আজ আমরা এমন একটা খাবার নিয়ে কথা বলবো যেটা আমাদের অনেক তীব্র অপছন্দ এবং অনেকের এতই পছন্দ যে নাম শুনলেই জিভে জল আসে। পাঠক বোধহয় আন্দাজ করে ফেলেছেন খানিকটা। হ্যাঁ , আমি শুটকির কথাই বলছি। শুটকির তীব্র গন্ধে কারো কারো নাড়িভুঁড়ি উপড়ে আসার উপক্রম হয়, কেউবা শুঁটকির কথা শুনলে শুটকির নানা পদের কথা বলতে থাকেন আর জিভ বেচারাকে লালার সাগরে ভাসিয়ে দেন। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এটা স্বীকৃত যে, শুঁটকি মাছে জীবিত মাছের চেয়ে বেশি পরিমাণ পুষ্টি থাকে। আজ আমরা শুঁটকির কয়েকটি রেসিপি নিয়ে কথা বলবো।
প্রথমেই জেনে নেই শুটকি কিভাবে তৈরি করা হয়। শুঁটকি মাছকে দুইটা ভিন্ন সংরক্ষণ প্রকিয়ায় তৈরি হয়, একটা রোদে শুকিয়ে অপরটি হল মাটির নিচে পুঁতে রেখে ব্যাকটেরিয়া ব্রিড করে। চ্যাপা শুঁটকি দ্বিতীয় ভাবে তৈরি হয়। তাই এটা পুরোপুরি শুঁটকি না হয়ে খানিকটা মাংসল থাকে যা বিকট দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে।
চ্যাপা শুটকি ভর্তা
প্রয়োজনীয় উপকরণঃ ৭/৮ টা চ্যাপা শুঁটকি (খুব ভাল করে ধুবেন, গায়ের ছোট ছোট আঁশ ভাল করে পরিষ্কার করবেন, চাইলে কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে পারেন। এতে করে আঁশগুলো দ্রুত উঠে যাবে), ১৫-১৬ টা দেশি পেঁয়াজের কুঁচি, ১০-১২ টা রসুন কুঁচি (কোয়াগুলো গোল গোল করে কাটলেই হবে।),পরিমাণ মত হলুদ, লবণ, মরিচ এবং তেল।
প্রস্তুত প্রণালীঃ প্রথমে তেলে পেঁয়াজ আর রসুন ঢেলে বেশ খানিকক্ষণ নাড়ুন। গোশত রান্নার সময় পেঁয়াজ যতক্ষণ রাখতে হয়, তার দেড়গুণ বেশি সময়। হালকার চেয়ে একটু বেশি বাদামী রং এবং সিদ্ধ হয়ে, নরম হয়ে যাবে। তখন হলুদ, মরিচ আর লবন দিয়ে আরও কিছুক্ষণ নাড়ুন। তারপরে শুঁটকি দিয়ে দিন। এর পরে আবারও নাড়ুন। ঢেকে রেখে দিন, একটু পর পর খুলে আবারও নাড়ুন। কিছুক্ষণ পরে যখন পুরোটার রং গাঢ় বাদামী হয়ে যাবে, শুঁটকি, পেঁয়াজ, রসুন কিছুই আলাদা করে চেনা যাবে না এবং পেঁয়াজ আর মসলা থেকে তেল আলাদা হয়ে ভেসে উঠবে, তখন নামিয়ে ফেলুন। পরিবেশন করুন গরম ভাতের সাথে ধনিয়া পাতা কুচি দিয়ে।
লইট্টা শুঁটকি ভুনা
প্রয়োজনীয় উপকরণঃ লইট্টা শুঁটকি ১৫০-২০০ গ্রাম, টমেটো বাটা ১ কাপ, পেঁয়াজ কুচি ৪ কাপ, রসুন মোটা কুচি দেড় কাপ, হলুদ গুঁড়া ১ চা-চামচ, লাল মরিচ গুঁড়া ২ চা-চামচ, আদা বাটা ১ চা-চামচ, রসুন বাটা ১ চা-চামচ, লবণ স্বাদ অনুযায়ী, চিনি দেড় চা-চামচ, কাঁচা মরিচ ফালি ইচ্ছামতো, তেল ১ কাপ।
প্রণালিঃ শুঁটকি প্রতিটি ৩-৪ টুকরা করে কেটে শুকনো তাওয়ায় ভালো করে টেলে নিন। ঘণ্টা খানেক কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। তারপর গরম পানি দিয়ে ভালো করে বারকয়েক ধুয়ে নিন। পানি ঝরিয়ে পাটায় সামান্য থেঁতো করে মাঝখানের মোটা কাঁটা ফেলে দিন।
তেল গরম করে ২ কাপ পেঁয়াজ কুচি ও প্রয়োজনমত লবণ দিয়ে ভাজুন। পেঁয়াজ খানিকটা মজে এলে বাকি পেঁয়াজ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেজে চিনি, টমেটো বাটা এবং লাল মরিচের গুঁড়া দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিন। এবার সামান্য পানি এবং লবণ দিয়ে নাড়ুন। কাঁচা মরিচ ও রসুন বাদে অন্যান্য মসলা দিয়ে অল্প পানি দিয়ে কষিয়ে নিন। তারপর শুঁটকিগুলো দিন। এবার রসুন কুচি ও কাঁচা মরিচ ফালি দিয়ে নেড়ে ঢেকে দিন। সাত-আট মিনিট পর নেড়ে আঁচ কমিয়ে দিন। ভুনা ভুনা হয়ে এলে আরও একবার নেড়ে ঢেকে দিয়ে পাঁচ মিনিট পর চুলা বন্ধ করে দিন। পাত্রে বেড়ে ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
নুনাঝুরি
প্রয়োজনীয় উপকরণঃ নুনা শুঁটকি ২৫০ গ্রাম, মরিচ গুঁড়া ২ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ কুচি দেড় কাপ, রসুন মোটা করে কাটা আধা কাপ, হলুদ গুঁড়া আধা চা চামচ, কাঁচামরিচ চেড়া ৪-৫টি, লবণ স্বাদমতো, তেল আধা কাপ।
প্রস্তুত প্রণালীঃ নুনা শুঁটকি পরিষ্কার করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। শুঁটকির মাঝের মোটা কাঁটাগুলো টেনে ফেলে দিন। এবার কিচেন সিজার দিয়ে শুঁটকির টুকরোগুলো আড়াআড়িভাবে যতটুকু সম্ভব চিকন করে ঝুরি করে নিন। যাতে ছোট কাঁটাগুলো ভালোভাবে কেটে যায়। এবার কড়াইয়ে তেল দিয়ে পেঁয়াজ-রসুন কুচি দিয়ে ভাজুন। ভাজা হলে হলুদ-মরিচ গুঁড়া সামান্য পানি দিয়ে কষিয়ে নিন। শুঁটকি দিয়ে আবার ভুনতে থাকুন। প্রয়োজন হলে সামান্য লবণ দিন। কাঁচামরিচ দিন। ভুনা ভুনা হয়ে তেল ছেড়ে এলে নামিয়ে ফেলুন। গরম ভাত বা ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে পরিবেশন করুন। তবে সাথে খানিকটা ডাল থাকলে খেতে ভাল লাগবে আশা করি।
মসুরের ডাল ও কাঁচকি শুঁটকি চচ্চড়ি
প্রয়োজনীয় উপকরণঃ মসুর ডাল ১ কাপ, কাঁচকি শুঁটকি ১০০ গ্রাম, মরিচ গুঁড়া ২ টেবিল চামচ, হলুদ গুঁড়া ১ চা চামচ, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ, রসুন কুচি এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ, ধনে গুঁড়া ১ চা চামচ, আদা বাটা ১ চা চামচ, তেল এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ, ফিস সস ১ চা চামচ, কাঁচামরিচ ৬টি, পানি ২ কাপ, লবণ স্বাদমতো।
প্রস্তুত প্রণালীঃ শুঁটকি পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন। ডাল বাদামি বাদামি করে ধুয়ে ভেজে রাখুন। কড়াইয়ে তেল গরম হয়ে এলে পেঁয়াজ-রসুন কুচি ভেজে গুঁড়া ও বাটা মসলা দিন। সামান্য লবণ দিন। সামান্য পানি দিয়ে মসলা কষিয়ে নিন। মসলা ভালোমতো কষানো হলে কাঁচকি শুঁটকি দিন। শুঁটকি কষিয়ে এক কাপের চার ভাগের এক ভাগ পানি দিয়ে ঢেকে দিন। পানি শুকিয়ে গেলে ভাজা ডালগুলো দিয়ে দিন। নেড়েচেড়ে দেড় কাপ পানি দিয়ে ঢেকে চুলার আঁচ কমিয়ে দিন। মাখামাখা হলে চেড়া কাঁচামরিচ দিয়ে ঢেকে দিন। ডাল সিদ্ধ হয়ে পানি শুকিয়ে গেলে নামিয়ে নিন। পরিবেশন করুন গরম ভাতের সঙ্গে অথবা খিচুড়ির সাথে। খেতে পারেন বর্ষণক্লান্ত কোন একদিনে।
চ্যাপা শুঁটকির বাগার ভর্তা
প্রয়োজনীয় উপকরণঃ চ্যাপা শুঁটকি ১০-১২টি, দেশি পেঁয়াজ ১০-১১টি, দেশি রসুন ২/৩টি, শুকনা মরিচ ১২টি, সয়াবিন তেল সিকি কাপ, লবণ স্বাদমতো।
প্রস্তুত প্রণালিঃ শুঁটকি ১০-১৫ মিনিট ভিজিয়ে রেখে মাথা ও আঁশ ছাড়িয়ে পেট পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে। পূর্বের মতো কুসুম গরম পানিতে ভাল করে ধুয়ে নিতে পারেন। শুঁটকির পানি নিংড়ে সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে পাটায় মসৃণ করে বাটতে হবে। ফ্রাইপ্যানে তেল গরম করে বাটা উপকরণগুলো অল্প আঁচে পাঁচ মিনিট নেড়েচেড়ে ভাজতে হবে। তেল ওপরে এলে ভর্তা চুলা থেকে নামিয়ে বাটিতে পরিচ্ছন্নভাবে পরিবেশন করুন।
কাঠালের বিচি শুঁটকি
প্রয়োজনীয় উপকরণ: কাঁঠালের বিচি আধা কাপ, শুঁটকি মাছ ১/২ কাপ, রসুন কাটা আধা কাপ, পেঁয়াজ কুচি আধা কাপ, রসুন বাটা এক চা চামচ, মরিচের গুঁড়া ১ চা চামচ, হলুদ সামান্য, কাঁচামরিচ ফালি ৪-৫টি, তেল আধা কাপ, লবণ স্বাদ অনুসারে, জিরার গুঁড়া ১ চা চামচ, ধনে গুঁড়া আধা চা চামচ।
প্রণালী: শুঁটকি মাছ কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কাঁঠালের বিচি ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে নিতে হবে। এবার কড়াইয়ে তেল দিয়ে রসুন কুচি দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে একে একে সব মসলা দিয়ে কষিয়ে শুঁটকি ও বিচি দিয়ে কষাতে হবে। খুব ভালো করে দুবার কষিয়ে তেলের ওপর উঠলে নামিয়ে নিন। গরম ভাতে এবং লাউএর শাকের সাথে পরিবেশন করতে পারেন।