ডানো। বাংলাদেশে এটি যেন শুধু একটি গুঁড়ো দুধের ব্র্যান্ড নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের স্বীকৃতিতে দেশের ‘সেরা মিল্ক ব্র্যান্ড’ হিসেবে সর্বশেষ ৫ বছর টানা প্রথম হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক এই গুঁড়ো দুধের ব্র্যান্ড। কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ ও পুষ্টি গুণাগুণ ধরে রাখতে সক্ষম হওয়ায় বিশ্বব্যাপী আস্থা ও ভরসার প্রতীকে পরিণত হয়েছে এই নামটি। তবে আমাদের কাছে এটি বিশেষ কিছু হয়ে উঠেছে কারণ, এক প্রজন্ম শৈশবে ডানোকে সঙ্গী করে বড় হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে দিয়েছে এটি। আর এভাবে অর্ধ শতাব্দী জুড়ে বাংলাদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ডানোর সাথে।
টেলিভিশনে ডানোর বিজ্ঞাপনে, মুদি দোকানের শেলফে, সুপার শপে কিংবা কারো বাজারের ব্যাগে ডানোর প্যাকেট বা কৌটা দেখলে আমরা সকলেই যেন ক্ষণিকের জন্য শৈশবে ফিরে যাই। ডানোর বিজ্ঞাপন দেখে শৈশবে দেয়ালে দাগ কেটে আমরাও হয়তো নিজেদের উচ্চতা মেপেছি। কিংবা পাউডার ফুরিয়ে গেলে ডানোর কৌটা দিয়ে নাটাই বানিয়ে ঘুড়ি উড়িয়েছি। রাতে ঘুমানোর আগে নিয়ম করে ডানোর এক গ্লাস দুধ পান করেছি, কখনো ইচ্ছায় কখনো মায়ের চোখ রাঙানিতে ।
এভাবেই ডানো মিশে গিয়েছিল আমাদের জীবনে। বুঝতে শেখার আগে থেকে শুরু করে বুঝতে শেখার অনেকটা সময়জুড়ে ডানো ছিল আমাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। ডানোর প্যাকেটের গায়ে আঁকা লাল রঙের মাঝে সাদা রঙে বড় হরফে লেখা ‘ডানো’ লোগোটি কখন যেন আমাদের সবচেয়ে পরিচিত ছবিগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। তাই শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, যৌবন কিংবা বার্ধক্যেও এই ছবিটা আমাদের স্মৃতিতে হয়ে থাকে রঙিন। শৈশবে অনিচ্ছায় দুধ পান করা শিশুটিও বড় হয়ে সাংসারিক জীবনে প্রবেশের পর নিজের শিশুকে ডানোর দুধ পান করাচ্ছে, নিয়মিত গ্রহণ করছে নিজেও। কারণ ডানো যে হয়ে উঠেছে প্রজন্মান্তরের স্মৃতির বাহক, আস্থার প্রতীক, বিশ্বস্ততার অপর নাম।
পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ডেইরি কোম্পানি আরলার একটি নিয়মিত পণ্য ও জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হলো ডানো। শত বছরেরও বেশি আগে ইউরোপের নিজস্ব ডেইরি ফার্মের দুধ দিয়ে যাত্রা শুরু করা আরলার পণ্য ডানোর বাংলাদেশের পথচলাটা ৬০ বছরেরও বেশি সময়ের। এদেশে তাদের ইতিহাসের শুরুটা ছিল ডেনমার্ক ভিত্তিক খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘এমডি ফুডস’-এর একটি পণ্য হিসেবে। শুরুতেই কিছু বড় ব্যবসায়ীর হাত ধরে বাংলাদেশের বাজারে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পৌঁছে গিয়েছিল ডানো। দ্রুতই এদেশের মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায় ডানো। দেশের বাজারে অব্যহত চাহিদা মেটাতে ৮০’র দশকের শেষভাগে বাংলাদেশে নিজেদের লিয়াজো অফিস খোলে এমডি ফুডস। তখন ডানোর একমাত্র আমদানিকারক হিসেবে লাইসেন্স পায় ‘মিউচুয়াল ট্রেডিং লিমিটেড’। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এখন বাংলাদেশেই স্থাপিত হয়েছে গুঁড়ো দুধের প্যাকেজিং কারখানা। এখন ডেনমার্কে উৎপাদিত গুঁড়ো দুধ সরাসরি চলে আসে আমাদের গাজীপুরে, সেখানেই গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকারের প্যাকেটে পূর্ণ করা হয় সেই দুধ। আরলার বৈশ্বিক গুণগত মান বজায় রেখেই বাংলাদেশের কারখানায় চলে এই প্যাকেজিং।
এদেশে আরলা ফুডসের শুরুটা হয় ২০০০ সালে। এমডি ফুডসের সাথে সুইডেনের আরলার একীভবন ঘটে এবং উভয়ে একত্রে আরলা ফুডস নামে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। তবে আগেই বলেছি, আরলার ইতিহাস কিন্তু শত বছরেরও বেশি পুরনো। ১৮৮০’র দশকে প্রায় একই সময়ে ডেনমার্কে এবং সুইডেনে বড় বড় ডেইরি ফার্মগুলো একত্রে ব্যবসা করতে শুরু করে। এই ফার্মগুলো ছিল সম্পূর্ণ খামারিদের মালিকানায়। যতটুকু মুনাফা হতো তা প্রত্যকে লিটার দুধের হিসেবে ভাগ হয়ে চলে যেত খামারিদের হাতে। সেই থেকে সময়ের আবর্তে সুইডিশ আরলা কো-অপারেটিভ আর ড্যানিশ এমডি একত্র হয়ে আরলা ফুডসে পরিণত হলেও বদলায়নি মালিকানার ধরন। আরলা ফুডস এখনো সম্পূর্ণরূপে খামারিদের মালিকানা ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। পনির, মাখন, ইউএইচটি, ইয়োগার্ট, গুঁড়ো দুধ সহ অনেকগুলো পণ্য রয়েছে আরলার। ডানো ছাড়াও আরলার কিছু জনপ্রিয় ব্র্যান্ড রয়েছে যেমন- লুরপাক, ক্যাস্টেলো, পাক, এপেটিনা, কোসিও ইত্যাদি।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বহুজাতিক কোম্পানি আরলা বাংলাদেশে এসে যেন বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানেই পরিণত হয়েছে। ডানো এখন আরলার পণ্য হলেও বাংলাদেশে আরলার পূর্বেই চলে এসেছিল ডানো। তাই ডানোই বাংলাদেশে আরলার প্রতিচ্ছবি। গৌরবময় ইতিহাসের অধিকারী প্রতিষ্ঠানটি আজও সগৌরবে এগিয়ে চলেছে। দেশের সবচেয়ে বড় গুঁড়ো দুধ উৎপাদনকারী হিসেবে ডানো এক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
সম্পূর্ণ ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড মেনে গরুর দুধ সংগ্রহ এবং তা থেকে সর্বোচ্চ মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গুঁড়ো দুধ করে ডানো। এদেশের বিপুল পরিমাণ মানুষের দুধের প্রাপ্যতার চেয়ে পুষ্টির চাহিদা অনেক বেশি হওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের কার্যক্রম প্রসারণের জন্য হাব হিসেবে বাংলাদেশকেই বেছে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এজন্য নিজেদের কার্যক্রম কেবল ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ করে রাখছে না তারা। ব্যবসার বাইরেও কিছু মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এখন এগিয়ে চলেছে ডানো। দেশের অপুষ্টি ও অপর্যাপ্ত ওজনের সমস্যা দূর করতে সরকার ও বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে একত্রে কাজ করতে চায় ডানো। এই মহৎ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হিসেবে ইতোমধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের দুগ্ধ খামারিদের সাথে কাজ শুরু করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। আর এভাবেই অতীত ঐতিহ্য, প্রজন্মান্তরের শৈশবের সাক্ষী আর বর্তমানের গৌরবময় পদচারণায় ডানো শুধু একটি গুঁড়ো দুধের নাম নয়, হয়ে উঠেছে তার চেয়েও বেশি কিছু।