Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দেশ-বিদেশের নানা স্বাদের রুটির গল্প

রুটি মানুষের তৈরি প্রাচীন এক খাদ্য। ধারণা করা হয়, প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই মানুষ রুটি খেয়ে আসছে। গম, যব, জোয়ার প্রভৃতি নানা ধরনের শস্য থেকে তৈরি করা হতো রুটি। তবে যে শস্য থেকে যেভাবেই তৈরি হোক না কেন, রুটি মানুষের আদিতম এক খাদ্যবস্তু। কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই রুটি? কোন দেশে, কোন রুটি বিখ্যাত? সেসব রুটির ইতিহাসও কম আকর্ষণীয় নয়।

প্রথম রুটির প্রচলন শুরু হয় যে দেশে

ধারণা করা হয়, নব্যপ্রস্তর যুগ থেকেই রুটি তৈরির চল শুরু হয়। প্রথমদিকে মোটা দানার শস্য পানির সাথে মিশিয়ে, ঠেস দিয়ে সেই শস্যের ভিজে তাল তৈরি হয়েছিল। তারপর গরম পাথরের ওপর সেই তাল রেখে, উত্তপ্ত ছাই দিয়ে তা সেঁকা হতো। এভাবে সেই নব্য প্রস্তর যুগের আদিম মানুষেরা রুটি তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিল।

তবে বিভিন্ন পুঁথি থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রথম রুটি তৈরি হয়েছিল যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও পূর্বে। আজ থেকে প্রায় ১২,০০০ বছর আগে। ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে প্রথম রুটি তৈরির প্রচলন শুরু হয়। এই মিশরেই শস্য ভাঙা এবং পেষণের জন্য প্রথম পাথরে তৈরি এক যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়, যাকে বলা হয়ে থাকে কোরেন। তবে ৫০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরীয় সভ্যতার মানুষেরা রুটি তৈরিতে আরও একধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। তারা দেখেছিল, ‘ইস্ট’ দিলে রুটিটা বেশ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। মিশরীয়রা প্রথম খেয়াল করেছিল, রুটি তৈরির শ্রেষ্ঠ এক উপাদান হলো গম। যদিও জোয়ার, বাজরা, ভূট্টা এসব শস্য দিয়েও রুটি তৈরি করা যায়।

প্রাচীন মিশরীয়দের শস্য ভাঙা এবং পেষণের জন্য প্রথম পাথরে তৈরি যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়; Image source: fineartamerica.com

রুটি তৈরির এই আদিম মিশরীয় পদ্ধতিটি বেশ সহজ-সরল। গম কিংবা অন্যান্য শস্য কোরেনে পিষে আটা তৈরি করা হয়। তারপর তা জলে ভিজিয়ে, ইস্ট দিয়ে হাতে ঠেসতে-ঠেসতে, মাখতে-মাখতে নরম তাল তৈরি হয়। তালের অভ্যন্তরীণ কার্বোহাইড্রেট ইস্টে জারিত হয়ে কার্বন ডাই অক্সাইডের বুদ্বুদ তৈরি করে। এর ফলে, এই আটা বা ময়দার তালটা দিব্যি ফুলে-ফেঁপে ওঠে। শেষে গরম উনুনে এই রুটি সেঁকা হয়। মিশরীয় সভ্যতার লোকেরা এভাবে প্রথম হালকা, ফাঁপা ও ফুলকো-ফুলকো সুস্বাদু রুটি তৈরি করেছিল। ঐতিহাসিকদের অনুমান, রুটি সেঁকার জন্য উনুনও প্রথম ওই মিশরীয়রা আবিষ্কার করেছিল। হাতে গড়া চ্যাপ্টা রুটিও বেশ প্রাচীন।

প্রাচীন মিশরীয়দের তৈরি রুটি; Image source: Ancient Egyptian Facts

২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুকুশ উপত্যকায় নানা শস্যের চাষাবাদ শুরু হয়। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মানুষ ঘোড়ার সাহায্যে চাষাবাদের কাজ করতো। সে সময়ে এই অঞ্চলে রুটি তৈরির প্রচলন শুরু হয়। ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে ইস্ট মিশ্রিত রুটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। ৪৫০ খিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে ওয়াটার মিল আবিষ্কৃত হয়। ফলে রন্ধন সম্পর্কীয় অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন, বেকিং রুটির কলাকৌশল গ্রিসেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়।

প্রাচীর গ্রিসে বেকিং রুটি তৈরির কৌশল; Image source: The Telegraph

১৫০ খিস্টপূর্বাব্দে রোমানরাই প্রথম স্বতন্ত্র এবং ব্যয়বহুল সাদা রুটি তৈরির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। ৩০০ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসের অধিবাসীরা ৭০০ রকমের রুটি তৈরি করতে জানতো। এভাবে সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের আধুনিকায়নের ফলে রুটি তৈরিতে এসেছে নানা বিবর্তন ও বৈচিত্র্য। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় সব রুটির কথা

মধ্যযুগ থেকে ইংল্যান্ডে বেকিং করা রুটির প্রচলন শুরু হয়। সে সময় উচ্চশ্রেণীর লোকেরা ময়দার তৈরি সাদা, নরম রুটি পছন্দ করতো, আর গরীবদের মধ্যে গমের তৈরি লাল রুটি খাওয়ার চল ছিল। একসময় ব্রিটেন ও অন্য বহু দেশে সরকারিভাবে রুটির দাম বেঁধে দেওয়ার চল ছিল। রুটিতে উপাদান হিসেবে কী শস্য ব্যবহার করা যাবে তা-ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হতো। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বেশিরভাগ রুটিই ময়দার তৈরি। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুটির নাম ইংলিশ মাফিনস এবং ক্রামপেট। এই দুই প্রকারের রুটি বহু বছর ধরে ইংল্যান্ডের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। ক্রামপেট দেখতে অনেকটা কেক সদৃশ। এই রুটি তৈরিতে ইস্টের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় ব্রেড বেকিং সোডা। এই রুটি খেতে হয় মাখন বা জ্যাম দিয়ে। আর ইংলিশ মাফিন সাধারণত প্রাতঃরাশে ডিম, পনিরের সাথে খাওয়া হয়।

ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় রুটি ক্রামপেট; Image source: fromthegrapevine.com

ফ্রান্সের জনপ্রিয় রুটির নাম ‘বাগুয়েত’। ফ্রান্সে বেড়াতে গিয়ে অন্যতম এক উপভোগ্য জিনিস হলো সাতসকালে কোনো রুটির দোকানে গিয়ে লাইন দেওয়া, তারপর প্রাতঃরাশের জন্য হাত ভর্তি বাগুয়েত কিনে বাড়ি ফেরা। 

আয়ারল্যান্ডের আইরিশ বামব্র্যাক কিংবা লিঙ্কশায়ার প্লাম ব্রেডের জনপ্রিয়তা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে।

রাই বা যব দিয়ে তৈরি হয় জার্মানির বিখ্যাত কালো রঙের রুটি ‘পামপারনিকেল’। ব্রাজিলে ‘কাসাভা’ নামে একপ্রকার কন্দ চাষ করা হয়। ঐ কাসাভা থেকেই সেখানে রুটি ও কেক তৈরি করা হয়।

ফরাসিদের প্রাতরাশের এক জনপ্রিয় খাবার বাগুয়েত; Image source: fromthegrapevine.com

আমেরিকার দক্ষিণের প্রদেশগুলোতে এখনো প্রাতঃরাশে গরম গরম রুটি পরিবেশন করা হয়। ভূট্টার তৈরি এসব রুটির কোনোটার নাম ‘বাকহুইট’, কোনোটার নাম ‘হোমিনি’, কোনোটার নাম আবার ‘জনি কেক’।

ফিরব্রেড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি জনপ্রিয় এক রুটির নাম। তবে এই রুটির উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নেটিভ আমেরিকানরাই মূলত এই রুটি তৈরির মূল কারিগর। পরবর্তীতে তাদের রুটি তৈরির কলাকৌশল শিখে নেয় অন্যান্যরা। এই রুটি তৈরির তিনটি প্রধান উপকরণ হলো ময়দা, চিনি এবং লার্ড নামের একধরনের চর্বিযুক্ত মশলা। তবে অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে পরিচিতি পাওয়া কুইক ব্রেড নামের একধরনের পাউরুটিও আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয়।

অষ্টাদশ শতকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক জনপ্রিয় রুটির নাম কুইক ব্রেড; Image source: fromthegrapevine.com

পোল্যান্ডের জনপ্রিয় রুটির নাম বাগেলস। এটি একধরনের বেকিং করা রুটি। বর্তমানে এই রুটি পোল্যান্ড ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার জায়গা করে নিয়েছে।

ইতালির এক ঐতিহ্যবাহী রুটির নাম ফোকাক্সিয়া। ময়দা, লবণ, জলপাই তেলের সাথে পিয়াজ, জলপাই মিশ্রিত করে উচ্চ তাপমাত্রায় তা বেক করা হয়। এভাবে তৈরি হয় সুস্বাদু এই রুটি। এই রুটি ইতালিয়ান পিজ্জা ও স্যান্ডউইচ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

ইতালির ঐতিহ্যবাহী রুটি ফোকাক্সিয়া; Image source: fromthegrapevine.com

গোল গোল পিত্তা রুটি মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরের অন্যতম আকর্ষণ। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে এই রুটির বেশ চাহিদা রয়েছে। মেক্সিকো এবং লাতিন আমেরিকায় ভূট্টা থেকে একজাতীয় ছোট ছোট রুটির মতো কেক তৈরি করা হয়, এর নাম ‘টরটিলা’।

মেক্সিকো এবং লাতিন আমেরিকায় ভূট্টা থেকে তৈরি একপ্রকার রুটি টরটিলা; Image source: fromthegrapevine.com

সুদূর প্রাচ্যের অধিবাসীরা অবশ্য গম বা আটার রুটির বদলে ভাত খেতে ভালবাসেন। কিন্তু, এই শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সারা পৃথিবীতে রুটি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ‘চাপাটি’ নামে একরকম রুটি ভারতসহ এই উপমহাদেশে একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। ভারতে হাতে গড়া চ্যাপ্টা, গোলাকার ইত্যাদি হরেক আকারের. নানারকম রুটি তৈরি হয়। বাকরখানি, লুচি, পরোটা, নান ইত্যাদি বহু পদ্ধতিতে তৈরি রুটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোর খুবই জনপ্রিয় এক খাদ্য।

দক্ষিণ এশিয়ার এক জনপ্রিয় রুটির নাম নান; Image source: fromthegrapevine.com

এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নানা জনপ্রিয় রুটির প্রচলন রয়েছে। তাদের মধ্যে কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার আরিপা, আরমেনিয়া পাতলা, সাদা ছেঁকা রুটি লাভাশ, ইসরাইলের চাল্লার জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়ে।

ফিচার ইমেজ- fromthegrapevine.com

Related Articles