ব্রাজিল মানে কারো কাছে ফুটবল, কারো কাছে বিশাল বিশাল বস্তিতে ডালপালা মেলা জঘন্য সব অপরাধের আঁতুড়ঘর। পরিবেশবাদীদের কাছে ব্রাজিল মানে মহাবন অ্যামাজন। অন্ধের হাতি দেখার মতো একেকজনের কাছে একেকরকম সাম্বানৃত্যের দেশ ব্রাজিল, ভোজন বিশেষজ্ঞদের কাছে ‘আতালা’র দেশ! বিখ্যাত হবার একটাই উপায়, “প্রতিদিন অভিন্ন কাজ করে যাও।” পৃথিবীর নানা প্রান্তের অসংখ্য বিখ্যাত ব্যক্তি এই আপ্তবাক্যটি প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেন আমাদের। এবং এটি নিখাঁদ সত্য।
আপনি যে কাজে ভালো, সেটিতে লেগে থাকুন। পরিশ্রম করতে থাকুন। সাফল্য একদিন ধরা দেবে। এসব উদ্দীপনামূলক বক্তব্য সকলের জানা। প্রশ্ন জাগতে পারে, তবে কেন তুলে আনা? তুলে আনার কারণ মিলাদ অ্যালেক্সান্ডার ম্যাক আতালা। ব্রাজিলে জন্ম নেওয়া এক রন্ধনশিল্পী, যিনি রান্না আর দর্শনের মিশেলে নিজেকে নিয়ে গেছেন অ্যামাজনের মতোই জীবনবোধের গভীরে। যার দিকে তাকালে মনে হবে- জীবনটা কঠিন, কিন্তু চাইলে একে নিজের মতো সাজিয়ে নেওয়া অসম্ভব নয়!
১৯৬৮ সালের ৩ জুন, সাও পাওলোতে জন্ম নেওয়া আতালা বুঝতে শেখার পর থেকেই অনেকটা ভবঘুরে প্রকৃতির হয়ে ওঠেন। বিশেষত অ্যামাজন তার কাছে মনে হয় আপন অরণ্য। পায়ের তলায় ঝরা পাতার শব্দ, পাখির কিচিরমিচির, পোকাদের ঘুরে বেড়ানো তাকে মুগ্ধ করত। এসব করতে করতে একদিন এক রক কনসার্টে ঢুঁ মারেন। বয়স তখন চৌদ্দের কৌঠায়। পাংক রকার হবার ভূত চাপে মাথায়। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ; যোগ দেন রক ব্যান্ডে। বদলে ফেলেন বেশভূষা। কানে দুল, গায়ে উল্কি, চুলের স্টাইলে পুরোদস্তুর ব্যান্ডশিল্পী বনে যান। কয়েক বছর বাদে পাড়ি জমান ইউরোপে। কিন্তু বিধিবাম! রক ব্যান্ড চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ। শুরু করলেন পেইন্টিংয়ের কাজ। তাতে পেটের দায় মিটলেও ভিসা পাওয়া হচ্ছিল না।
পরিচিত একজনের পরামর্শে যোগ দেন বেলজিয়ামের হোটেল দ্যে নাম্যুর-এ। উদ্দেশ্য ছিল কিছু আয় রোজগারও হবে, ভিসা পেয়ে থিতুও হওয়া হবে। কিন্তু কে জানত, আতালা থিতু হতে চলেছেন রান্নাঘরে! সেই যে বেখেয়ালে প্রবেশ করলেন, আজও বের করেননি নিজেকে। বেলজিয়াম হয়ে ফ্রান্স, তারপর ইতালি। সময়ের পালাবদলে দামি রেস্তোরার হেঁশেলে নিজেকে গড়ে তুলেছেন অল্প অল্প করে। ইতালিতে থাকতে পরিচয় ঘটে ক্রিস্টিনার সঙ্গে। পরিচয় রূপ নেয় প্রণয়ে। পৃথিবীর আলো দেখে আতালা জুনিয়র। সন্তানের জন্মের পর ভিন্ন খেয়াল জাগে আতালার মনে। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে চলে যাবেন ব্রাজিলে। যে অ্যামাজনের আলো বাতাসে তার বেড়ে ওঠা, সন্তানও বাড়বে একই আবহে।
১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে কাজ নিলেন সাও পাওলোর এক ফরাসি রেস্তোরাঁয়। ফরাসি, ইতালীয় খাবারের ব্যাপক চাহিদায় ভরপুর ছিল সেটি। আতালার কাজ এবং ব্যবহারে মুগ্ধ হলেও একদিন বস এরিক জ্যাকুইন তাকে ডেকে নেন। বলেন,
তুমি ভালো একজন রাঁধুনী। কিন্ত ফরাসি আর ইতালীয় ডিশগুলো ঠিক ফরাসি আর ইতালীয় কায়দার হয় না। তুমি ফ্রান্স আর ইতালির রাঁধুনীদের মতো কখনোই এসব বানাতে পারবে না।
একপ্রকার অপমানজনক কথাগুলো ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয় আতালাকে। এরিকের কথাকে একেবারে ফেলে দেননি তিনি। আবার এ-ও ভাবেন, ফরাসি আর ইতালীয় বাকিদের মতো না পারলেও ব্রাজিলীয় ডিশ তার চেয়ে ভালো কেউ বানাতে পারবে না! আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর আতালা খুলে বসেন নিজের রেস্তোরাঁ। সেখানে মিলেমিশে একাকার হয় জেদ, কিছু করে দেখাবার তাড়না। কে ভেবেছিল তখন, ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ডিয়ো অপটিপো ম্যাক্সিমা’ বা সংক্ষেপে ডি.ও.এম রেস্টুরেন্টটি পরবর্তীকালে বদলে দেবে ব্রাজিলিয়ান খাবারের ইতিহাস!
ডি.ও.এম-এর আগাগোড়া ব্রাজিলীয় ঢঙে গড়া। ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়বে লাতিন দেশটির সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও সাজসজ্জা। দেশীয় ঐতিহ্যে ঢেলে সাজানো ডি.ও.এমের রান্নার ৯০ শতাংশ উপাদানের যোগান আসে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস হতে। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এই ৯০ ভাগের ৫০ ভাগই আসে অ্যামাজন অঞ্চল থেকে। আতালার সঙ্গে অ্যামাজনের গভীর ভালোবাসা আছে বলেই হয়তো এটি সম্ভব হয়েছে।
চাইলে অ্যামাজনের পশুপাখি, মাছ দিয়ে ডিশ তৈরি করতে পারতেন আতালা। কিন্তু ফরাসি, ইতালীয় খাবারকে টক্কর দিতে শুরুতে মাছ-মাংস যথেষ্ট নয়। আতালা সেটি জানতেন, তাই ও’পথ মাড়াননি। তিনি বরং ঝোঁকেন এমন কিছুর দিকে, যাতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যদিও সেই সময়টায় ব্রাজিলীয়রা গাঁটের পয়সা খরচ করে দেশি খাবার খেতে চাইত না, তা-ও আবার দেশি কারো দোকানে। তবে আতালা দমার পাত্র ছিলেন না। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যারা টিকে থাকে, তাদের আসলে হারানো কঠিন।
তিনি শুরু করেন নিজস্ব ঢঙে রান্না। তার কাছে ব্রাজিলিয়ান খাবারের চেয়ে সেরা আর কিছু নেই। এমনকি পৃথিবীর অন্যতম দামি খাবার ‘ক্যাভিয়ার‘-এর স্বাদ প্রথমবার নেয়ার পর তার কাছে সেটিও সাদামাটা মনে হয়েছে। ক্যাভিয়ার সম্পর্কে তার দর্শন ছিল এমন, “এটি আকর্ষণীয় কারণ লোকের মুখে মুখে এর আকর্ষণ বেড়েছে!” ক্যাভিয়ার যতটা সাদামাটা লেগেছে, ততটাই অনবদ্য লেগেছে ব্রাজিলের স্থানীয় পানীয় ‘তুকুপি।’ ক্যাভিয়ারের চেয়ে স্বাদে-ভারে তুকুপিই মন ছুঁয়ে গেছে তার।
একসময় স্থানীয় ব্ল্যাক রাইস বা কালো চালকে এড়িয়ে চলতো মানুষ। সেটিকেই ডি.ও.এমের হেঁশেলে নিয়ে আসেন আতালা। হালকা সেদ্ধ কালো চাল, কাঁচা সবজি, বাদাম ও দুধের সমন্বয়ে তৈরি করা সেই ডিশ এখন ব্রাজিলের অন্যতম পছন্দের ও সুস্বাদু খাবার। শুধু তা-ই নয়, অ্যামাজনের নানা ফুলের সাথে পিরারুকু মাছের সমন্বয় ঘটান তিনি। ক্যাভিয়ার তাকে আকৃষ্ট না করলেও এর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ধারণা রেখেই যুক্ত করেন ডি.ও.এমের খাদ্যতালিকায়। তবে আতালা আর তার রেস্তোরাঁকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করবে যে জিনিস, তা হচ্ছে ‘অ্যামাজনিক অ্যান্ট!’ অ্যামাজনের বিষাক্ত পিঁপড়াকে খাবার টেবিলে আনার ভাবনাটা নিছক পাগলামি বৈ অন্য কিছু ছিল না। তবে ব্যক্তি যখন আতালা, এতটুকু পাগলামি প্রত্যাশিত।
পিঁপড়াকে বিকল্প প্রোটিন হিসেবে আখ্যা দেন তিনি। কিউব করে কাটা এক টুকরো আনারসের উপর বসানো পিঁপড়ার ডিশের চাহিদায় চোখ কপালে উঠবে। কেবল আনারসের উপর নয়, নারকেলের টুকরো কিংবা কখনও শুধু পিঁপড়াটাই পরিবেশন করা এই ডিশ অ্যামাজনিক অ্যান্ট আতালাকে পৌঁছে দিয়েছে খ্যাতির শিখরে। এছাড়াও ডি.ও.এমে ঢুঁ মারলে খাদ্যপ্রেমীদের যে ডিশগুলোর স্বাদ না নিলেই নয়, তাদের মধ্যে লাইম অ্যান্ড র্যাভিওলি, তুকুপি অ্যান্ড তেপিওকা, পাম্পকিন উইথ তেপিওকা আইসক্রিম অন্যতম।
কখনোই শেফ হবার চিন্তা না করা আতালা এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন রাঁধুনী। ফরাসি, ইতালীয় আইটেমকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে গড়ে তোলা ডি.ও.এম ব্রাজিলের এক নম্বর তো বটেই, ২০১২ সালে রেস্টুরেন্ট ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের চতুর্থ সেরা রেস্টুরেন্টের খেতাব জিতেছে। দুটো মিশেলিন স্টার পাওয়া ডি.ও.এম যেখানে শুরু করেছিল, দুই দশক পরেও সেখানেই রয়ে গেছে। ব্রাজিলে আরও চারটি শাখা চালু আছে এর। ২০২২ সালে আতালা চালু করতে যাচ্ছেন গ্র্যান্ড ডি.ও.এম, যাতে থাকবে সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা।
সবসময় মানুষের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টায় মগ্ন অ্যালেক্স আতালা ২০০৩ সালে অ্যামাজন অঞ্চলে একটি পশুর খামার কেনেন, চেয়েছিলেন ওখানকার দরিদ্র মানুষদের সহায়তা করবেন। কিন্তু সঠিক নির্দেশনা ও দেখভালের অভাবে অচিরেই পশুর খামারের চারপাশ নোংরা হতে থাকে। এতে পরিবেশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর তিনি চালু করেন আতালা ইন্সটিটিউট বা এটিএ ফাউন্ডেশন। খামারের আশপাশে প্রায় ৭০ প্রজাতির মরিচ গাছ লাগান এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয়দের কাজ দেন।
প্রত্যেক ডিশের পেছনেই একটি মৃত্যু থাকে। আমরা যখন সেই ডিশ মুখে পুরে দিই, বাকি সব বেমালুম ভুলে যাই।
এমন কথা বলা আতালাকে শুধুই একজন শেফ ভাবলে বড়সড় ভুল হবে। ফোর্বসের বিচারে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় থাকা আতালা একজন সুবক্তাও বটে। অ্যামাজনের গহীন অরণ্যে সবুজে হারিয়ে, ঝর্ণাধারায় ভিজতে ভিজতে, প্রাণ ও প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আজকের আতালা হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন বিশ্বের নানা দেশে। শুনিয়েছেন অভিজ্ঞতার গল্প। আমরা সবসময় ব্যয় নিয়ে চিন্তিত থাকি। আতালা বাতলে দিয়েছেন সহজ সমাধান। তার ভাষ্যে,
ব্যয় হচ্ছে নখের মতো, যা প্রতি সপ্তাহে বাড়ে। কেটে ভারসাম্য রাখতে হয়।
ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় যোগাযোগের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হতে চলেছে কোনটি? কেউ এমন প্রশ্ন করলে আমরা হয়তো ফেসবুক, টুইটার কিংবা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমের নাম বলব। বছরে অন্তত তিনবার অ্যামাজনে ঢুঁ মারা আতালার কাছে একই প্রশ্ন জানতে চাওয়া হলে একমুহূর্ত না ভেবে তিনি বলে দেন খাবারের কথা। একেবারে ফেলে দেওয়া কথা নয় মোটেও। সত্যিই, দেশ-বিদেশের খাবার চাখতে কত কসরতই না করে ভোজনরসিকরা!