি খাবার হচ্ছে ডিম। বিশেষ করে ডিমের কুসুম আরও একটি অন্যতম খাদ্য মন চাঙ্গা করার জন্য। ডিম ভিটামিন ডি-তে ভরপুর। আর গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ভিটামিন ডি মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন ডি মস্তিকে সেরোটোনিন উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে যা আমাদের অন্যতম মানসিক ব্যাধি ‘মন খারাপ’কে তাড়াতে সাহায্য করে। শুধু এটাই নয়, ডিম হচ্ছে ভিটামিন বি, আয়রন ও প্রোটিনের এক দারুণ উৎস। এই পুষ্টি উপাদানসমূহ খাবারকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে, যা তাৎক্ষণিক শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে আপনাকে মুহূর্তেই শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা করে তুলবে। আপনি যদি সকালের নাস্তায় একটি ডিম রাখেন, তাহলে সারাদিন ধরে এটি আপনাকে শক্তি যোগাবে।
ওটস
ওটস আরও একটি কার্যকরী মুড বুস্টিং খাদ্য, কারণ এতে রয়েছে Low Glycaemic Index উপাদানের উপস্থিতি। এটি রক্তে শক্তি সরবরাহ করে এবং রক্তে সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণে রেখে আমাদের মানসিক স্থিরতা বজায় রাখে। এছাড়া ওটস মন চাঙ্গাকারী উপাদান সেলেনিয়াম বহন করে। সারাদিন সুন্দর কাটাতে সকাল শুরু করতে পারেন অর্ধেক বাটি ওটস দিয়ে। স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করতে এর সাথে মধু, বাদাম বা দই যোগ করতে পারেন।
গ্রিন টি
হাজার হাজার বছর ধরে গ্রিন টি এর নিজস্ব নানাবিধ উপকারিতার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রিন টি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যামিনো অ্যাসিড এবং থাইনিন এ সমৃদ্ধ, যা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমানোর জন্য পরিচিত। নিউট্রিশিয়ানরা সুপারিশ করেন, ফুরফুরে মেজাজ, মনোযোগ বৃদ্ধি এবং আরো ভালো স্মৃতিশক্তির জন্য প্রতিদিন এক কাপ গ্রিন টি পান করা উচিত। যেহেতু এতে ক্যাফেইন রয়েছে, তাই সবচেয়ে ভালো হয় যদি সকালে অথবা দুপুরে এটা পান করা হয়।
দই
দইয়ে রয়েছে অ্যামিনো অ্যাসিড ট্রিপ্টোফ্যান, যা মুড বুস্টিং উপাদান সেরোটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে আপনার মন ও শরীরকে শান্ত রাখে। তাছাড়া দই প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়ামে সমৃদ্ধ যা কিনা দুধে থাকা ক্যালসিয়াম থেকে বেশী। ক্যালসিয়াম এমন একটি পুষ্টি উপাদান যা আপনাকে সারাদিনের দৌড়ঝাঁপের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি দিতে সক্ষম। শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি থাকলে ক্লান্তি, অবসাদ, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ পেয়ে বসে। তাই নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে দই খাবার তালিকায় রাখতে ভুলবেন না।
ফল
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের পুষ্টি বিষয়ক এক জার্নালে জানানো হয়, আপনি যত বেশী তাজা ফলমূল খাবেন, মানসিকভাবে আপনি তত প্রাণবন্ত থাকবেন। ফল ভিটামিন, খনিজ এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস সমৃদ্ধ যা প্রাকৃতিকভাবেই মনকে চাঙ্গা করে। বিভিন্ন ধরনের ফল, বিশেষ করে বেরি জাতীয় ফলগুলো বিষণ্ণতা ও ক্লান্তি দূর করতে দুর্দান্ত।
সবজি
প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের সবজি, বিশেষ করে সবুজ শাকসবজি ও আঁশযুক্ত মূল জাতীয় সবজি খেতে হবে। সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড থাকে যা বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ কমানোর পাশাপাশি ক্লান্তিবোধ দূর করে শরীর ও মনকে ফুরফুরে রাখে। অপরদিকে মূল জাতীয় সবজি, যেমন গাজর, যখনই সময় পাবেন একটি গাজর নিয়ে চিবুতে থাকুন। গাজরের ফাইবার, মিনারেলস ও ভিটামিন আপনাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করবে। ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা দূরে রাখতে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় দুই থেকে তিন কাপ পরিমাণ সবজি অবশ্যই রাখুন।
মাছ
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী ক্লান্তি ও বিষণ্ণতার সাথে যুদ্ধ করতে মাছ হচ্ছে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্য। অ্যান্টি-ডিপ্রেসিভ গুণাবলীর কারণে ঐতিহ্যগতভাবে কিছু দেশে, যেমন ভূমধ্যসাগরীয়, জাপানী ও নরওয়ের খাবারে মাছ বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ গ্রহণ করা ব্যক্তিদের মধ্যে তুলনামূলক কম বিষণ্ণতা এবং বেশী ইতিবাচক চিন্তাসম্পন্ন মনোভাব লক্ষ্য করা যায়।যেমন স্যামন মাছ অত্যাধিক ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ, সাথে বোনাস হিসেবে রয়েছে ভিটামিন বি-১২ যা মস্তিস্কে এমন ধরনের কেমিক্যাল সরবরাহ করে যা আপনাকে মানসিকভাবে চনমনে অনুভূত করতে সাহায্য করে। জানিয়ে রাখা ভালো যে, শরীরে ভিটামিন বি-১২ সঙ্কট মানেই তা বিষণ্ণতা ও ক্লান্তিবোধের কারণ।
পানি
আমরা সবাই জানি ‘পানির অপর নাম জীবন‘, তাই বুঝতেই পারছেন মন আর শরীর সুস্থ রাখতে পানির কোনো বিকল্প নেই। যদিও পানি খাদ্য নয়, তবে পানি আমাদের মস্তিষ্ক পরিচালনায় একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে।
দ্য আমেরিকান ফুড সেফটি অথোরিটি সুপারিশ করে, প্রতিদিন আমাদের কমপক্ষে ২ লিটার পানি পান করা উচিত। পর্যাপ্ত পানি পান না করার ফলে আমাদের মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং শেখার আগ্রহ ও ক্ষমতা সবকিছুই লোপ পায়। এমনকি শরীরে সামান্য পরিমাণ পানি স্বল্পতা আমাদের মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলে এবং সেটা অবশ্যই নেতিবাচক। তাই মনকে চাঙ্গা করার জন্য খাবারের তালিকা নিয়ে বসার আগে নিশ্চিত করুন আপনি সারাদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করছেন কিনা।
আপনার সুন্দর মন খারাপ হয়ে যাওয়া এড়াতে যে খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত
ক্যাফেইন
এটা সত্যি যে ক্যাফেইন আপনাকে প্রথমে খুব চনমনে অনুভব করতে সাহায্য করে, কিন্তু প্রতিনিয়ত অতিমাত্রায় ক্যাফেইন গ্রহণ করার ফলে পরবর্তীতে ডিহাইড্রেশন, মাথাব্যথা, মানসিক অস্থিরতা ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
সুগার
অতিরিক্ত সুগার যেমন আমাদের শরীরের জন্য ভালো নয়, ঠিক তেমনি এটি মানসিক সুস্থতার জন্যও হুমকিস্বরূপ। সহজ করে বলতে গেলে, সুগার রক্তে শর্করার মাত্রা খানিকটা রোলার কোস্টারে চড়িয়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় নিয়ে যায়, যা আমাদের মন-মেজাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই অতিরিক্ত সুগার গ্রহণ করা মানেই হচ্ছে নিজেকে মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দেওয়া।
অ্যালকোহল
অ্যালকোহল সাময়িকভাবে আপনাকে যাবতীয় দুশ্চিন্তা, হতাশা আর ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেবে ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে আপনাকে ঠিক কতটা উদাসীন, ভীতিকর ও উদ্বিগ্ন আগামীর মধ্যে ফেলবে সেটা নতুন করে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সুস্থ-সুন্দর এবং চনমনে সময় কাটাতে চান, তাহলে অবশ্যই অ্যালকোহলকে না বলুন।
ফিচার ইমেজ: greenblender.com